পর্তুগীজদের বাড়িঘর গীর্জা সব ছোট ছোট; পাথরে বাঁধান পথ যেমন হয় মেডিরাতেও ঠিক সেরূপই। মদের দোকানগুলি ইউরোপীয় ধরণে সজ্জিত। বিক্রেতা সকলেই স্ত্রীলোক। মদের দোকানগুলির দিকে তাকিয়ে আমার এই কথাই শুধু বার বার মনে হচ্ছিল যে, একটা জাত আরেকটা জাতকে কিভাবে গ্রাস করে ফেলে। ইউরোপীয় সভ্য জাতগুলির মধ্যে ফরাসী পর্তুগীজ এবং স্প্যানিশ জাত যে-সকল দেশকে অধীনস্থ করেছে এবং তাদের সংগে তারা যেমন সহজে মিশে যেতে পেরেছে অন্য কোন জাত আজ পর্যন্ত তা পারেনি। মদের দোকানের একটি মেয়েকে দেখেই মনে হল এ মেয়েটি নিশ্চয়ই বর্ণসংকর, তার চুলই তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। তৎক্ষণাৎ মনে হল এটা ঠিক করা চাই এই দ্বীপের আদি অধিবাসী নিগ্রো না পর্তুগীজ।
ঐতিহাসিক সংবাদ আমি রাখি না, চোখের দেখা এবং অনুমান আমার এক মাত্র পন্থা। দেখেশুনে যতটুকু অনুমান হল তাতে বুঝলাম এখানকার আদি বাসিন্দা নিগ্রোই ছিল। নিগ্রোদের সংগে শ্বেতকায়গণ শক্তির সাহায্যে বিবাহ সম্বন্ধ স্থাপন করেছে। আবার এমনভাবে সেই সম্বন্ধ স্থির করেছে যে, নিগ্রো আর নাই বললেও চলে, সকলেই বর্ণসংকর ইউরোপীয়ান হয়ে গেছে।
এদের দোকান দেখেই আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি বলে, যেখানে মদ তৈরি হয় সেখানে গেলাম। শ্বেতকায় ম্যানেজার আমাকে সাদর সম্ভাষণ করলেন এবং কয়েক কাপ্ মদের নমুনা দিলেন চেখে দেখবার জন্য! এদের প্রতি আমার দৃষ্টি ছিল না, আমার দৃষ্টি ছিল ম্যানেজার তাঁর বর্ণসংকর কর্মচারীদের প্রতি কেমন ব্যবহার করছেন তার প্রতি। এমন কি, কথা প্রসংগে জিজ্ঞাসা করেও ফেললাম, “প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে কোন বর্ণবৈষম্য আছে কি?” শ্বেতকায় ম্যানেজার বললেন, “এখানে কোনরূপ বর্ণ বৈষম্য নাই।” আমি বললাম, “যদি তাই হয়, তবে জিজ্ঞাসা করব মজুরীর দিক দিয়ে কোনও বর্ণ বৈষম্য আছে কি অর্থাৎ যদি আপনার জায়গায় একজন অর্ধ-পর্তুগীজ কাজ করে, তবে আপনার অনুরূপ মাইনে পাবে কি? দ্বিতীয়ত ওদের এই ধরনের কাজ পেতে কখনও বেগ পেতে হয় কি, অথবা তাদের সেরূপ কাজ হতে বনচিত করা হয় কি?’ পর্তুগীজ ম্যানেজার হেসে বললেন, “সে রকম কিছুই নাই। তবে দরিদ্রের রক্ত শুষে ধনী যে অট্টালিকা তৈরী করে তা থেকে আমরাও বাদ যাই না। পথে ঘাটে চলাফেরা করলেই তা দেখতে পাবেন। আরও দেখবেন দরিদ্রতার জন্য মানুষের জীবনে যে অবনতি আসে, তা হতে আমরাও বাদ যাইনি। ধনীদের দোষনীয় বাসনা বড়ই প্রবল হয়। সেই দুষ্ট বৃত্তিকে দমন করার জন্য আমেরিকা এবং ইউরোপ হতে ধনীরা মেডিরাতে আসে। আজ যে সকল যাত্রী এই জাহাজে করে আসল সকলেই মেডিরা বেড়িয়ে দেখতে আসেনি, তারা এসেছে নানারূপ পাপ বাসনা পূরণ করতে। তাদের পাপবাসনাতে আহুতি দেবার জন্য অনেক যুবক যুবতী তৈরী হয়ে আছে। তাদের সংখ্যা কম নয়।” ম্যানেজারের কথায় মনে এমন একটা ধাক্কা এসে লাগল যা সামলাতে অনেক সময় লেগেছিল। আর কথা হল না, বেড়িয়ে চলে আসলাম। পথে দেখা হল কতকগুলি বুয়ার সেপাইদের সংগে।
বুয়ার সেপাইদের বড়ই আনন্দ। তাদের ভবিষ্যতের চিন্তা নাই তাই দুহাতে খরচ করছে। মাঝে মাঝে উপরওয়ালা অফিসার এদের সাবধান করেও দিচ্ছিল।
এখানে নূতন ধরনের গরুর গাড়ি দেখলাম। এক একটি গাড়িতে ছজন করে লোক বসতে পারে। প্রত্যেকটি গাড়ি দুটা বলদ টানে। এমন পুষ্ট পরিষ্কার বলদ আমাদের দেশে দেখেছি বলে মনে হয় না। গাড়িতে জোতা বলদগুলিকে যারা হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তারা একটা চাবুক দিযে বলদগুলিকে মারবার ভান করছিল মাত্র। লম্বা পাতলা চিক্কণ বাঁশের লাঠির উপরে বাঁধা সূতা আকাশে ঘুরিয়ে যখন ঠাস্ করে শব্দ করে তখনই বলদ হুঁশিয়ার হয়ে চলতে আরম্ভ করে। বলদ একটু পরিশ্রান্ত হলেই যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হয়, তাতে যাত্রার সুবিধা হোক আর অসুবিধা হোক আসে যায় না। বুঝলাম যারা বৃষমাংস ভক্ষণ করে তারা বৃষের সুখ সুবিধার দিকেও চায়, আর যারা বৃষ মাংস খায় না, তারাই বৃষের ল্যাজে সবচেয়ে বেশী মোচড় দেয়।
মেডিরাতে বোধহয় অনেককিছু দেখার ছিল, কিন্তু আমার আর ভাল লাগল না তাই জাহাজে ফিরে এলাম। জাহাজে এক রকমের মেলা বসেছে। নানারূপ পণ্য নিযে ব্যবসায়ীদের ভিড় জমে উঠেছে। দরকষাকষি এমন চলেছে যে যার দাম এক পাউ- বলছে তার দাম এক শিলিং-এ নেমে আসছে। আমাদের দেশেও তা হয়। এই ধরনের দরাদরির জন্য বিদেশীরা আমাদের নিন্দা করে এবং বই লিখে কুৎসা রটায়, কিন্তু এখানে তার উল্টা। এখানে এটাকে আমাদের মধ্যে গণ্য করা হয়। আমাদের দেশে বারবণিতার সংখ্যা নিয়ে দেশবিদেশের লোক নানারূপ গল্প করে। আজ তাদের বারবণিতা তাদেরই ক্রোড়ে এই জাহাজের ডেকের উপর নীল আকাশের নীচে তাদেরই স্বরূপকে উদঘাটিত করছে। এসব বিভৎস কদর্য দৃশ্য দেখতে আমার মোটেই ভাল লাগল না। এদিকে শহরে যে কয় কাপ মদ আমাকে খেতে দেওয়া হয়েছিল তার সবটাই বাহাদুরী করে উদরসাৎ করায় অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। যখন এরূপ অস্বস্তি অনুভব হয় তখন কোন মতেই ঘরের বাইরে যাওয়া অথবা নিজের স্থান পরিত্যাগ করা উচিত নয়। ইউরোপে দেখেছি মাতাল অবস্থায় অনেকেই অনেক কিছু হারিয়ে ফেলে, সেজন্য কেউ দায়ী হয় না, পুশিলও সাহায্য করতে পারে না। তাই কেবিনে যাওয়াই একান্ত কর্তব্য ভেবে কেবিনে প্রবেশ করে নিজের বার্থে গিযে শুয়ে পড়লাম। সাতটার সময় সেদিন ডিনার খাবার বন্দোবস্ত হয়নি। ডিনারের বন্দোবস্ত হয়েছিল রাত বারটায়। নির্দিষ্ট সমযে যখন ডিনারের ঘণ্টি বাজল তখন শরীর ঠিক হয়ে গিয়েছিল। খাবার সমাপ্ত করে নানারূপ গল্প করার সময় শুনলাম আগামী পরশু বিকালের দিকেই আমরা সাউথ্ হামটনে পৌঁছব। এই সংবাদ পরের দিন জাহাজী সংবাদপত্রে বার হল। সংবাদ বার হওয়া মাত্র সকল যাত্রীর মুখেই আনন্দের চিহ্ন ফুটে উঠল। সবাই পেট ভরে মদ থেকে লাগল। তারপর বিকালে হল একটা সভা। সভায় জাহাজের ক্যাপ্টেন সভাপতিত্ব করলেন। সকলেই কিছু কিছু বললেন। আমার বন্ধুটি একদম নীরব থাকাই পছন্দ করলেন। সেজন্য আমাকেই দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতবাসীদের পক্ষ হয়ে এবং খাস ভারতবাসীর পক্ষ হয়েও কথা বলতে হয়েছিল। বলার নির্ধারিত সময় ছিল পাঁচ মিনিট, কিন্তু অর্ধঘণ্টা বলার পর উপসংহারে বললাম, “আর সময় ক্ষয় করে লাভ নাই, ভারতের সুখ-দুঃখের হিসাব ভারতবাসী যদি না করে তবে আর কেউ তার কূলকিনারাও করতে পারবে না, অতএব আমার স্বদেশের এবং স্বদেশবাসী যারা দক্ষিণ আফ্রিকাতে বাস করছেন তাদের দুঃখের কথা বলে এতক্ষণ আপনাদের আনন্দে বাধা দিয়েছি বলে ক্ষমা করবেন।” এই বলেই আমি আমার কথার শেষ করেছিলাম। সভা যখন সমাপ্ত হয়েছিল তখন সভায় আগত প্রত্যেকে এক একজন করে আমার করমর্দন করেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলাম সাদা কথার এখনও মূল্য আছে।
সাউথহামটন অতি কাছে। এর পূর্বেও আমি ল-নে গিয়েছিলাম। সেবারে আমি ছিলাম ক্লান্ত রিক্তহস্ত এবং পেটের ক্ষুধায় জর্জরিত। এবার কিন্তু তা নয়। এবার খেয়ে খেয়ে ডিসপেপসিয়া ধরেছে। পকেটে টাকা আছে। টাকা এবার মনে আনন্দ এনে দিয়েছে। তাই সে আনন্দকে বাড়িয়ে তোলার জন্য ল-ন দেখার একটা ফর্দ করে নিলাম এবং ঠিক করলাম এবার ল-ন প্রাণ ভরে দেখে নিব।
দূর থেকে সাউথ্ হামটনের লাইট হাউসের আলোক রেখা দেখে মন উল্লসিত হয়ে উঠেছিল। আমাদের ও নেটিভদের আনন্দ সমান নয়। তাদের হল মাতৃভূমি আর আমাদের হল বিদেশ।
পিঠ-ঝোলাতে সামান্য জিনিষপত্র চড়িয়ে দিয়ে জাহাজ হতে নেমে পড়লাম। আমরা সবাই গিয়ে বসলাম রেলষ্টেশনের কাষ্টম হাউসে। সেখানে জিনিষপত্র পরীক্ষা হবে। কাষ্টম হাউসে একটি রেঁস্তোরাও ছিল, তাতে সকলে চা পানে ব্যস্ত ছিল। আমিও চায়ের আদেশ দিলাম।
সাউথহামটনে একটা সুন্দর নিয়ম আছে। যেই বিদেশ হতে একটা বড় জাহাজ এল অমনি স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়। আামকেও নেটিভদের সংগে স্পেশাল ট্রেনে ওয়াটারলু ষ্টেশন পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। আমাদের জন্য বসবার স্থানের রিজারভেমন ছিল না বলেই সর্বত্র বসবার অধিকার ছিল। নিষ্টিন্ত মনে একটা কামরাতে ঢুকে পড়লাম। গাড়ি ছাড়ল এবং চলল ল-নের দিকে। ওয়াটারলু ষ্টেশনে নামার পর আমার পরিচিত কালো আদমীদের দ্বারা পরিচালিত ওয়াই এম.সি.এ-তে গিয়ে উঠলাম। এখানে এসে মনে হল দক্ষিণ আফ্রিকার অমানুষিক ‘কালার বারের’ গন্ধ কিছুটা দূর হয়েছে। এখানে তবুও কতকটা স্বাধীনতা আছে। যারা বলেন ইংল-ে কালার বার নাই তারাও কিন্তু সত্য কথা বলেন না। এখানেও কালার বার আছে, তবে দক্ষিণ আফ্রিকার মত নয়। আমেরিকার দিকে আর এক ধাপ এগিয়ে আসছি দেখে মনে বড়ই আনন্দ হয়েছিল।
