তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। স্কুল পুরাপুরি নরকের মত লাগে। একদমই যেতে ইচ্ছা করে না। বাসা থেকে প্রায়ই জোর করে স্কুলে পাঠায়। কোনদিন যাই কোনদিন যাই না। কোনদিন স্কুল পালাই। আমার স্কুল পালানো শুরু তৃতীয় শ্রেণি থেকেই। স্কুলে যাওয়া নিয়ে বাসায় সবাই আমার প্রতি বিরক্ত আমি নিজেও বাসার সবার প্রতি বিরক্ত।
একদিন বড় ভাই বিরক্ত হয়ে বলে দিলেন আমাকে আর বাসায় রাখবেন না। বড় ভাইয়ের ধারণা অন্য কোথাও আমায় কয়েকদিন রাখলে আমি ঠিক হয়ে যাব। আমাকে বললেন ব্যাগ গুছিয়ে রাখতে আমাকে অন্য কোথাও দিয়ে আসবেন। আমি যেতে রাজি না, তবুও জোর করে আমার ব্যাগ গুছিয়ে রাখলেন। স্কুল ব্যাগে কয়েকটা জামা-কাপড় আর বই। পরদিন সকালে সত্যি সত্যি আমাকে দিয়ে আসবেন। কোথায় দিয়ে আসবেন আমি জানি না, বাসার কেউ জানে না। ভাবলাম আমাকে ভয় দেখাচ্ছে।
কিন্তু সকালে সত্যি সত্যি বড় ভাই আমাকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। আমাকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। আমরা তখন নাখাল পাড়ার নয় নাম্বার গলিতে ৫২০ নাম্বার বাসায় থাকি। বাসা থেকে বের হয়ে প্রথমে রেলগেইট, তারপর রেললাইন ধরে তেজগাঁও স্টেশনের দিকে হাঁটা। আমি ভয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করি না। কারণ বড় ভাইকে ভয় পাই। মনে মনে ধরে নিলাম আমাকে হয়ত গ্রামের বাড়িয়ে পাঠিয়ে দিবে। এইসব চিন্তা করতে করতে তেজগাঁও বস্তির কাছাকাছি যাওয়ার পর ভুল ভাঙ্গল। বস্তির পেছনে একটা সরকারী কোয়ার্টারে নিয়ে গেল। কোয়ার্টারের পেছনে টিনের ঘর। সেখানে দাড়িয়ে বড় ভাই একজনকে ডাকলো রাম ভাই বলে। রাম ভাই বের হয়ে আসলেন। স্বাস্থ্য মোটামুটি ভাল।
আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন ও আপনার এখানে কিছুদিন থাকবে। রাম ভাই বললেন, ‘কোন সমস্যা নাই যতদিন ইচ্ছা থাকবে।’ রাম ভাইয়ের কাছে আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে বড় ভাই বাইরে বের হওয়ার জন্য রওনা দিলেন। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়বে পড়বে ভাব বড় ভাইয়ের ধমক, ‘খবরদার কোন কান্নাকাটি না।’ ঝাড়ি খেয়ে আমি চুপ। বড় ভাই চলে গেলেন। রাম ভাই আমাকে ঘরে নিয়ে গেলেন। এক মহিলার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, ইনি তোমার বউদি।
বাচ্চা একটা ছেলে ঘুম থেকে উঠলো। আমার থেকে ছোটই হবে, বয়স চার কি পাঁচ। নাম জানতে পারলাম কৃষ্ণ। কৃষ্ণের সঙ্গেই প্রথমে কথা হইল। কৃষ্ণ প্রথমে আমাকে দেখে অবাক! কিন্তু কছিুক্ষণ কথাবার্তা বলার পরেই আমাদের মধ্যে বেশ ভাব হয়ে গেল। বউদি আমাদের জন্য নাস্তা আনলেন, আমি কিছুই খেলাম না। কারণ সকালে নাস্তা করেই বের হয়েছি। ঘরে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম। দেয়ালে ঝোলানো উনাদের ছবি আর দেবদেবীর ছবি। এক কোণে ছোট্ট একটা ঘরের মধ্যে প্রতিমা রাখা। কি প্রতিমা ছিল এখন মনে নাই।
আমি এর আগে কখনো কোন হিন্দু ধর্মালম্বী মানুষের বাসায় খাই নাই থাকা তো দূরের কথা। আর আমাকে কেন এখানে বড় ভাই রেখে গেলেন কিছুই বুঝলাম না। বড় ভাইয়ের ইচ্ছা তো আমি শুদ্ধ হই। ঠিক মত পড়ালেখা করি, বাইরে টইটই করে না ঘুরি। কিন্তু এখানে থাকার সঙ্গে আমার শুদ্ধ হওয়ার কি সম্পর্ক মাথায় আসলো না।
কৃষ্ণের সঙ্গে বাইরে বের হলাম। চারদিক সুন্দর, খোলামেলা, সাজানো বাগান। কৃষ্ণের কাছে জানতে পারলাম রাম ভাই এখানেই কাজ করে। আমরা কোয়ার্টারের ভিতরে ঘুরলাম ফিরলাম। কিছুক্ষণ পর এক মেয়ে হাজির, কৃষ্ণকে ঝাড়ি দিয়ে বললো এখানে কি করিস? মা ডাকে। বুঝতে পারলাম কৃষ্ণের বোন। নাম পুষ্প, পুষ্পিতা বা পুষ্পা হবে। অথবা অন্য কোন নাম এখন মনে পড়ছে না। 🙁 এখানে পুষ্পই ধরে নিলাম। বাসায় ফেরার পর আমাদের উপর আদেশ হল গোসল করতে যেতে হবে। পুষ্প মাত্রই স্কুল থেকে ফিরেছে, বই দেখে বুঝতে পারলাম আমার থেকে বছর দুয়েক বড় হবে।
আমরা গোসল শেষে ফিরে আসার পর আমাদের জন্য খাবার দেয়া হল। ডাল, সবজি আর চিংড়ি মাছ, আরেকটা কি মাছ ছিল মনে নাই। তবে আমার জন্য বিশেষ আয়োজন করেছে পরিষ্কার বোঝা গেল। আমি তখন সবজি খেতাম না, কিন্তু আমার পাতে যখন বউদি সবজি দিলেন তখন আর না করতে পারি নাই। নিজের ঘরে না করা যায় কিন্তু অন্যের কিভাবে না করব? ঐ দিন কেন জানি অন্য সব তরকারির চাইতে সবজিটাই বেশি ভাল লাগল। বউদি আমাকে অনেক যত্ন করে খাওয়ালেন। একদম নিজের ছেলের মতই। উনাদের পরিবেশনকৃত থালা আমাকে বেশ আকৃষ্ট করল। আমি এর আগে কখন হিন্দু বাড়িতে খাই নাই, মনে মনে একটা সঙ্কা ছিল কেমন যে হবে। আর এখানে কতদিন থাকতে হবে কে জানে। নানা রকম উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলাম। কিন্তু এখন সবাইকে খুব আপন মনে হল। সকালের মন খারাপ আর রইল না।
বিকালের দিকে বড় ভাই ফিরে আসলেন, আমাকে নেয়ার জন্য। আমি তো মোটামুটি খুশি, যাক থাকতে হবে না। বাসায় যেতে পারব। কিন্তু আমাকে নিয়ে আসছিল অনেকদিন এখানে থাকবো এই কথা বলে। রাম ভাই জিজ্ঞেস করলেন এত তাড়াতাড়ি নিয়ে যাচ্ছে কেন? বড় ভাই উত্তর দিলেন বাসায় আম্মা কান্নাকাটি করছে আমার জন্য। আমাকে বাইরে কোথাও রাখা যাবে না। ফেরার সময় আমার খুব মন খারাপ হচ্ছিল কৃষ্ণের জন্য আর বিশেষ করে বউদির জন্য এতটা যত্ন করে কেউ কাউকে খাওয়াইতে পারে আমার ধারণা ছিল না।
এর পরেও রাম ভাইদের বাসায় কয়েকবার যাওয়া হয়েছে কাজে অকাজে। রাম ভাইরা সবাই একবার আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। বেড়াতে এবং বিদায় নিতেও দুইটাই। বিদায় নেয়ার মূল কারণ উনারা সাভার চলে যাচ্ছেন। সাভার চলে যাওয়ার পর উনাদের সাথে আর কখনও দেখা হয় নাই। কিন্তু বউদির ঐ যত্ন করে খাওয়ানোর ঘটনা আবার ফিরে আসল। এখানে স্থান, কাল, পাত্র সবই আলাদা। শুধু ঘটনা কাছাকাছি এবং প্রধান চরিত্র এক।
বরিশালকে আমি আমার দ্বিতীয় মাতৃভূমি মনে করি। কারণ এক ভ্রমণে একজন মহিলা আমাকে দুপুরে খুব যত্ন করে খাইয়েছিলেন। খাওয়ার পরে বুঝতে পেরেছিলাম সেদিন ঐ মহিলা নিজে না খেয়ে নিজের খাওয়াটা আমায় খাইয়েছিলেন। এটা ছিল আমার জন্য অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা, এমন ঘটনা সবার জীবনে আসে না…
জীবনের বর্তমান এই সময়ে এসে যদি হিশাব করতে বসি তাহলে দেখি এই জীবনে এখন পর্যন্ত বহু মানুষের ভালবাসা পেয়েছি যা অনেকের কাছেই ঈর্শনীয়। যত্ন করে খাওয়ানো প্রতিটা মানুষই আমার মা। যে মানুষগুলোর এত এত ভালবাসা পেয়েছি অনেকেই হারিয়ে গেছে অনেকে হয়ত হারিয়েও যাবে…
.
২৩ চৈত্র ১৪২২