আমি সকলের সংগে অবাধে মিলামিশা করতে লাগলাম। ইউরোপীয়ান, বুয়ার সকলেই আমার সংগে নানা কথা বলতে লাগল। তাদের প্রধান জিগগাস্য বিষয় ছিল, মহাত্মা গান্ধীর দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রভাব ও তাঁর কৃতকার্যতা সম্বন্ধে। সেই সংগে সুভাষ ও জওহরলালের কথাও এসে পড়ছিল। আমি অনেক সময় তাদের কাছে রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে যেসকল তীব্র মন্তব্য করতাম, সে কথাগুলি বোধ হয় তাদের মনে বেশ লাগত। আমার চিন্তার ধারা ও কথা শুনে ওরা ভাবত, হয়ত আমি অনেক বই পড়েছি। তাই একজন জিজ্ঞাসা করেছিল আমি কার্মলমার্কস এর বই পড়েছি কিনা। আমি যখন বলতাম কার্লমার্কস এর বই চোখেও দেখিনি তখন তারা অবাক হয়ে যেত। আমি তাদের বুঝিয়ে বলতাম, দেশভম্রণের অভিজ্ঞতাই আমাকে এই দৃষ্টি ভংগী এনে দিয়েছে।
আমি অনেক সময়ই দেশের কথা ভাবতাম। মধ্যবিত্ত লোকের অর্থের অভাব, তাদের পরাধীনতার অনুভূতি, দরিদ্রতার লান্ছনা, তাদের প্রতি ধনীদের উৎপীড়ন এসবের প্রতিকার কিসে হয় তার চিন্তা এখন বোধহয় তাদের মাঝে এসেছে। হরিজনরা কোনদিন মুখ খুলে তাদের দুঃখের কথা কারো কাছে বলেনি। তারা এখন শুধু দুঃখের কথা বলে না, যাতে তাদের দুঃখ মোচন হয় তার দাবীও বোধহয় করে। যে হরিজন একদিন অপরের উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ করত এখন তারা আর উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ করে না। এখন উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ করে তারাই যারা এই অসৎ নিয়মের প্রবর্তন করেছিল। আমি আরও ভাবতাম এখন দেশে আর বোধ হয় আধ্যাত্মিকতার বাচালতা চলে না। এখন বোধ হয় সাধুদের কথায় কেউ কান দেয় না, বোধ হয় এখন দেশে আর জাতিভেদ নাই। আমি ভাবতাম আমি যেন অনেক বৎসর আগে দেশ ছেড়ে এসেছি। কিন্তু সুখের চিন্তা মিলিয়ে যেত যখনই আতলান্তিকের ঢেউ লেগে জাহাজ কেঁপে উঠত।
দেখতে দেখতে পাঁচটা দিন জাহাজে কেটে গেল। বিরাট সমুদ্র আর অন্তহীন আকাশ দেখে মন একঘেয়ে হয়ে উছছিল। রাত এখনও কাটেনি। সিনেমা দেখে অনেকেই স্মোকিংরুমে এসে বসেছিল। কেউ হুইস্কি, কেউ বিয়ারের গ্লাস সামনে রেখে গল্প করছিল। আমিও এক গ্লাস বিয়ারের আদেশ দিয়ে একটা খালি টেবিলে গিয়ে বসেছিলাম। আলাদা বসলাম এই ভেবে যে, এখন গভীর রাত, অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। যদি ওদের টেবিলে গিয়ে বসি আর মদের নেশায় শ্বেতবর্ণাভিমান ওদের জেগে ওঠে, তবে আমাকে লড়তে হবে নিশ্চয়ই কিন্তু এতগুলি লোকের সংগে আমি কোন মতেই পেরে উঠব না।
মিনিট দুই পরই একটি স্কচম্যান এসে আমারই টেবিলের কাছে একখানা ছোট চেয়ার টেনে এনে বসল এবং বলল, আমার কোন অসুবিধা হবে কি? আমি বললাম, “নিশ্চয়ই না!” স্কচ ম্যানটি দক্ষিণ আফ্রিকার বাসিন্দা, ডাচ ভাষা বেশ ভালই জানে। সে ডাচ ভাষায় কথা বলতে আরম্ভ করল। ডাচ আর স্কচ ভাষায় যত মিল আছে, ইংলিশ এবং স্কচ ভাষায় তত মিল নাই। স্কচ লোকটিকে জানিয়ে দিলাম, আমি ডাচ ভাষা মোটেই জানি না এবং এ জীবনে আর ডাচ ভাষা শিখবার বাসনাও রাখি না। আমার কথা শুনে স্কচম্যান বলল, “আপনার কথায় মনে হচ্ছে আপনি প্রবৃটিশ।” আমি বললাম, “হয়ত আপনি ভাবছেন, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসেছি, অনেক বৃটিশের পাল্লায় পড়েছি, তাই আমি প্রবৃটিশ।” স্কটম্যানটি হেসে বলল, “আপনি এখন কোন্ দেশের যাত্রী?” আমি বললাম, “আমেরিকার।” তিনি বললেন, “আমেরিকায় যান, সেখানে গেলে আপনার চোখ খুলবে। দেখবেন সাম্রাজ্যবাদীর তা-ব নৃত্য। দেখবেন ওরা নিগ্রোদের উপর কত অত্যাচার করছে। আমরা মনে হয়, দক্ষিণ আফ্রিকায় ডুয়েল এডমিনিসপ্রেশন থাকায় ভারতীয়দের বেশ ভালই হয়েছে।” কথাটা বুঝলাম এবং তা মেনে নিতেও হল। প্রকাশ্যে তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, “আমার ভ্রান্তি দূর হয়েছে।”
আমাদের আলাপ যখন বেশ জমে উঠেছে এমন সময় একটি সুদর্শন নির্ভীক বালক এসে আমার কাছে দাঁড়াল। ছেলেটি ইংলিশ। তার সোণালী রং-এর চুলগুলি রক্তাভমুখের উপর পড়ে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিল। ছেলেটির বয়স বার-তের বছরের বেশী নয়, কিন্তু এরই মধ্যে তার মুখে কর্মদক্ষতার সুস্পষ্ট পড়েছে। ছেলেটি আমাকে ইংগিত করে ডাকল। তার ইংগিত বুঝতে পেরে তখনই উঠে আসলাম।
প্রথমত আমরা “ডি” ডেকে নেমে জাহাজের সামনের দিকে চললাম। জাহাজ ছোট নয়, দশ মিনিটে আমাদের গন্তব্য স্থানে যাওয়া সম্ভবপর ছিল না। অনেকগুলি সিঁড়ি উঠানামা করে তারপর গন্তব্য স্থানে পৌঁছতে হয়েছিল। আমাদের পথে ছোট ছোট বাতি মিট মিট করে জ্বলছিল। আমার চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ এবং চলতে পারছি না দেখে ছেলেটি আমার হাত ধরে এগিয়ে চলছিল। আমরা একটা বড় কেবিনের দরজায় এসে টোকা দিলাম। দরজা খুলে দিবার পর কেবিনে ঢুকেই দেখি, অন্তত পনচাশ জন লোক বসে আছে এবং আমার অপেক্ষা করছে। স্কচ, ইংলিশ, আইরিশ, ডেনিস, চেক, সব জাতের লোকই তাতে ছিল। সকলের সংগে পরিচয় হল। এরা মজুর আর আমি পর্যটক। এদের যেমন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিন কাটাতে হয়, আমারও অবস্থা তেমনি। এদের এবং আমার মাঝে পার্থক্য হল–এরা বিদ্যা অর্জন করেছে বই পড়ে, আমার যা শিক্ষা যা চোখের দেখা বাস্তব হতে। এরা আমার কাছ থেকে কিছু জানতে চায়, আমিও তাদের কাছ থেকে কিছু জানতে চাই। কলমে অনেক বিষয় বিবৃত করা যায় না, মুখের ভাষায় তা প্রকাশ করা চলে; তাই এরা আমার মুখের কথা শুনতে চেয়েছিল।
জাহাজের মজুরদের সংগে কথার যেন শেষ হচ্ছিল না। তারাও বলছিল আমিও বলছিলাম। উভয়পক্ষে যদি জানারই মতলব থাকে তবে এরূপই হয়ে থাকে। সময় চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত তিনটা হয়েছে। এত রাত্রে ঘুমালে সকালে উঠবার কোন উপায়ই থাকে না। এদিকে নির্দিষ্ট সময়ে খানার টেবিলে যদি না যাওয়া যায় তবে জাহাজের নিয়মমত কারো জন্যে খাবার চাপা দিয়ে রাখা হয় না। তাই কাছে-বসা টেবিল স্টুয়ার্টকে বললাম, “দয়া করে সকাল বেলা উঠিয়ে দিবেন নতুবা সকালে খেতে পাব না।” টেবিল ষ্টুয়ার্ট সম্মতি জানাল। আমি আর তথায বসে থাকলাম না। রুমে এসে দেখি আামর কেবিন-সাথী গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত। তাকে বলার মত অনেক কথা ছিল। আমার ইচ্ছা হচ্ছিল একে উঠিয়ে আজ আমার প্রাণের কথা তার কাছে বলি, কিন্তু ঘুমন্ত মানুষকে জাগাতে নাই জানতাম বলেই তাকে আর ডাকিনি।
