জাহাজ এখন গভীর সমুদ্রে। আমার কেবিন দেখা হয়েছে, এবার আমাকে জাহাজ দেখতে হবে। তাই জাহাজের একদিক থেকে অন্যদিকে দেখতে দেখতে এগোতে লাগলাম। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণী সবই দেখলাম। দক্ষিণ আফ্রিকার যে কোনও শহরে জাপানী এবং তুরুক ছাড়া অন্য কোন এসিয়াবাসী বুক ফুলিয়ে হাঁটতে পারে না, আমি কিন্তু হেঁটেছি। জাহাজে বুক ফুলিয়ে হাঁটতে ভয় পাব কেন? কিন্তু সকলের তা সহ্য হয় না। দু’একজন এরই মধ্যে জিজ্ঞাসা করেছেন, “এই, তুই কি প্রাসেনজার?” আমার জবাব ছিল, “হ্যাঁ, তোর মতই!” আমার মনে হয় এই লাইনে যে সকল ভারতবাসী ভ্রমণ করেছে, তাদের মাঝে আমিই বোধ হয় সর্ব প্রথম অভদ্র এবং স্বাধীন যাত্রী।
আমার ইচ্ছা হল কেবিনে যে ইণ্ডিয়ান ভদ্রলোক এসেছেন তাঁর সংগে একবার দেখা করি এবং কথা বলি। কিন্তু কেবিনে এসে তার দর্শন পেলাম না। আমি স্মোকিং রুমে বসে একটু আরাম করেই বাইরে এসে চায়ের আদেশ দিলাম। চায়ের তখনও সময় হয় নি, তবুও বয় চা এনে হাজির করল এবং বলল, চারটার সময় চায়ের ভাল বন্দোবস্ত হবে। তাকে ধন্যবাদ জানিযে বিদায় দিলাম।
একদল যাত্রী আমারই কাছে ভিড় করে বসে নানা রকমের গল্প-গুজবে মশগুল হয়ে উঠল, কিন্তু আমার তা মোটেই ভাল লাগছিল না। আমার মন যেন ক্রমশই নিরুৎসাহে দমে আসছিল। আমি যদি গতি আঁটা বেনচিটাতে হেলান দিয়ে বসেছিলাম, তাতে প্রচুর স্থান থাকা সত্ত্বেও কেউ আমার কাছে এসে বসছিল না অথচ অন্যান্য আরাম কেদারায় ঠেসাঠেসি করে তারা বসছিল। তার কারণ আর কিছুই নয়, আমার সংগে বসলে ওদের সম্মান থাকবে না।
কেবিনে এসে দেখি ভারতীয় ভদ্রলোকটি মুখ নত করে বসে আছেন। তাঁকে আমার পরিচয় দিলাম। তিনি তাঁর পরিচয় সংক্ষেপে দিয়ে আমার বোঁচকার দিকে দৃষ্টি ফিরালেন এবং বললেন, “এরূপ পুঁটলি নিয়ে বিলাত চলেছেন, এটা দেখে লোকে হাসবে!” আমি তাঁর কথার কোন প্রতিবাদ না করে জিজ্ঞাসা করলাম, “ডাইনিং রুমে আপনি কোন্ দিকে বসে খান?” গম্ভীর হয়ে বললেন–কেবিনে তাঁর খাবার এনে দেওয়া হয়। আমি বললাম, “কেবিন তো শোবার জন্য খাবার জন্য ডাইনিং হল্ রয়েছে, সেখানেই গিয়ে আমরা খেয়ে আসতে পারি।” তারপরই বললাম, “চলুন এক গ্লাস বিয়ার খেয়ে আসি।” ভদ্রলোক দুই চোখ কপালে তুলে বললেন–যান, অপমানিত হয়ে আসুন। ভদ্রলোকের কথার ভাবে বুঝতে পারলা স্মোকিং রুমে গেলেই অপমানিত হতে হবে, তাই তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললাম, যদি কিছু ঘটে তার জন্য আমি দায়ী হব আপনি চলুন। তিনি বিয়ার খেতে রাজি ছিলেন কিন্তু স্মোকিং রুমে যেতে রাজি ছিলেন না, তাও একরকম জোর করেই তাঁকে বিয়ারের দোকানে নিয়ে গিয়েছিলাম। স্মোকিং রুমে গিয়ে দু’গ্লাস বিয়ারের জন্য আদেশ করলাম। বোধ হয় পনের মিনিট পর বিয়ার নিয়ে একজন ইংরেজ ছোক্রা এল। তাকে বিয়ারের দাম বাবদ এক শিলিং দিয়ে আর একটি শিলিং দিলাম বখ্শিস স্বরূপ। অন্যান্য যাত্রীরা তিন পেনীর বেশী কেউ বখশিস দেয়নি সেদিকে আমার লক্ষ্য ছিল। এখনও পৃথিবী টাকার বশ। এক শিলিং বখশিস পেয়ে ইংলিশ বয় আমাদের অনুগত হয়ে পড়ল এবং কোন কিছুর আদেশ দিলেই সর্বাগ্রে আমাদের হুকুমই তামিল করতে লাগল।
আমার কেবিন-সাথীটি হলেন ব্যবসায়ে ধোপা। ত৭ার আয় বৎসরে পাঁচ হাজার পাউ-। তিনিও প্রথম শ্রেণীর টিকেট কিনতে পারেননি। তৃতীয় শ্রেণীর টিকেট কিনতে পেরেছিলেন, আমারই টিকেটের লেজ ধরে। যাহোক, আমাদের মাঝে মোটেই মনের মিল ছিল না–কারণ তিনি ধনী আর আমি দরিদ্র। এই যে শ্রেণীযুদ্ধ, আজ পর্যন্ত কেউ তাড়াতে পারেনি, এড়াতেও পারা যায় না। শ্রেণীযুদ্ধের অবসান হয়েছে রুশিয়ায়, লেনিনের ভালবাসায় এবং ষ্ট্যালিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে। যদিও আমরা দুজনই ইণ্ডিয়ান, দুজনের একই ধর্ম, কিন্তু আমাদের আকাশ-পাতাল ভেদ রয়েছিল। ধনী শতকষ্ট সহ্য করতে রাজি, কিন্তু যার রক্ত শোষণে ধনীর শরীর পুষ্ট হয়েছে, তার কাছে বসতেও রাজি নয়। আমার ধনী বন্ধু বুযারদের লান্ছনা নিঃশব্দে হজম করে তাদের সংগেই মিলামিশা করবার জন্যে আগ্রহান্বিত কিন্তু আমার সংগে কথা বলতেও রাজি নন যদিও আমার চামড়া তাঁরই মত কালো!
বিয়ার খেয়েই যেন তাঁর অনেকটা জ্ঞান হল, তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন স্মোকিংরুমে যেতে কোনদিনই তাঁর সাহস হয়নি। আমি সংগে থাকায় আজ তাঁর সে সৌভাগ্য হয়েছে। তিনি ডারবানে জাহাজে উঠেছিলেন এবং ডি ডেকে তাঁর দুদিন কেটেছিল। আমি তাকে বললাম, পূর্বেও একবার আমি ল-ন দেখেছি এবং সমগ্র ইউরোপ ভ্রমণ করেছি তাই বুয়ারদের দেখে আমার ভয় হয় না। আমার সাহস দেখে সহযাত্রী ভারতীয়টির মনে বেশ আনন্দ হয়েছিল। তিনি আমাকে নাবিকদের সংগে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। নাবিকরা একদিন আমার জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার অনেক কথা শুনার পর অনেকেই আমার বন্ধু হয়েছিল।
সেদিন বিকালে সাতটায় আমরা কেবিনে খানা না আনিয়ে ডাইনিং রুমে ডিনার খেতে গেলাম। আমাদের দুজনের জন্য ডিনার রুমের এক পাশে একটা ছোট টেবিলে খাবারের বন্দোবস্ত হয়েছিল। ওয়েটার অন্য সকলের চেয়ে আমাদের ভালভাবে পরিবেশন করতে লাগল। সেই আপ্যায়ন আমাদের টাকার মহিমায় নয়, কথার দ্বারা, ভাবের আদান-প্রদানের দ্বারা। আমাদের প্রতি ওয়েটারের পক্ষপাতিত্ব অনেকেরই মনে অসহ্য হয়ে উঠলছিল এবং তার জন্য আমাকে জাহাজের কেরানির কাছে কৈফিয়ৎও দিতে হয়েছিল। মনে আমার যাই থাকুক, কৈফিয়ৎটা দিয়েছিলাম একটু ঘুরিয়ে যাতে দুকুল বজায় থাকে। কারণ বাণিজ্যপোতের যে আইন, নৌবিভাগেও একই আইন। বাণিজ্যপোতের বয়দেরও কড়া ডিসিপ্লিন মানতে হয়।
সমুদ্র নীরব নিস্তব্ধ। জাহাজ চলেছে প্রবল বেগে। আমরা তারই মাঝে কখনও ঘুমাচ্ছি, কখনও বেড়াচ্ছি, কখনো বা আপন আপন মনের কথা একে অন্যের কথা বলছি। আমাদের মন সর্বদাই নানা সন্দেহ জালে আচ্ছন্ন ছিল। আগেকার দিনে ধর্মের কথা নিয়ে তর্ক ও আলোচনা হত এবং সেই তর্কবিতর্কের মধ্র দিয়েই মন গড়ে উঠত। এযুগের কথা অন্য রকমের। আগে ছিল মোহম্মদ বুদ্ধ খৃষ্ট এদের কথা। এখন হয় ষ্ট্যালিন হিটলার মুসোলিনা দালাদিয়ের আর চেম্বারলেনের কথা এবং এখনকার মতবাদ হলো ইম্পিরিয়্যালিজম, ফ্যাসিজম, নাজিইজম আর কমিউনিজম। আমরা দুজনেই ছিলাম সকলের দৃষ্টি পথে সকল সময়। আমার ভারতীয সংগীর এসব কোনও মতবাদ নাই তা প্রকাশ করতে গিয়ে একদিন বললেন, তিনি পলিটিক্সের কোন ধার ধারেন না। তাঁর কথা শুনে সকলেই হাসল, তারপর আমার দিকে এজন তাকিযে বলল, “আপনারও বোধহয় একই মত?” আমি তার প্রতিবাদ করে বললাম, যেদিন এই পৃথিবীতে আমার জন্ম হয়েছে সেদিনই আমি পলিটিক্সের আওতায় এসেছি। পলিটিক্স ছাড়া মানুষ কোন মতেই বাঁচতে পারে না। দুজনের মতিগতি দেখে সকলেই নানা মন্তব্য করতে লাগল। আমি ওদের মন্তব্যে মোটেই কান দেইনি। আমি শুধু ভাবতে লাগলাম, এই পৃথিবীতে শরীরের রংএর জন্য যে তারতম্যের সৃষ্টি হয়েছে, ধর্মের গোঁড়ামীতে যে ছোট বড় বলে একটি নকল আভিজাত্যের সৃষ্টি হয়েছে, তার যাতে ধ্বংস হয়, তাই আমি দেখতে চাই। মানুষ সম্পর্কে মানুষের মনের সংকীর্ণতা না ঘুচলে উন্নত সভ্যতার দাবী চলে না।
জাহাজ গোল্ডকোষ্ট পার হবার পরই বুয়ার এবং অন্যান্য ইউরোপীয়ানদের মতিগতি পরিবর্তন হতে লাগল। অনেকেই মন খুলে আমার সংগে কথা বলতে লাগল। কিন্তু আমার বন্ধুটি কোন কথাতেই ছিলেন না। কি করে বড় একটা কাপড় কাচার মেশিন কিনবেন এবং কি করে তার কলকব্জা ঠিক হবে, সেই নিয়ে তাঁর মন পড়ে রয়েছিল।
