আজকের আমেরিকা (১) –শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

33986_290774347684527_1888007642_n

আমেরিকার পথে

আমি একজন ভবঘুরে। পৃথিবীতে দেখেছি অনেক, জেনেছি অনেক। আমার জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে দিবার মত যদি কিছু থাকে দেশবাসী হয়ত বা গ্রহণ করবেন, সেই আশা নিয়েই পুনরায় আমি আমার যাযাবর জীবনের কাহিনী লিখতে বসেছি।

এবার আমি আমার আমেরিকা ভ্রমণের কথা এখানে বলব। আমেরিকা গণতন্ত্রের দেশ। স্বাধীনতা-যুদ্ধের ইতিহাস, জর্জ ওয়াশিংটন ও লিন্কনের কথা এবং অন্যান্য প্রসিদ্ধি এই দেশটি দেখবার জন্যে আমার অন্তরে একটা তীব্র আবেগ জাগিয়ে রেখেছিল। এতদিন পরে যখন সেই আমেরিকার পথে পা বাড়ালাম মন তখন আশা ও আনেন্দ উল্লসিত হয়ে উঠল।

কেনেডা থেকে একবার আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার কারণ দেখান হয়েছিল–আমি গরিব, গরিবের স্থান কেনেডায় নাই। আসল কথা তা নয়, আমি ভারতবাসী; তাই ইমিগ্রেসন বিভাগের সু-নজরে পড়তে পারিনি। আমার উপর কড়া হুকুম হল কেনেডা ছেড়ে চলে যাবার জন্য। আমেরিকা যাবার ইচ্ছা আমার মোটেই দমল না। ইউরোপ ভ্রমণ সমাপ্ত করে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছে যখন তদরকারী টাকা যোগাড় করতে সমর্থ হলাম, তখন আমেরিকা যাবার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে পড়লাম। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা হতে আমেরিকায় যাবার পথ আমার রুদ্ধ ছিল। আমাদের দেশের দক্ষিণ আফ্রিকার এজেণ্ট জেনারেলগণ সে কথা ভাল করে জানতেন কিন্তু কখনও এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করেন নি। যদি তাঁরা প্রতিবাদ করতে যেতেন, তবে তাঁদের নিশ্চয়ই কাজে ইস্তফা দিতে হত। চাকরির মায়া ছেড়ে যদি চার পাঁচজন এজেণ্ট জেনারেল এই অন্যায়ের তীব্র প্রতিবাদ করতেন, তবেই দক্ষিণ আফ্রিকার বুয়ার সরকারের কান খাড়া হয়ে উঠত। ভারতের গণ্যমান্য লোক বুঝতেন দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতবাসীর প্রকৃত অবস্থা। ফলে হয়ত আমাদের কষ্টের অনেকটা প্রতিকার হত।

আমাদের দেশের লোক শুনেছে দক্ষিণ আফ্রিকাতে “কালার বার” আছে। তার স্বরূপ কি তা অনেকেই বুঝতে পারে না, যারা বুঝেছে তারা আবার বলতেও চায না। দক্ষিণ আফ্রিকাতে ভারতীয়দের মাঝে দুটি দল আছে; সে দল হিন্দু-মুসলমানের নয়–কংগ্রেস এবং কলোনিয়্যাল-বর্ণ (Colonial Born)। দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় কংগ্রেসের জন্ম দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। কলোনিয়্যাল-বর্ণ অর্থাৎ উপনিবেশে জাতদের দল এবং ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশনের জন্মদাতা হলেন মিঃ মণীলাল গান্ধী। পিতা যা গড়েছেন পুত্র তা ভাংতে না পেরে নতুন দল গঠন করেছেন। আমি এই দুটা প্রতিষ্ঠান হতেই পৃতকভাবে থাকবার জন্যে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি। অনুনয় বিনয় করার অভ্যাস আমার নাই। দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয় কংগ্রেস দল কিন্তু তার অনেকটা পক্ষপাতী। ‘কালার বার’ যারা নীরবে সহ্য করতে পারে, তারা অনুনয় বিনযের পক্ষপাতী না হয়ে যায় কোথায়? ঐাদের আত্মসম্মান বোধ নাই, তারা মোটেই বুঝতে পারে না–অনুনয় বিনয় মানসিক অধোগতির একটা প্রত্যক্ষ ফল। আমি খাঁটি মানুষের সংগে থেকে সে তথ্য বুঝতে পেরেছিলাম।

দক্ষিণ আফ্রিকায় মহাত্মা গান্ধীর অবস্থিতির সময়ই বুয়ার সরকার কংগ্রেসীদলকে স্বীকার করেছিলেন। কলোনিয়্যাল-বর্ণ এবং ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশনকে এখনও স্বীকার করেছেন বলে মনে হয় না। স্বীকার না করার নানা কারণও আছে। যত লোক কলোনিয়্যাল-বর্ণ তারা হল ইউরোপীয়ান মেজাজের। ইউরোপীয়ান ধরণে খাওয়া-পরা ত আছেই, উপরন্তু এদের মেজাজটা নিয়েই দক্ষিণ আফ্রিকায় কংগ্রেস এবং বুযার সরকার একটু বিপদে পড়েছেন। এখন ইউরোপীয়ান মেজাজ কাকে বলে তা বুঝিয়ে বলি। আমাদের দেশে ল-নের গাওয়ার স্ট্রীট ফেরতা বাবুদের সাথে আমরা বলি তারা ইউরোপীয়ান মেজাজী হয়েছেন। আসলে কিন্তু তা নয়। হ্যাট কোট পরলে এবং মদ খেলেই যদি ইউরোপীয়ান মেজাজ হত, তবে গাধাও সিংহ হয়ে যেত। অনেক স্কচ্-ম্যান্ পর্যন্ত Inferiority of complexion হতে বাদ পড়ে না; কিন্তু তারাও আমাদের দেশে বড়লাট হয়। Inferiority of complexion যদি দূর করতে হয়, তবে সকল সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়, মরতে হয় তাও বরণ করে নিতে হয়। মাথা নত না করাই হল ইউরোপীয় মেজাজ। দক্ষিণ আফ্রিকায় কলোনিয়্যাল-বর্ণরা সে দলের লোক। তারা ভাল করেই জেনেছে ভারতীয় জাতিভেদ ভারতের কত অনিষ্ট করেছে, তাই তারা জাতিভেদ মোটেই মানে না। তারপর তারা এটাও বুঝতে পেরেছে কালার বার মানুষকে কত খাট করে ফেলে। তাই আজ তারা মানুষ বলে পরিচয় দেয় এবং মানুষের প্রাপ্য সম্মান তারা আজ যদি না পায় একদিন তারা তা আদায় করবেই। তারা তাদের দাবী মিটাবার জন্য কারো কাছে কিছুই ভিক্ষা চায় না না অথবা সাহায্য পাবার জন্য প্রত্যাশাও রাখে না।

যাদের জন্ম ভারতে হয়েছে কিংবা ভারতে যারা অনেক দিন থেকেছে তাদের মতিগতি অন্য ধরণের। তারা ধর্মের কথা বলে, টাকা জমায এবং আরও ধনী হবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। ঔপনিবেশিকরা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে সভা করে, দরকার হলে লড়াই করে, তারপর বুয়ার সরকারকে মাঝে মাঝে হুমকীও দেখায়। মহাত্মা গান্ধী তাদেরই অনুগ্রহে দক্ষিণ আফ্রিকাতে সত্যাগ্রহ করে কৃতকার্য হয়েছিলেন। আমার সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য বলতে পারি না, অনিচ্ছায় সেই দলেই মিশে পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম।

ডারবান, ইস্টল-ন, পোর্ট এলিজাবেথ এবং কেপটাউনই হল দক্ষিণ আফ্রিকার প্রসিদ্ধ বন্দর। যাত্রী জাহাজ ডারবান এবং কেপটাউনে ছুঁয়ে থাকে। কার্গোবোটগুলি অন্য দুই বন্দরে নিয়মিতভাবে এসে দাঁড়ায়। আমেরিকা যাবার ভিসা পেয়েছিলাম, জাহাজ ভাড়ার টাকা পকেটে ছিল, তবুও আমার পথ বন্ধ ছিল। ধর্ম আমাকে এখানে সাহায্য করতে পারে না আমার টাকা এখানে অচল কারণ টাকারও মূল্যের তারতম্য আছে। সাদা লোকের হাতে আমারই হাতের টাকা যখন চলে যায় তখন তার মূল্য বাড়ে। অবশ্য এরূপ তারতম্য অনেকে পছন্দ করেন না। আমি স্বচক্ষে দেখেছি অনেক ইংলিশম্যান্ অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে একগুঁয়েমী করে এর প্রতিকার করবার চেষ্টায় উঠে পড়ে লাগেন, কিন্তু রোগের কারণ না জেনে ঔষদ দেওয়ায় যে ফল হয় এক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়ে থাকে।

ডারবানে আমেরিকা যাবার টিকেট কেনার চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু টিকেট কেনা আমার দ্বারা সম্ভব হয় নি। জাহাজের এজেণ্টরা কেউ বলে, সকল বার্থই ভাড়া হযে গিয়েছে, গতকল্য যদি আসতেন তবে নিশ্চয়ই একটা বার্থ পেয়ে যেতেন। কেউ বলে আগামী ছয় মাসের জন্য সমগ্র জাহাজটাই ভাড়া হয়ে গেছে। এসব কথা শুনে আমি চিন্তিত হয়েছিলাম। বন্ধুবান্ধবদের কাছে সাগর পার হবার উপায় খোঁজখবর ভার দিয়েছিলাম এবং নিজেও খুঁজতেছিলাম।

রেডিওতে লেকচার দেওয়া তখন আমার একটা পেশা হয়ে গিয়েছিল, কারণ সকলেই বিদেশের খবর শুনতে বড়ই উৎসুক ছিল। ডারবানে এসে টিকেট কেনার কাজে ব্যস্ত থাকায় সেদিকে মন দিতে পারিনি কিন্তু হঠাৎ একদিন একজন রেডিও ব্রোকার বলল যে, প্রধান এনাউন্সার হলেন একজন প্রাক্তন সৈন্য এবঙ অনেক জাহাজ কোম্পানীর লোকের সংগে তার সম্বন্ধও রয়েছে। হয়ত রেডিওতে লেকচার দিলে তিনি জাহাজের টিকেট কেনার কোনরূপ সুবিধা করে দিতে পারেন। আমি তৎক্ষণাৎ ডারবানের বেতারে লেকচার দিতে স্বীকৃত হলাম। লেকচার দিবার পর প্রধান এনাউন্সার আমার টিকেট কেনায় সাহায্য করেন। তিনি যদি টিকেট কিনতে আমাকে সাহায্য না করতেন, তবে আমাকে অন্য কোন উপায়ে বিলাত যেতে হ’ত।

টিকেট কেনা হয়ে গেলে ইস্টল-ন হয়ে পোর্ট এলিজাবেথ হতে কেপটাউনে যাই এবং সেখান থেকে ক্যাসেল লাইনের যাত্রি জাহাজে সাউথহামটনের দিকে রওনা হই।

কেপটাউনে আমাকে অনেক দিন থাকতে হয়েছিল। কেপটাউন দেখার জন্য অনেক আমেরিকান ও ইউরোপীয়ান লালায়িত। এতে কেউ সফলকাম হয়, আর কেউ হয় না। যারা কেপটাউন দেখার চেষ্টা করে কৃতকার্য হয়নি, তারাও কেপটাউন সম্বন্ধে বই লিখেছে; সেরূপ বই আমি পাঠ করেছি। দেখেছি, যারা কেপটাউন না দেখেই বই লিখেছে, তাদের লেখাতে অনেক সার কথা রয়েছে। আর যারা কেপটাউন দেখে বই লিখেছে তাদের লেখায় অনেক এলোমেলো ভাব রয়েছে। আমি যখন কেপটাউন সম্বন্ধে বই লিখব, হয়ত তখন অনেক এলোমেলো ভাব তাতে থাকবে, কিন্তু তাতে দুঃখ নাই। কেপটাউন স্বচক্ষে দেখতে পেরেছি এই আনন্দেই আমার বুক ভরা।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.