পথের গল্প ১

গত সাত/আট বছর যাবত গাড়িতে উঠা হয় না, হলেও খুবই কম। সাধারণ হেঁটে অথবা সাইকেলে চলাফেরা করি। বলা যায় সাত/আট বছর যাবত আমি পথের মানুষ। আরো গভিরভাবে বললে জীবনের আট/নয় বছর পর থেকেই পথে। পথে চলাফেরা করার সময় নানারকম মজার মজার গল্প বা মানুষের কথোপকথন কানে আসে। গত এক/দেড় বছর যাবত ধানমন্ডি লেকের ভিতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে অফিসে আসি আবার হেঁটে হেঁটে যাই, শাহবাগ অথবা অন্য কোথাও গেলেও হেঁটেই যাই। বাসা থেকে অফিসে আসাযাওয়ার সময় প্রথম প্রথম রাস্তা দিয়ে আসতাম কিন্তু রাস্তা হাউকাউ বেশি ভাল লাগে না তাই লেকের ভিতর দিয়েই চলাফেরা করি। সেখান থেকে কয়েকটা মজার মজার গল্প। গল্পগুলা খুবই ছোট কারণ হেঁটে আসার সময় যতটুকু কানে আসে কথা ততটুকুই অথবা কারও পাশাপাশি হাঁটার সময় যতটুকু কথা কানে আসে ততটুকু। তাই অনেক কথাই অসম্পূর্ণ মনে হবে।


এক বছর যাবত একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় কিন্তু কোন কথা হয় না। শুধু চোখাচোখি হয়, মাঝে মাঝে হাসি বিনিময় হয়। প্রথম কয়েকদিন বুঝতে পারি নাই যে আমরা একই পথে আসাযাওয়া করি। আমি আসি সে যায়। বিষয়টা বেশ মজার, আমরা কেউ কারও নাম জানি না। কেউ কাউকে জিজ্ঞেসও করি না কেমন আছেন? শুধু একজন আরজনকে দেখলে ছোট্ট একটা হাসি দেই।


দুইজন হাঁটাহাঁটি শেষে বসে গল্প করছে।
প্রথম জন: ভাই ঢাকা শহরে ঘুমানোটা কঠিন।
দ্বিতীয় জন: কেন ভাই?
প্রথম জন: এত শব্দ ঠিক মত ঘুম হয় না।
দ্বিতীয় জন: কি বলেন ভাই? আমার ড্রাইভার সারাদিন ঘুমায়। একটু সুযোগ পেলেই গাড়ি পার্ক করে ঘুমাইয়া যায়। বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে বের হয়ে দেখি ঘুমাইতেছে অথচ গেছি মাত্র পাঁচ মিনিট। ব্যাংকে টাকা জমা দিতে গেছি এসে দেখে ঘুমাইতেছে। কেমনে যে পারে আল্লাহ জানে। আরো সমস্যা হইল হাত দিয়া ঝাকি দিলে উঠে না। নতুন বুদ্ধি বের করছি কলম দিয়া গুতা দেই। গুতা দিলেই উঠে যায়।


দুইজন বয়স্ক মানুষ একসঙ্গে হাঁটাহাঁটি করেন। দুইজন স্বামী-স্ত্রী বুঝা যায়। বয়স আনুমানিক ৫০ এর কম হবে না।
আন্টি: আচ্ছা অমুক সাহেব (নাম মনে নাই) লোকটা কেমন?
আঙ্কেল: লোকটা খাটাইস, কিপ্টার হাড্ডি।
আন্টি: এভাবে বলতেছো কেন? তুমি কতদিন ধরে চেন?
আঙ্কেল: অনেকদিন ধরে চিনি। ওর ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম। ঈদে নাকি ড্রাইভারকে কোন বকশিসও দেয় না। অথচ তার নিজের কারিকারি টাকা।
আন্টি: ও আমাদের পাসের ফ্লাটের অমুক (নাম মনে নাই) আপার মত?
আঙ্কেল: একদম…

ছোট বেলায় একটা গান শুনতাম, ‘স্কুল পলাতক মেয়ে।’ ব্যান্ডের নাম ছিল সম্ভবত ‘নোভা’। সেই গানটা শুনে মনে হতো মেয়েরা আবার স্কুল পালায় নাকি? কিন্তু ধানমন্ডি লেকে গেলে অনেক স্কুল বা কলেজ পলাতক মেয়েদের দেখা যায়। আমার অনেক ভদ্র বন্ধুবান্ধব আছে যাঁরা বলে তাঁরা স্কুল পালিয়েছে। তাঁদের স্কুল পালানোর মানে হইল স্কুলে না গিয়ে বাসায় বসে থাকা। কিন্তু এটা আমার কাছে স্কুল পালানো কখনই মনে হয় নাই। আমার কাছে স্কুল পালানো হইল স্কুল থেকে পালানো এবং বাসা থেকেও পালানো মাথায় দুইটা টেনশন থাকতে হবে একসঙ্গে। বাসার কেউ দেখে ফেললে বিপদ আর স্কুলের কেউ দেখলেও বিপদ। আমি যেদিন প্রথম স্কুল পালাই সেই দিনটা সারাদিন ভয়ে ভয়ে ছিলাম এই বুঝি ধরা খেয়ে গেলাম, সেই গল্প আরেকদিন।

লেকে একটা স্কুল পলাতক গ্রুপ পুরাটাই মেয়েদের গ্রুপ স্কুল পালিয়ে এসেছে। এর মধ্যে একজন একদমই নতুন। জীবনে প্রথম স্কুলে পালিয়েছে। টেনশনে ঘেমে গেছে। বান্ধবীদের সঙ্গে কথা চলছে।

জীবনে প্রথম স্কুল পলাতক মেয়ে: আমি আগেই বলেছিলাম, এইসবের দরকার নাই। এখন বাসার কেউ দেখে ফেললে কি হবে? আর স্কুলের কেউ দেখে ফেললে তো টিসি দিয়া বের করে দিবে।
বান্ধবি: আরে তুই তো নতুন তাই এত ভয় পাইতেছিস কিচ্ছু হবে না। আমরা এর আগে পালাইছি কেউ জানতে পারছে? আর বাসায় জানলে কি হবে একটু মাইর দিবে এর বেশি কিছু বলবে না। আর তুই তো কোন ছেলের সঙ্গে ঘুরতেছিস না। আমরা তো সবাই মেয়ে ভয় নাই। বাসার কেউ দেখলে বলবি আজ হঠাৎ করে ছুটি দিয়ে দিয়েছে তাই একটু লেকে ঘুরতে গেছিলাম। এত ভয় পাইলে হয়?


দুই বন্ধু গ্রাম থেকে এসেছে বোঝা যায়, কথার টান এখনো যায় নাই। কথাবার্তা শুনে মনে হইল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং করতেছে।

প্রথম বন্ধু: আচ্ছা দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াররা ফর্সা। কিন্তু সব সময় শুনে আসতেছি আফরিকার সব মানুষ কালো হয়।
দ্বিতীয় বন্ধু: দূর গাধা দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ সাদাই হয়। আফ্রিকার মানুষ হয় কালো।
প্রথম বন্ধু: আরে আফ্রিকা আর দক্ষিণ আফ্রিকা কি আলাদা নাকি?
দ্বিতীয় বন্ধু: অবশ্যই আলাদা।
প্রথম বন্ধু: তাহলে তুই জানিস না, আফ্রিকা তো মহাদেশ।
দ্বিতীয় বন্ধু: আফ্রিকা মহাদেশ হইলেও দক্ষিণ আফ্রিকা আলাদা, তাই ওদের মানুষ সাদা।
প্রথম বন্ধু: যাহ্ বলদ, মেন্ডেলার নাম শুনছস জীবনে? আর দক্ষিণ আফ্রিকার দলেও তো ইন্টিনি নামে একটা বলার আছে ঐ বেটাও তো কালো।
দ্বিতীয় বন্ধু: আরে ইনটিনিরে আফ্রিকা থাইকা হায়ার কইরা আনছে তুই তো দক্ষিণ আফ্রিকারে চিনস না।

৩১ ভাদ্র ১৪২২

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.