নাখালপাড়ার রেললাইনটা অনেক কারণে আমার প্রিয় জায়গা। সেখানে নানা রঙ্গের নানা বর্ণের মানুষ দেখা যেত। রেললাইন ঘিরে নানারকম কর্মকা- চলতেই থাকতো। রেললাইনের পাশে শহিদ মিনারে প্রায়ই নানারকম গানবাজনা হতো। আধুনিক-উত্তরাধুনিক, ব্যান্ড থেকে শুরু করে খাজা বাবার ওরছ পর্যন্ত। কেউ কেউ গান গেয়ে টাকা তুলতো, কেউ কেউ গানের মাধ্যমে নানারকম ওষুধও বিক্রি করতো।
কোন এক বৃহস্পতিবার বিকালে শহিদ মিনারের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। একটা জটলা দেখতে পেলাম। চারিদিকে লোকজন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতর থেকে বাদ্যযন্ত্রের শব্দ আসছে। বয়স কম থাকার কারণে লোকজনের চিপাচাপা দিয়া সামনে চলে গেলাম। দেখি চারজন শিল্পী, এর মধ্যে একটি মেয়ে বয়স ১৪/১৫ হবে, সেই গান গাচ্ছে। একজন ঢোল বাজাচ্ছে, একজন কিবোর্ড বাজাচ্ছেন। কিবোর্ডটি অনেক ছোট, খেলনার কিবোর্ডের মতো। আরেকজন দোতরা বাজাচ্ছেন চোখে কালো চশমা। আমি কখনো পথের শিল্পীকে কালো চশমা পরে থাকা অবস্থায় দেখি নাই।
আমি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটির গান শেষ হয়ে গেল। গানের লাইনগুলা ছিল বেশ মজার,
করিমন বাবু আমায় শাড়ি দিতে চায়,
… [নামটা মনে নাই] বাবু আমায় চুড়ি দিতে চায়।
মেয়েটির গানের এই দুই লাইনই মনে আছে। পরের গানটি চশমা পরা লোকটিই শুরু করলেন। গান শুরুর আগে ছোট্ট একটি বক্তৃতা দিলেন। জানতে পারলাম তিনি থাকেন মানিকগঞ্জে, পথে পথে গান গেয়ে বেড়ান। কথাবার্তার পর তিনি তাঁর গান শুরু করলেন। গানের প্রথম কয়েকটা লাইন সঙ্গে সঙ্গে মুখস্থ হয়ে গেল।
আমায় যত দাও হে ব্যাথা
হৃদয়ে রাখিবো গাঁথা
একদিন জানি ব্যাথার হবে অবসান।
এই শিল্পীকে আমি আর খুঁজে পাই নাই। মানে নাখাল পাড়ায় তিনি আর আসেন নাই। অথবা আসলেও আমার চোখে পড়ে নাই। আস্তে আস্তে এক সময় এই শিল্পীর কথা ভুলে গেলাম।
কাজের কারণে ‘কাকে’ ঢোকার পর, এক সময় মাথায় নতুন ভূত ঢুকলো তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ সাইক্লিং করবো। সাইক্লিংয়ের সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলাম মনা ভাইকে। সাইকেল চালানোর সময় দিনাজপুরের দিকে মনা ভাই গুনগুন করে গাইছিলেন, ‘আমায় যত দাও হে ব্যাথা/ হৃদয়ে রাখিবো গাঁথা’। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করে মনে করতে পারলাম এই গান তো আমি ছোটবেলায় শুনেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে মনা ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই এইটা কার গান?’ মনা ভাই তখন শিল্পীর নাম বলতে পারেন নাই। কিন্তু অ্যালবামের নাম বলতে পারছিলেন। নাম ‘একতারে নয়া পুরান’।
সাইক্লিং শেষে ঢাকা ফিরে অ্যালবামের নাম ভুলে গেলাম। কোন এক কারণে বসুন্ধরা সিটিতে গিয়েছি। সিডির দোকান দেখে মনে পড়লো সেই গানের কথা। কিন্তু কোন ভাবেই অ্যালবামের নামটা মনে করতে পারছিলাম না। ফোন দিলাম মনা ভাইকে, নাম জেনে সিডিটা কিনলাম। সিডি কেনার পর জানতে পারলাম শিল্পীর নাম, ‘শাহজাহান মুন্সী’।

একদিন আজিজ মার্কেটে সিডির দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছি। দোকান থেকে শাহজাহান মুন্সীর গান বাজতে শুনলাম। দোকানে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম এটা নতুন অ্যালবাম। অ্যালবামের নাম ‘এক জনা’ বের হয়ে হয়েছে ‘একতার’ থেকে। কিনে নিলাম এই সিডিটিও। দোকানে বাজতেছিল,
আমাকে চিনিতে গিয়ে
জঙ্গলবাসী কয়জনা
আমার মতে আছি এক জনা…
রেললাইনে পাশে দাঁড়িয়ে শোনা যে শিল্পীর গান শুনেছিলাম, সেই শিল্পী আর এই শাহজাহান মুন্সী একই শিল্পী কিনা জানি না। তবে চলার পথে বহু নাম না জানা শিল্পীর গান শুনেছি, যাঁরা যাঁর যাঁর জায়গা থেকে অসাধারণ।