আজকের আমেরিকা (১১) –শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

শ্রীরামনাথ বিশ্বাস
শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস লেগে কান দুটা অবশ হয়ে আসছিল। আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল মাঝে মাঝে দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি এসে মাথায় পড়ছিল। তবুও নাবিকের দল সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রাজাকে সম্মান দেখাতে। আমেরিকা, ইতালিয়ান, জার্মান সকলেই টুপি খুলে দাঁড়িয়েছিল। কলেই বলছে, ওই বুঝি রাজার ক্রুজার আসছে। খালি চোখে দৃষ্টি বেশী দূর যায় না। এ আকাশ আমাদের দেশের আকাশ নয়। এ হল বসকে উপসাগরের আকাশের এক অংশ। কখন কিরূপ থাকে, তার কোনই ঠিক নাই। কখনও শান্ত, কখনও গম্ভীর, আর কখনও বা পাগল যে মাতলামি শুর করে। আকাশের নীচের সাগরও সেই রকমই। যা মায়া নাই, শুধু বিরাট তরংগমালা।

কতক্ষণ পর একটা বড় ক্রুজার প্রবল বেগে আমাদেরই জাহাজের কাছ ঘেসে চলে গেল। তীর হতে কামান গর্জে উঠল। তারপর আর একখানা ক্রুজার, তারপর রাজার জাহাজ, তারপর আর একখানা ক্রুজার তীরের মত চলে গেল। আমাদের জাহাজের মাঝিমাল্লা নাবিক সকলেই নমস্কার জানাল। যাত্রীর দল নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। আমি দর্শকমাত্র। কাজেই আমার দিকে কেউ চেয়ে নেই বলেই আমি মনে করছিলাম কিন্তু হঠাৎ দেখলাম, সকলে আমারই দিকে চেয়ে আছে। ভাবলাম যদি এটা কলকাতা হত, তবে আম এত কাছে দাঁড়ানো ত দূরের কথা, হয়ত আমাকে ঘরে বন্ধ করে পুলিশ পাহারায় রাখা হ’ত। আমার জীবনে এরকম ব্যাপার ঘটেছে দুবার। কিন্তু এটা রাজার নিজের দেশে সেজন্যই আমার সে দুর্দ্দশা ঘটেনি। আগামীকাল যে জাতের সংগে শত্রুতা শুরু হবে, সেই জার্মানও যেমন সহজভাবে রাজদর্শন করছে, রাজভক্ত বৃটিশ প্রজাও সেরূপ রাজদর্শন করছে। রাজার জাহাজ চলে গেল; উপকূলে কামানের গর্জন অনেক্ষণ শোনা গেল; আমরা আপন আপন কেবিনে ফিরে এলাম। এবার দুপুরে খাবারের পালা। আমি যে টেবিলে বসেছিলাম, তাতে চারজন হাংগেরীয়ান এবং দুইজন হাংগেরীর ইহুদি বসেছিলেন। এরা কেউ ইংলিশ জানেন না। তারা কৃষক, আমেরিকায় বসবাস করতে যাচ্ছেন। কৃষকের আদর সর্বত্র তাই তাদের সামনে নানারূপ খাদ্যসম্ভার সাজিযে রাখা হয়েছিল। সেই গন্থ আমার কাছে বেশ ভলা লাগছিল বোধহয় কৃষকেরা খাদ্যসম্ভার উৎপাদন করেই সুখী, খাওয়ার দিকে তাদের তেমন মন নাই। তারা ফলমূল আমারই দিকে ঠেলে দিল। বুঝলাম, কৃষকের মন উদার অন্যদের মতন কালা আদমীদের উপর তাদের ঘৃণা নাই। শেষের দিকে মনে হল কৃষকেরা যেন খেয়ে তৃপ্ত হয়নি। একটা কথা মনে হল ওয়েটারকে ডেকে বললাম, “এদের এক গ্লাস করে বিয়ার দিলে ভাল হয়।” “তাই তো; আমারও তাই মনে হয়। তবে বিয়ার দিবার আমর অধিকার নাই।” আমি বললাম, “কথাটা যেন পারসার পর্যন্ত পৌঁছে।”

তৎক্ষণাৎ পারসার এসে উপস্থিত হলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার কোনও অনুসিবধা হচ্ছে কি? আমি তাঁকে হাংগেরি কৃষকদের অসুবিধার কথা জানালাম। বলরাম তাঁদের দেশে আমি অনেক দিন ছিলাম; তাই তাদের খাবার পদ্ধতি আমি জানি বলে কথাটা উত্থাপন করছি। তৎক্ষনাৎ এদের জন্য বিয়ার আনা হল বিয়ার পেয়ে পেট ভরে রুটি আলু মাখন ও সামান্য মাংস চাষারা খেল কাফে তারা খেল না। এমন কি অন্যান্য সুখাদ্যের দিযে চেয়েও দেখল না। তারা সুখী হয়েছে দেখে আমিও সুখী হলাম, খুব আত্মতৃপ্তি বোধ হল। কিন্তু নিজের দেশ হলে কি করতাম, তা বলতে পারি নাই, হয়তো চাষা বলে তাড়িয়েই দিতাম। এ দেশের চাষা আর আমাদের দেশের চাষার প্রভেদ অনেক। ওরা স্বাধীনতা বোঝে, আপনার জাতের সংবাদ রাখে। যে সকল চাষা রাজনীতি বোঝে তারাই হল জাতের মেরুদণ্ড। আমাদের দেশের চাষারা সে রকম নয়, তারা শুধু সেবা করতে জানে, অপরের তাবেদারী করতে জানে, ঋণের দায়ে সর্বহারা হতে জানে। আমাদের দেশের চাষারা সংকটে পড়লে ভগবানকে অগতির গতি মনে করে, এদেশের চাষারা সংকটে পড়লে সংকট-মুক্তির পথ নিজে খোঁজে।

জাহাজের অভিজ্ঞতা অনেক বলেছি; পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন। তবে এই জাহাজে একটা নতুন ব্যাপার ঘটেছিল। শুনেছি কর্পূরতলার হারাজার সেক্রেটারি পারসার হতে আরম্ভ করে সাধারণ নাবিকদের পর্যন্ত নাকি অর্থ বিতরণ করেছিলেন। অনেকে ভেবেছিলেন আমিও হয়ত সেইরকমই অর্থ বিতরণ করব। কিন্তু কেউ বুঝতে পারেন নি যে আমি একজন দরিদ্র ভারতবাসী। গুদামে আবদ্ধ আমার দ্বিচক্র-যান কারও লক্ষ্যপথে আসেনি। এমন কি পারসার মহাশয় পর্যন্ত সেসব সংবাদ রাখতেন না। তাই বোধ হয় মাঝে মাঝে এসে শোনাতেন, অমুকে তাকে এত দিয়েছিল, অমুকের কাছ থেকে এত পেয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, অভিপ্রায় এই যে, যেন আমিও তার কথা বিস্মৃত না হই। নানাভাবে একথা জানাতেও কসুর করেন নি যে, খুচরা পয়সার অভাব থাকবে না, ব্যাংকের চেক থাকলে তাও তিনি ভাংগিয়ে দিতে পারেন। আমি কোনও মহারাজার সেক্রেটারী হব বলেই ছিল বোধ হয় তার কেরণী। পূর্বোক্ত গ্রীক যাত্রীটি সময় সময় এসে আমার সংগে গল্প করতেন। তারই সামনে একদিন পারসার মহাশযের চেক ভাংগানির কথাটা উঠল। তিনি স্পষ্ট ভাষায পারসার মহাশয়কে জানিয়ে দিলেন যে আমি ভারতের একজন সামান্য লোক, আমার কাছ থেকে লম্বা চেক পাবার আশা বৃথা। লোকটি স্তব্ধ হয়ে গেল। একটা পুরা কেবিনে যার থাকবার বন্দোবস্ত হয়েছে, কাপ্তেন এসে যাকে মাঝে মাঝে দর্শন দিয়ে যাচ্ছেন সেই লোক সামান্য হয় কি করে তা বোধ হয় তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না। আমার সত্যিকার পরিচয় পেয়ে পারসার আর আমার ত্রিসীমানায় আসতেন না, কিন্তু কয়লাওয়ালা, তেলওয়ালা, বয়, কুক ওরা আমার কথা শোনবার জন্য, আমার সংগলাভ করবার জন্য প্রায়ই আমার দরজায় হানা দিত। কিন্তু আমি তাতে বিরক্ত না হয়ে সব সময়েই তাদের মনোবানছা পূর্ণ করবার চেষ্টা করতাম। হাজার হোক তারা মজুর। আমি পরাধীন দেশের লোক, দরিদ্র, এবং দলিত, তাই মজুর ও দলিতদের সংগে আমার বন্ধুত্ব হতে বেশী সময় লাগে নি। আমরা পরম আনন্দে দশদিন কাটিয়ে একদিন নিউইয়র্কের দরজার কাছে এসে পড়লাম।

সেই দরজা লোহার। আঘাতেও সেই দরজা সহজে ভাংগে না সেই দরজা মনরো ডকট্রিনের (Monro Doctrine) শৃংখলে আবদ্ধ। তার চাবি ইমিগ্রেশন অফিসারের হাতে। তাঁরই ইচ্ছার উপর সেই লৌহ পিনজরে প্রবেশের অধিকার নির্ভর করে। সেই লৌহদ্বার আমার সামনে আর দুদিন পরেই আসবে, দৈনিক জাহাজী সংবাদপত্র আমাকে সে কথা জানিয়ে দিল। এ সংবাদে অনেকেরই মন ভারাক্রান্ত হল। কেউ কেউ দেদার মদ খেতে শুরু করে দিল। আমি এ সব সুখ-দুঃখের বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম মনরো ডকট্রিনের কথা। যে আদর্শের অনুরোধেই মনরো ডকট্রিনের প্রবর্তন হয়ে থাক না কেন, এর দোহাই দিয়ে এই জাতটার আর্থিক স্বার্থ সাধনই আমার চোখে পড়তে লাগল। মনকে বললাম,–মন ভাল করে যদি বুঝতে চাও তো চোখ বেশ করে খুলে রাখ।

মানুষের মনে উদবিগ্নতা থাকলে তার চিন্তাধারা কমে যায় তাই সকল যাত্রীই ভাবছিল আমেরিকার দ্বার তাদের কাছে খুলবে কি? দুটো দিন আমার আরামেই কেটেছিল। আমার ঠিক বিশ্বাস ছিল, অন্তত কযেক দিন ইমিগ্রেশন বিভাগের ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকতেই হবে। আমি হিন্দু বলে নয়, আমার চামড়া কালো বলে। এক শ্রেণীর আমেরিকান আছে, যারা হিন্দু শব্দটার উচ্চারণেই মোহিত হয়ে যায়। আমি কালো তাই ভাবছিলাম আমাকে হিন্দু বলে গ্রহণ করলেও বেঁচে যাই। কিন্তু তার সম্ভাবনা অতি অল্প। দেখতে দেখতে দুটো দিন কেটে গেল। আজই বিকালবেলা জাহাজ নিউইয়র্ক গিয়ে পৌঁছবে। আমি জাহাজের খালাসী থেকে পারসার এবং পারসার থেকে কাপ্তেন পর্যন্ত সকলের সংগে কথা কয়ে নিয়ে ডেকে গিয়ে বসলাম। উদ্দেশ্য, নিউইয়র্ক নগরীর সামুদ্রিক ট্রাফিক দর্শন।

অনেক জাহাজ বন্দর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার আমরা যেমন বন্দরের দিকে অগ্রসর হচ্ছি তেমনি আরও অনেক জাহাজ বন্দরের দিকে আসছিল। হাতের ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখলাম, দুই ঘণ্টার মধ্যে তেত্রিশটি জাহাজ বেরিয়ে গেল। আর যতদূর দৃষ্টি যায়, গুনে দেখলাম পয়তাল্লিশটা জাহাজ বন্দরের দিকে আসছিল। এত জাহাজের আনাগোনা পৃথিবীর অল্প বন্দরেই হয়। সাউথ হামটন, দোভর তথা ল-ন, সিংগাপুর, ইওকোহামা এবং হামবার্গে প্রায় এই রকম সামুদ্রিক ট্রাফিকের নমুনা দেখা যায় বললে দোষ হবে না। তবু মনে হল নিউইয়র্কের মত সমুদ্র ট্রাফিক আর কোথাও নাই। যারা সঠিক হিসাব নিতে চান, তাঁরা নৌবিভাগের চার্ট দেখবেন। কলকাতার পোর্ট কমিশনারের দয়া না হলে বোম্বাইয়ে লিখলে নিশ্চয়ই চার্ট পাওয়া যাবে।

জাহাজ ক্রমশই নিউইয়র্ক নগরীর কাছে আসতে লাগল। নানা দৃশ্য একটার পর একটা চোখে আসতে লাগল কিন্তু এসব দৃশ্য আমার মনে তেমন দাগ কাটতে পারছিল না, আমি ভাবছিলাম এদেশে গিয়ে দেখতে হবে আমেরিকার ডিমক্র্যাটিক গবর্ণমেণ্টের স্বরূপ কি। বোধ হয় তখন বিকালের সাড়ে সাতটা, চারিদিকে কুয়াশায় অন্ধকার হযে আসছিল, দিনের আলো অতি অল্পই ছিল, দূরের বস্তু কমই দেখা যাচ্ছিল। এমন সময় জাহাজ ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টির’ কাছে এসে গেল। অনেকেই দেখল, আমিও দেখলাম, কিস্তু সে মুর্তি কারও মনের উপর তেমন দাগ কেটেছে বলে মনে হল না কারণ সময়ের পরিবর্তন হযে গেছে। যেদিন এই মুর্তি গড়া হয়েছিল সেদিন ইমিগ্রেসন বিভাগের অস্তিত্ব ছিল না।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.