আজকের আমেরিকা (২) –শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

33986_290774347684527_1888007642_nপ্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছবি আঁকার ইচ্ছা আজ আমার হচ্ছে না। প্রাকৃতিক দৃশ্য অনেকদিন থাকবে। কিন্তু মানুষের মনের ভাব বদলায় অতি সত্বর। সেই পরিবর্তনশীল মনকে জানতে আমি পছন্দ করি। কেপটাউন সম্বন্ধে যখন কিছু লেখব তখন আজকের দিনের কথাই লেখব আর যারা ভবিষ্যতে সুখময় পৃথিবীতে আসবে তারা তুলনা করে দেখবে তাদের পূর্বপুরুষ কত বর্বর ছিল।

এখনও কয়েকটা কাজ আমার বাকি রয়েছে তা সমাপ্ত করতে হবে। প্রথম কাজ হল, যে পঞ্চাশ পাউ- জমা দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাতে প্রবেশ করেছিলাম, তা ফিরিয়ে আনতে হবে। দ্বিতীয় কাজ হল, দেখতে হবে কেবিনটি কোথায়।

টাকার রসিদটা ফিরিয়ে দিবার সময় তাতে প্রাপ্তিস্বীকারের স্থানে নাম সই করে দিলাম এবং পাউ-গুলি গুণে পকেটে রেখে বিদায় নিলাম। কেবিনটা দেখে বেশ আনন্দই হল। কেবিনে আর একজন লোক ছিলেন, তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতবাসী। দুঃখের বিষয় যখন আমি কেবিন দেখতে গিয়েছিলাম তখন তিনি কেবিনে ছিলেন না। কেবিন হতে বাইরে এসে আমার কেপটাউনের বন্ধুবান্ধবদের সংগে কথা বলতে লাগলাম। মিঃ কল্যাণজী (হিন্দু সভার পৃষ্ঠপোষক), মিঃ কেশব (হিন্দু সভার সেক্রেটারী), মিঃ পালসেনীয়া (কেপটাউনের কংগ্রেসের সেক্রেটারী) সেখঅনে উপস্থিত ছিলেন। কতকগুলি স্কোলী বালকও (ঝপযড়ষর ইড়ুং) আমার মমতা ত্যাগ করতে পারেনি। তারা ডকের উপর দাঁড়িযে নানারূপ শ্লোগান বলতে শুরু করে দিয়েছিল। তিনখানা সংবাদপত্রের প্রতিনিধি একসংগে এসে আমার বিদায় বাণী ও মন্তব্য শুনতে চাইলেন। আমি তাদের বললাম, “দক্ষিণ আফ্রিকার জল এবং ফলের তুলনা অন্য কোন দেশের জলের এবং ফলেং সংগে হয় না। জোহান্সবার্গের স্বর্ণ-খনি এবং কিম্বালির হীরার খনি জগৎ বিখ্যাত; কিন্তু ঐ ‘কালার বারটা’ আমার মোটেই সহ্য হয়নি। ‘কালার বারের’ দুর্গন্ধ নাক হতে ছাড়াবার জন্য ল-নে গিয়ে অনেক দিন থাকতে হবে এবঙ যে পর্যন্ত কালার বারের দুর্গন্ধ নাক হতে না যায় সে পর্যন্ত লণ্ডন পরিত্যাগ করব না।

“আমি জানতাম না কালার বার কেমন হয়। এখন জেনেছি এবং বুঝেছি কালার বার কাকে বলে। এতে আমার যদিও ক্ষতি হয়েছে অনেক, কিন্তু শিক্ষা হয়েছে ক্ষতির চেয়েও বেশী। আমি জগতে এসেছি ছাত্র হয়ে, আজীবন ছাত্রই থাকব তাই যতদূর পারি শুধু শিখে নিতেই চাই।

“জগতের লোক, বিশেষ করে যারা ধর্ম নিযে চর্চা করে, তারা বলে পূর্বে জগৎ ভাল ছিল এখন খারাপ হয়েছে কিন্তু তারা বুঝে না কিংবা বুঝতে চেষ্টাও করে না জগৎ যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে। জগতের উন্নতির গতি বুঝবার উপায় আছে এবং উন্নতি যাতে হয় তার চেষ্টাও করা দরকার। নিরপেক্ষ মানুষেরা এবং স্বাধীনচেতা লোকেরা তাই বলবে। ধর্মের ঘাড়ে সকল দায় চাপিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। ধর্মগুলি জগতকে উন্নতির পথে অনেক টেনেছিল, কিন্তু ধর্মের তেজ ক্ষণস্থায়ী। দক্ষিণ আফ্রিকার অত্যাচারিত কালো, ব্রাউন এবং বাদামী একত্র হও যাতে মানুষ বলে পরিচয় দিতে পার। ধর্ম তোমাদের সাহায্য করবে না, করতেও পারে না, উপরন্তু তোমাদের মাঝে ভাংগন এনে দিবে। ইউরোপীয়ানরা নিজেদের ‘আফ্রিকানেরার’ বলে পরিচয় দেয়, তোমরা নিজেদের আফ্রিকান বলে পরিচয় দাও দেখবে স্বাধীনচেতা মানুষ, পরাধীন ভারতবাসী, মরণ-বিজয়ী চীন তাতে যোগ দিবে। মুষ্টিমেয় বুয়ার তোমাদের পদদলিত করে রাখতে পারে না, পারবেও না।” এই বলে আমি সাঙবাদিকদের কাছ হতে বিদায় নিয়েছিলাম।

এদিকে ইমিগ্রেসন বিভাগ আমাকে খোঁজ করবার জন্য অন্ততঃ পাঁচটা লোক পাঠিয়েছে। যেই আমাদের কাছে আসে সে-ই দাঁড়িয়ে আমার কথা শুনে, ফিরে আর যায় না। তারা সকলেই ‘কালার্ড ম্যান’;  তারপর ইমিগ্রেসন অফিসার নিজে এসে একটু দাঁড়িয়ে ভদ্রভাবে আমাকে বললেন, “মহাশয়, দয়া করে পাঁচ মিনিটের জন্য এদিকে আসুন।” ইমিগ্রেসন বিভাগে ইউরোপীয়ান অফিসার বোধহয় দু’তিন জন থাকে। একজন বললেন, “মহাশয়, দয়া করে আপনার আংগুলের টিপ দিতে হবে।“ আমি বললাম, “অন্যান্য ইউরোপীয়ানরা তো আংগুলের টিপ দেয় না আমি তা দিব কেন?”

“আপনি যে ভারতবাসী সেকথা আপনার স্মরণ রাখা দরকার। আংগুলের টিপ বদ্লাতে পারে না।” কোন কথা না বলে আংগুলের টিপ দিয়ে চলে এলাম।

যে সকল স্কোলী বয় আমাকে বিদায় দিতে এসে শ্লোগাণ ঝাড়ছিল তাদের চিৎকার জাল চারলী চ্যাপলিন্ এসে থামিয়ে দিল। আসল চারলী চ্যাপলিন্ থাকেন হলিউডের এক কাণা গলিতে তা দেখেছি এবং সে সম্বন্ধে নানারূপ গল্পও শুনেছি। অবশ্য এসব বাজে কথা এখানে বক্তব্য নয়। জাল চারলীর দিকে কৌতূহলা দর্শকরা ছয় পেনী এবং এক শিলিং-এর রৌপ্যমুদ্রা বর্ষণ করছিল। যাত্রী এবং ছাত্র-সেপাইগণ আনন্দে চিৎকার করছিল। আমাদের মন সেদিকে ক্ষণিকের তরে আকৃষ্ট হল।

কেপটাউন! যদিও তোমার সৌন্দর্য আমার মনকে মুগ্ধ করেছে, তোমার বুকের অনেক সন্তান আমাকে আপন করে গ্রহণ করেছে, তবুও তোমার কথা ভুলার জন্য আমাকে অনেকদিন অন্যত্র গিয়ে থাকতে হবে। কারণ তোমার শরীরে এমন এক ক্ষত আছে, যা আমি সহ্য করতে পারি না, যা আমার মনকে বিচলিত করে তোলে। তোমার সন্তানগণ যদিও সে ক্ষত দেখে ক্ষণিকের জন্য ঘৃণা প্রকাশ করে, তারপরই কিন্তু সব ভুলে যায়।

তারা জানে তাদের মায়ের শরীরে ক্ষতের কারণ তাদেরই আপন ভাই, আর সে ভাই কত দুর্দান্ত। হয়ত একদিন তোমার দুর্দান্ত ছেলেকে তারা শাসন করবে, সেদিনের জন্য অপেক্ষা কর, আর আমাকে বিদায় দাও। আমাকে যেতে হবে বহুদূর। আমার কাজই হল পুরাতনকে ভুলে গিয়ে নূতনের স্বরূপ চিন্তা করা। আমি এখন আমেরিকার পথে।

জাহাজ ছাড়তে এখনও অনেক দেরী। যারা জাহাজের যাত্রী নয় তাদের নেমে যাবার আদেশ হয়েছে। আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধবগণও শ্বেতকায়দের ভিড় ছিল। তাদের গা ঘেঁষে আমার বন্ধুদের দাঁড়ান খুব নিরাপদ ছিল না। ইউরোপীয়ানরা বন্ধুদের বিদায় দেবার শোকে যদিও মুহ্যমান, তবু পাশে কালা আদমী এসে দাঁড়ালে সে শোক মুহূর্তে ক্রোধে পরিণত হয় এবং অসহায় নিরীহ ভারতীয়দের উপর অসং ব্যবহার করে থাকে। সুতরাং ভারতীয়দের বাধ্য হয়েই বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়াতে হল। কিন্তু স্কোলী বালকরা অন্যরূপ। তারা শ্বেতকায়দের কাছেই দাড়িয়েছিল। সাদাদের বুটের লাথির ভয় তারা রাখে না। তারাই আমাকে লাল নীল সবুজ সাদা নানা রংএর ফিাত দিয়ে গিয়েছিল উপরের ডেক হতে ছাড়বার জন্যে। আমি ফিতাগুলি ছাড়লাম। কয়েকটা ফিতা তারা ধরল এবং আমার মুখের দিকে সকরুণ দৃষ্টি দিয়ে ইসে মোড় ফিরেই দম বাড়িয়ে দিল। জাহাজের খালাসী থেকে কাপ্তান সকলেই শ্বেতকায়, তারা সকলেই আপন আপন কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠল।

আটলাণ্টিক মহাসাগরে যে সকল জাহাজ চলাফেরা করে, তাদের কতকগুলি আইন মানতে হয়। সর্ব প্রথম আইন হল, ডেক প্যাসেনজারের কোন ব্যবস্থাই নাই। দ্বিতীয় নিয়ম হল, এশিয়াটিক ফুড অর্থাৎ চীনা খাবার কোনও যাত্রীকে খেতে দেওয়া হয় না। জাহাজারে টিকেট কেনার মানেই হল, সর্ববাদীসম্মমত খাদ্য তোমাকে খেতেই হবে।

আমি টিকেট কিনেছি তৃতীয় শ্রেণীর। প্রশান্ত মহাসাগরের, চীন সমুদ্র তীরের এবং ভারত মহাসাগরের জাহাজে তৃতীয় শ্রেণীকেই ডেক প্যাসেন্জার বলে। এখন আটলান্টিক মহাসাগরের ডেক প্যাসেনজার বা তৃতীয় শ্রেণীর লভ্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সম্বন্ধে একটু সংবাদ দিতে ইচ্ছা করি। কেপটাউন হতে সাউথহামটন তৃতীয শ্রেণীর ভাড়া চৌত্রিশ পাউণ্ড অর্থাৎ আমাদের দেশের সাড়ে চারশ টাকা। আমাদের কেবিনে দুখানি বার্থ, তাতে বিছানা পরিপাটিরূপে সাজানো ছিল। তিনটি আলো ছিল। একটা কেবিনের মধ্যস্থলে আর দুটা আলো প্রত্যেক বালিশের পেছনে। বই পড়তে বেশ আরাম। ছোট শিকলে টান দিলেই বাতি জ্বলে উঠে, আবার সেই ছোট শিকলে টান দিলেই বাতি নিবেও যায়। ভিতরেই হাতমুখ ধোবার জন্য গরম এবং ঠাণ্ডা জলের ব্যবস্থা আছে, তাছাড়া পাঁচটা কেবিনের পরই একটি করে স্নানের ঘর। ডাইনিং রুম, স্মোকিং রুম, লাইব্রেরী, খেলবার নানারূপ সরন্জাম, রুম স্টুয়ার্ট, স্নানাগারের স্টুয়াট–এসকল ত ছিলই। দৈনিক সংবাদপত্র জাহাজে ছাপান হ’ত এবং সকাল বেলায় ঘুম ভাংতেই প্রত্যেকের হাতের কাছে একখানা করে সংবাদ পত্র দেবার ব্যবস্থা ছিল। এর জন্য দাম দিতে হ’ত না। ডিনারের পর সিনেমা দেখান হ’ত। প্রত্যেক কেবিনেই কলিংবেল-এর ব্যবস্থা ছিল। বেল বাজালেই বয় দৌড়ে আসত। কোনও এক সময়ে ইংলণ্ড ও স্পেন হতে যখন যাত্রীরা উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকায় যেত তখন ছিল ডেক প্যাসেন্জারের ব্যবস্থা। এতে অনেক লোক পথেই মরত, আর যারা বেঁচে থাকত তারাও এমরিকায পৌঁছবার পর কয়েক মাসের মাঝেই মরত। এরূপ মৃত্যু হবার পর ডেক প্যাসেনজার ব্যবস্থা উঠিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের সমুদ্রে গরম বাতাস থাকার জন্য ডেক প্যাসেনজারের ব্যবস্থা এখনও রয়েছে, এবং আমাদের নিয়ম কানুন অর্থাৎ ধর্মের গোড়ামী থাকায় আমরাও ডেক প্যাসেনজারী পছন্দ করি। এতে আমাদের কত হীন হতে হয়, কত অপমান সহ্য করতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। এসব জেনে শুনেও আমরা এসবের প্রতিবাদ করি না।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.