কুয়াকাটা ভ্রমণ বৃত্তান্ত (৪)–মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ

১০

পূর্ণিমায় চাঁদের আলো কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা পূর্ণিমায় জলে না ভিজলে বোঝা বা বুঝিয়ে বলা মুশকিল… এভাবে যে ব্যাটে-বলে মিলে যাবে তা আমরা কি জানতাম… কোন হিসেব করে পঞ্জিকা মিলিয়ে আসিনি তারপরও এখন আমরা চাঁদের আলোয় সৈকতে ভাসছি…

জল-জ্যোৎস্নায় মাখামাখি হয়ে মধ্যরাতে আমরা সৈকতে… পারের নৌকাগুলোর একটায় আশ্রয় আপাতত আমাদের ঘাঁটি… পাশাপাশি বেশকিছু নৌকা পরপর রাখা… নৌকার মালিকপক্ষ এসে বলে গেছে- “থাকলে সারারাইত থাকেন নৌকায়; কিন্তু জুতা খুইল্লা বসেন” আমরা সে আদেশ মাথা পেতে নিয়েছি…

এই ভয়াবহ জ্যোৎস্নায় চাঁদের আলোয় গোসলটা সেরে নিচ্ছি… সমুদ্র উত্তাল হচ্ছে… এখন ভাটা চলছে… সমুদ্র চলে গেছে বহুদূর… আপাতত পা ভিজিয়েই শান্তি নিতে হচ্ছে… সৈকতে এখনো অনেক মানুষ… ২/৩জন তো ফুটবলও খেলছে এই মাঝরাতে… গান ছেড়ে গান গাইছে কেউ কেউ… আমরা অবশ্য গান গাইতে পারি না… তাই শরীফের স্পিকারবক্সে গান বেজে চলছে…

“মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না।
( মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না।
অন্ধ করে রাখে, তোমারে দেখিতে দেয় না। )
ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে
ওহে তুমি যদি বলো এখনি করিব বিষয় -বাসনা বিসর্জন।
( দিব শ্রীচরণে বিষয়– দিব অকাতরে বিষয়–
দিব তোমার লাগি বিষয় -বাসনা বিসর্জন। )”

শরীফের স্পিকারবক্সে সারাক্ষণ উত্তরাধুনিক গান বাজলেও সময়মতো ঠিক ঠিক গান কিভাবে যে বাজে কে জানে… তবে মহুয়ার নেশায় মাথা ঝিম ঝিম করছে… শরীরে নাচের তাল থেকে থেকে উত্থলে উঠছে… নজরুলের একটা গান আছে না-

“মাদলীয়ার তালে তালে
অঙ্গ ওঠে দুলে লো
দোল লাগে শাল পিয়াল বনে
নতুন খোপার ফুলে লো
মহুয়া বনে লুটিয়ে পরে
মাতাল চাঁদের হাসি লো”

যাক সে কথা… আর কয়েকজন থাকলে অবশ্য বার-বি-কিউ করা যেতো… কিন্তু দুজনে বিশেষ জমবে না… সে চিন্তাও বাদ… তারচেয়ে আরেক দফা সমুদ্রে পা ভিজিয়ে আসি… পাপ ধুয়ে পূন্য স্নান নয়… লোনা জলে কিঞ্চিৎ শুদ্ধতা মাত্র… আজ হোটেল বয় ইসমাইল বলেছে- “রাস মেলার সময় নাকি্ এখনে গিজগিজে মানুষ হয়… পা ফেলার জায়গা থাকে না… হোটেল নয় হোটেলের কড়িডরেও মানুষের পা ফেলার জায়গা থাকে না… ভাবছি সে সময় একবার আসতে হবে এখানে… বা ঝুম বৃষ্টির সময়… বৃষ্টিতে সমুদ্র দেখতে অন্যরকম আনন্দ…

এই সফরে শরীফ একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে- “আগে কোথাও গেলে সেটা দেখার জন্য ঝাঁপায়া পড়তাম… সমুদ্রে গেলে ডুবাডুবি… পাহাড়ে গেলে অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া… এখন অবশ্য সেগুলোকে তুচ্ছ মনে হয়… তারচেয়ে স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলতে… মানুষের কথা-জীবনের কথা শুনতে… মানুষের সাথে কাটানো মানে নতুন নতুন গল্পের সন্ধান… প্রতিটি মানুষের প্রতিটি মুর্হুতের গল্পই আলাদা আলাদা রকমের… সেগুলোই আসলে ভ্রমণের প্রাপ্তি…” কথাটা আসলেই অস্বাধারণ… আমারও তাই মনে হয়… শুধু প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ হয়ে ফিরে আসলে কি কোনো ভূমিকে আসলেই চেনা যায়? লালন সাঁইজি তো বলেই গেছেন…

“মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।।
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।”

এই ভ্রমণে বেশকিছু মানুষের গল্প আমরা পেয়েছি… সব গল্প হয়তো বলা হবে না… সব গল্প হয়তো বলা যায় না… তাতে কি কখনো কখনো স্মৃতি হয়ে তারা ঠিকই নাড়া দিবে নিউরনে… এই মানুষগুলোর সাথে আর কখনো দেখা হবে কিনা জানি না… হয়তো হবে না… এরাও হয়তো আমাদের কখনো মনে রাখবে না… প্রকৃতি এসবের ধার ধারে না… প্রকৃতি চলে তার নিজের নিয়মে… সেখানে সে কারো কথা শুনে না… জোয়ার আসছে… সমুদ্র কাছে চলে আসবে… চাঁদের আলো আরো তীব্র হচ্ছে… ভয়াবহ একটা ব্যাপার হচ্ছে… যা লিখে আমার পক্ষে প্রকাশ করা কখনো সম্ভব নয়… অতটা লেখনি এখনো শিখিনি মশাই… যদি সেভাবে লিখতে পারতাম তাহলে তুমি জানতে জল-জ্যোৎস্নার মাখামাখি মানুষকে কতটা স্বচ্ছ করে তোলে… ভেতরের মানুষটাকে টেনে হিচরে বের করে আনে… মানুষের ভেরতের মানুষটাকে যখন মানুষ মুখোমুখি দেখতে পায় তখন কি ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে… কি ভাংচুর ঘটে তা তোমাকে আজ বোঝাতে পারবো না… কোনোদিনই পারবো না… তারচেয়ে বড় জল-জ্যোৎস্নায় গোলস করি আরো কিছুটা সময়…

“চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে
আমরা ভেবে করব কি
ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম
তাকে তোমরা বলবে কি?
ছয় মাসের এক কন্যা ছিল
নয় মাসে তার গর্ভ হলো
এগার মাসে তিনটি সন্তান
কোনটা করবে ফকিরি?
ঘর আছে তার দুয়ার নাই
মানুষ আছে তার বাক্য নাই
কেবা তাহার আহার যোগায়
কে দেয় সন্ধ্যাবাতি?
লালন সাঁই ফকির বলে
মাকে ছুলে মরে ছেলে
এই তিন কথার অর্থ নইলে
তার হবেনা ফকিরি।“

.

১১

ভাই উঠেন উঠেন… যাইবেন না???
পাঁচটা বেজে যাচ্ছে…

শরীফের এমন আকুতি মাখা ডাক শুনে না উঠে পড়লাম না…
মোটে ঘণ্টাখানেক ঘুঁমিয়েছি… তাতে কি… আজ শুয়ে থাকা চলবে না… সূর্যদ্বয় দেখতে যেতে হবে… মিনিট পনের’র মধ্যে রেডি হয়ে আমরা সৈকতে পৌঁছে গেলাম… যদিও সূর্যদ্বয় থেকে সূর্যাস্থই আমার বেশি ভালো লাগে… সূর্যাস্থ’র সাথে মন খারাপের সম্পর্ক আছে… বাঙালী হিসেবে একটু কষ্টবিলাশী না হলে ঠিক মানায় না… প্রচণ্ড আমোদের অনুষ্ঠানেও আমরা উচ্চস্বরে বিরোহের গান বাজাই… আমাদের বেশিভাগ মানুষের পছন্দর গানের তালিকায় শীর্ষেও দেখা যায় বিরহের গান স্থান পেয়ে বসে আছে…

অন্যদিকে ভোর খুব মন ভালো করে দেয়ার একটা ব্যাপার আছে… সকাল সকাল মন ভালো হলে মুশকিল… সারাদিন তাইলে ধেই ধেই করে নাচতে হবে… যাক সে কথা… মটরসাইকেল ড্রাইভার মোজ্জম্মেলের সাথে রফা হয়ে গেলো… সে আমাদের ঘণ্টা চারেক ঘুঁড়ে দেখাবে… উঠে বসলাম তার পেছনে… আজ আমাদের যাত্রা পূর্বদিকে… চর গঙ্গামতী আমাদের প্রথম স্পট… সেখান থেকে সূর্যদ্বয় দেখবো… উঠে বে্েই সাঁই সাঁই করে চলতে শুরু করলো মোজাম্মেলের দুই চাক্কার গাড়ি… আমরা যেনো উড়ে চলছি… বেশ ঠাণ্ড ঠাণ্ডা ভাব… কুয়াশাও আছে কিছুটা… একটা গান আছে না-

“হাওয়ার উপর চলে গাড়ি লাগেনা পেট্রল ডিজেল
মানুষ একটা দুই চাক্কার সাইকেল,
কি চমৎকার গাড়ির মডেল গো চমৎকার গাড়ির মডেল
মানুষ একটা দুই চাক্কার সাইকেল।“

দূরত্ব মাত্র ৮ কিমি… অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমরা… আমাদের আগে দুনীয়ার সব মানুষ যে এসে এখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা ভাবিনি… যাক্ সে কথা… গঙ্গমতীর চরে গিজ গিজে মানুষ… তবে চারপাশে একটা আশ্চর্য নিরবতা… ভোরের আলো ফুটছে… খুব ধীরে জোয়ার আসার গান শোনা যাচ্ছে বহু দূরে…

আমাদের নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার মোজ্জম্মেল দেখি তার ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে ক্যামেরাম্যান হয়ে গেছে… যার তার ছবি তুলে বেড়াচ্ছে… পর্যটকরা নানা ভঙ্গি করছে সে ছবি তুলছে… আমাকেও একবার অনুরোধ করেছিল ছবি তোলার জন্য… সে উৎসাহ আমার কোনো কালেই ছিল না… কি লাভ কালের সাক্ষী হয়ে থেকে… তারচেয়ে হারিয়ে থাকাই ভালো…

আশ্চর্য আভা নিয়ে একসময় সূর্য উঁকি দিলো… হঠাৎই মনটা হু হু করে উঠলো… লাল বৃত্তটা পৃথিবীকে প্রতিদিন এতো সুন্দর করে জাগিয়ে তুলে তাই না??? আশ্চর্য… পায়ের তলায় পানি বাড়ছে… জোয়ার আসছে… কেউ তাতে বিচলিত নয়… প্রকৃতির মুগ্ধতায় সবাই মগ্ন… নব্য দম্পত্তিটা বিচিত্র ভঙ্গিতে ছবি তোলাচ্ছে ক্যামেরাম্যানকে দিয়ে… অনেকেই তা দেখে হাসছে… তাতে তাদের বয়েই গেছে… তারা তাদের মতো আছে… পৃথিবীর সব সুখ আজ তাদের চোখেমুখে ফুঁটে উঠেছে… সাইকেল চালিয়ে একটা গ্রুপ এসেছে… তাদের কারবার অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে একটু পানি বাড়লে তারা সমুদ্র বরাবর সাইকেল চালিয়ে হারিয়ে যাবে দিগন্তরেখায়…

গলা শুকিয়ে আসছে… চারপাশে এতো জল কিন্তু পান করার জল নেই… সাথে করে পানি আনা হয়নি…

“সমুদ্রের কিনারে থেকে
জল বিনে চাতকি মরলো
হায়রে বিধি ওরে বিধি ।।
তোর মনে কি ইহাই ছিল
সমুদ্রের কিনারে থেকে
জল বিনে চাতকি মইলো”

সূর্য উঠতে না উঠতেই গরম বাড়তে শুরু করলো… পাল্লা দিয়ে জোয়ারের পানি… বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না এখানে… তারচেয়ে বড় কথা কোথায় বা বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়? পৃথিবী নিজে যে ভাবে সর্বক্ষণ চলে সেও চায় তার পৃষ্ঠে সবাই চলে বেড়ার… ঘুঁড়ে বেড়াক… এক জায়গায় বেশিক্ষণ কেউ টিকে থাক প্রকৃতি তা চায় না… তাই তো জলের ঝাঁপটায় সে মাঝে মাঝেই উপকূল ভাসিয়ে নিয়ে যায়… সিডর… আইলা শব্দগুলো আমাদের পরিচিত… কিন্তু এর আগেও অনেক আঘাত সহ্য করেছে আমাদের এই দেশের মানুষেরা তা আমরা মনে রাখিনি… সিডর বা আইলাতে বিদেশ থেকে অনেক টাকা এসেছিল… তা ভাগ করে নিতে আমাদের প্রভাবশালীদের মাঝে গণ্ডগল হয়েছিল তার জন্য এই নামগুলো বেশি ছড়িয়ে পরেছিল শহরাঞ্চলে যতটা না দুর্গত মানুষগুলোর মুখ… বুকের ভেতর একটা কান্না ঠুকরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে… প্রকৃতির কাছে এলে কি মানুষ বেশি আবেগি হয়ে উঠে??? নাকি সমুদ্রর লোনা জল বুকের ভেতর কুয়াশার জন্ম দিয়েছে… সেই কুয়াশা চুইয়ে বৃষ্টি নামতে চাইছে??? কে জানে…

“বলি মা তোর চরণ ধরে
ননী চুরি-ই আর করব না
আর আমারে মারিস নে মা
ননীর জন্যে আজ আমারে
মারলি মাগো বেধে ধরে
দয়া নাই মা তোর অন্তরে…এ..
সাল পেতেই গেল জ্বালা
পরে মারে পরের ছেলে
কেদে যেয়ে মাকে বলে
সেই মা জননী নিষ্ঠুর হলে..এ .এ.
কে বোঝে শিশুর বেদনা
আর আমারে মারিস নে মা
ছেড়ে দে মা হাতের বাধন
যাই যে দিকে যায় দুই নয়ন
পরের মাকে ডাকবে লালন
তোর গৃহে আর থাকবে না মাগো
তোর গৃহে আর থাকবে না
আর আমারে মারিস নে মা
বলি মা তোর চরণ ধরে
ননী চুরি-ই আর করব না
মাগো ননী চুরি-ই আর করব না
আর আমারে মারিস নে মা”
জয় গুরু…

.

12183702_969330136438701_3990961566298608956_o

১২

মটর সাইকেলে চলতে চলতেই আলাপ জমে গেলো মোজাম্মেলের সাথে… চর গঙ্গমতীতে সূর্যদ্বয় দেখে… লাল কাঁকড়ার চর পেছনে ফেলে এখন আমরা গ্রামের ভেতর দিয়ে চলেছি রাখাইন পল্লীতে ৩৬ ফুট উঁচু বৌদ্ধ মূর্তি দেখতে… হাওয়ার বেগে চলছে মোজাম্মেলের মটর সাইকেল… পেছনে আমরা… হাসিখুশি যুবক মোজাম্মেল বাংলা… রাখাইন… কিছুটা ইংরেজি… একটু আধটু আরবী পর্যন্ত জানে… গান গাইতে পারে কিনা বলতে কিছুটা লজ্জা পেলেও রুদ্র’র সেই বিখ্যাত গান “ভালো আছি ভালো থেকে আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো” গানটি শুনিয়ে দিলো… আমরাও বেসুরো গলায় তার সাথে গলা মেলালাম… ছুটে চলছি তো চলছিই…

মোটর সাইকেল চালক মোজাম্মেল ভাই। (ছবি: লেখক)
মোটর সাইকেল চালক মোজাম্মেল ভাই। (ছবি: লেখক)

মোজাম্মেল একসময় ছিল মাঝি… কুয়াকাটার সমুদ্রে নৌকা নিয়ে বের হতো মাছ শিকারে… নৌকার তেল… শুকনো খাবার সহ সহযোগীদের নিয়ে বেড়িয়ে পড়তো সৃষ্টিকর্তার ভরসায়… কম্পাস-রেডিও-লাইফ জ্যাকেট এসব কল্পনাও করতে পারতো না… ঋণের টাকায় কেনা জাল দিয়ে মাছ ধরে না ফিরতে পারলেই ছিল বিভিষিকাময় বাস্তবতা… তারপরও নাকি ভালোই চলছিল… সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া নাকি পৃথিবীর অন্য কিছুর সাথে মেলে না… যাক সে কথা… সে ডাকাতেই পাল্লাতেও পরেছিল বেশ কয়েকবার… ডাকাতরা স্বভাবে হয় নিষ্ঠুর… তাদের মনে কোনো মায়া দয়া নেই… ধরা মাছ জাল খাবার এমনকি সময়ে সময়ে ইঞ্জিন পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায়… তবে মোজাম্মেলের নৌকা থেকে ইঞ্জিন নিতে পারেনি… তা নিলে নাকি বাঁচার আর সম্ভবনা থাকে না… একবার সে ঝড়ে পড়েছিল… নৌকা ডুবে যায়… সঙ্গীদের নিয়ে বেশ সাহসীকতার সঙ্গে যে ভেসে ছিল ২৪ ঘণ্টার বেশি সময়… সে এক লোমহর্ষক গল্প… সকলের সমস্ত জামাকাপড় খুলে নৌকার ভেসে থাকা বয়াগুলোকে সবার শরীরে পেচিয়ে নিয়ে ভেসে ছিল তারা… এমন অবস্থায় সাঁতার কাটা বাড়ন… কারণ তাহলে অল্প সময়ে ক্লান্ত হয়ে মানুষ মারা যায়… তারচেয়ে যতটা সময় ভেসে থাকা যায় ততটাই বাঁচার আসা থাকে… একসময় নৌবাহিনীর টহল জাহাজ তাদের দেখতে পেয়ে তুলে নেয় তাদের জাহাজে…

পর্যাপ্ত চিকিৎসা দিয়ে তাদের বাঁচিয়ে তোলে… আর কয়েক ঘণ্টা দেরি হলো তারা কেউই বাঁচতো না সে যাত্রায়… অবশ্য সবাই বাঁচেও নি… বেশ কয়েকজনকে সেখানেই রেখে আসতে হয়েছিল… তারপর আর সমুদ্রে যায়নি মোজাম্মেল… চলে গিয়েছিল ঢাকায়… ঢাকায় বাস চালিয়েছে… হেলপারি করেছে… কাগজও কুড়িয়েছে… বেঁচে থাকার জন্য এহেন কাজ নেই যে সে সময় সে করেনি… তারপর আর ভালো লাগেনি… ফিরে এসেছে কুয়াকাটায়… সিডরের সময় সরকারি সাহায্য পেয়েছিল… তারপর এই মটর সাইকেল কিনে শুরু করলো নতুন এই পেশা…

এখন সে মহাআনন্দে আছে… প্রতিদিন হরেক রকমের মানুষের সাথে আলাপ হয়… বেশিভাগই ভালো মানুষ… কেউ কেউ খারাপ আচরণ করে… তখন মন খারাপ হয়… আবার ভালো মানুষরা যাত্রী হলে… তাদের সাথে কথা হলে মন ভালো হয়ে যায়… সেই বাইক চালায়… ছবি তোলে… এখন পর্যটকদের নিয়েই তার জীবন… তাদেরকে খুশি করে টেকা নেয়… জোর করে না…

মোজাম্মেলকে আমাদের পছন্দ হয়েছে… বেশ ভদ্র যুবক… হয়তো এ শহরের সব বাইকারই মোজাম্মেলের মতো ভদ্র… জানি না সেকথা… সবাই তাদের সাথে অবশ্য ভালোভাবে কথা পর্যন্ত বলে না… বেশিভাগ পর্যটক তো প্রকৃতিক সৌন্দর্যই দেখতে যায়… মানুষওযে প্রকৃতির সন্তান সেটা আমরা ভুলে যাই… স্থানীয়দের সাথে কথা না হলে… আলাপ না হলে… সম্পর্ক তৈরি না হলে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য কি আসলেই চোখে ধরা পড়ে? হয়তো পড়ে কে জানে… তখন মাত্র ভোর সকালে গিয়ে ঠেকেছে… আমরা রাখাইন পল্লীতে… অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছি বিশাল আকারের বৌদ্ধ মূর্তি… কবে কোন শহরে জন্মেছিলে তুমি সিদ্ধার্থ… কোথায় তোমার মূর্তি গড়ে চলছে প্রার্থনা… জানি না বুদ্ধ তোমার মূর্তির দিকে তালাকেই কেনো যেনো পৃথিবীর মহানতম বাণীটি বারবার মনে জেগে উঠে “জগতের সকল প্রাণী সুখি হোক”…

জানিনা কোনোদিন জগতের সকল প্রাণী সুখি হবে কিনা… বৌদ্ধ প্রার্থনা ভেঙে হেসে উঠবে কিনা… মোজাম্মেল আমাদের কথা মনে রাখবে কিনা… এই পথে আর আসা হবে কিনা… যে মানুষগুলো শুধু সেলফী তুলতে এতোদূরে এসেছে তারা এর প্রকৃত সৌন্দর্য বুঝতে পারবে কিনা… আবার রাত আসবে আবার জ্যোৎস্না নামবে… সিদ্ধার্থের মতো একদিন আমিও কি পারবো ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যেতে???

জানি না… সত্যি জানি না…

দয়াল তোমারও লাগিয়া যোগিনী সাজিব
তুমি কোন্বা দেশে রইলারে দয়াল চান
তোমায় না দেখলে বাঁচে না আমার প্রাণ
তোমায় না দেখলে বাঁচে না আমার প্রাণ

তুমি কোন্বা দেশে রইলারে দয়াল চান
দয়াল তোমারও লাগিয়া যোগিনী সাজিব
আমি সঁইপা দিব আমার মন ও প্রাণ
তুমি কোন্বা দেশে রইলারে দয়াল চান

দয়াল তোমারও লাগিয়া দেশে না বৈদেশে
আমি পাইতাছি পিরিতির ফল
তুমি কোন্বা দেশে রইলারে দয়াল চান

যেমন শিমুলের তুলা বাতাসে ওড়ে রে
তুমি সেইমতোন উড়াইলা আমার প্রাণ
তুমি কোন্বা দেশে রইলারে দয়াল চান…

কুয়াকাটা ভ্রমণ বৃত্তান্ত (শেষ পর্ব)–মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.