১১ নাম্বার গলিতে নতুন বাসা নেয়ার পর নতুন কিছু বন্ধু পেলাম। এর মধ্যে একজনের নাম হিমেল। হিমেল ছিল সুবোধ বালকের মতো। সব কিছু নিয়ম মতো করতো। নিয়মিত স্কুলে যাওয়া, বিকালে খেলতে আসা আবার ঠিক সন্ধ্যার আগে আগে বাসায় যাওয়া। ছাত্র হিসেবে মোটামুটি। আমরা একই স্কুলে পড়তাম একই শ্রেণিতে, তৃতীয় শ্রেণি।
হিমেলের সঙ্গে দুইটা মজার স্মৃতি আছে। একটা স্কুল পালিয়ে ক্রিকেট খেলা দেখতে যাওয়া। আরেকটা এয়ারপোর্টে বিমান দেখতে যাওয়া। সেই গল্প আরেকদিন। হিমেল একটু সাদাসিধে টাইপের ছিল। আর সাদাসিধে মানেই মদন বা বোকা। আমরা সবাই ওকে মদন বলে ডাকতাম। মদনের সঙ্গে লাল কেন ডাকতাম মনে নাই। এমনিতে ও ফর্সা ছিলো, আর রেগে গেলে অথবা লজ্জা পেলে মুখ লাল হয়ে যেত সেই কারণেই মনে হয় মদনের সঙ্গে লাল ডাকতাম, মদনলাল।
হিমেলে প্রাণপ্রিয় বন্ধু ছিল সজীব। একসময় সজীব চট্টগ্রাম চলে যায়। হিমেল চট্টগ্রাম বেড়াতে গিয়েছিল সজীবের ওখানে। ফিরে এসে আমাদের সঙ্গে পতেঙ্গা বিচের গল্প বলতো, আমি মনে মনে হিংসা করতাম।
হিমেল এক সময় ঠিক করলো তবলা শিখবে। ওর বাবা-মা ভর্তি করিয়ে দিল শিশু একাডেমিতে। প্রতি শনিবার বিকালে ওর মা শিশু একাডেমিতে নিয়ে যেত। বড় তবলাটা হিমেলের হাতে থাকতো আর ছোটটা মার হাতে। আমরা প্রায়ই ওর তবলায় থাপ্পর দিতাম। হিমেলে যেহেতু প্রতি শনিবারে তবলা শিখতে যেত সেহেতু ওর প্রতি শনিবারে দুপুরের পরে স্কুলে যেতে হতো না। টিফিনের পরের ক্লাশগুলা করতে হতো না। প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রেখেছিল। প্রতি শনিবার টিফিনের পর ওকে না পেয়ে একদিন সম্ভবত জসিম উদ্দিন পালোয়ান স্যার হিমেলকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই শনিবারে আসিস না কেন?’ হিমেল উত্তর দিয়ে ছিল তবলা শিখতে যায়। স্যার বলে ছিলেন, ‘তবলা টুকলে কিছু হবে?’ এর পর থেকে ওর নাম রেখে দিল তবলা টুকি। স্যারের মতো আমরা ওকে তবলা টুকি ডাকতাম স্কুলে। কিন্তু এলাকায় ডাকতাম মদন লাল। স্কুলে তবলা টুকি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পিছনে আরেকটা কারণ ছিল। ক্লাশে হিমেল ছিল দুইটা। তাই আলাদা করার জন্য হিমেলের নামটা অনেকদিন তবলা টুকি হিসেবে টিকে ছিল। যদি পরবর্তীতে এই নাম আর টিকে নাই মানে নবম-দশম শ্রেণিতে উঠার পর থেকে।
হিমেল শেষের দিকে আমাদের অবাক করে দিয়ে হিমালয়ের মতো একটা মহান কাজ করে ফেললো। কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিয়ে করে ফেলল। সম্ভবত আমার স্কুল জীবনের বন্ধুদের মধ্যে হিমেলই প্রথম বিয়ে করেছে। যদিও ওর সঙ্গে যোগাযোগ নেই অনেক বছর।
এখনো মাঝে মাঝে বিস্মিত হই আর চিন্তা করি সাদাসিধে হিমেল কিভাবে নিজে নিজে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলেছিল। আমরা ঐ বয়সে কেউই এতো সাহস দেখাতে পারি নাই।
১৯ আশ্বিন ১৪২২