এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা’য় যোগদানের কয়েক সপ্তাহ পরের এক রাতের ঘটনা। কম্পিউটারে গান শুনছি। নিচতলা আর দুই তলা মিলে আমরা দুইজন থাকতাম। আমি উপর তলায় আর নিচ তলায় কচি ভাই। কি এক কাজে হঠাৎ করে কচি ভাই হাজির। কাজের কথার পর জানতে চাইলেন, ‘তুমি কম্পিউটার চালাতে জানো?’ আমি তখন শুধু কম্পিউটার চালু আর বন্ধ করতে পারি। আর পারি গান ছাড়তে। কচি ভাই বললেন সাবধানে চালাইও। তবে কচি ভাইয়ের কথা শুনেই বুঝতে পারলাম আমি কম্পিউটার চালাই তিনি চান না। কিন্তু কচি ভাই কখনো কাউকে না বলতে পারেন না। আর না বললেও এমনভাবে বলেন মনে হয় হ্যাঁ বলছেন। আর না বললেও যাকে বলছেন তার মন খারাপ হওয়ার কোন কারণ নেই।
পরদিন শওকত ভাই ডেকে বললেন, ‘তুমি নাকি প্রায় রাতেই কম্পিউটার ছাড়?’ আমি স্বীকার করলাম। শওকত ভাই বললেন, ‘দেখো এই কম্পিউটারে অফিসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইল, ডকুমেন্ট আছে। এইসব জিনিশপত্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আর তুমি তো ঠিক মতো কম্পিউটার চালাতে পার না। কম্পিউটার নষ্টও হয়ে যেতে পারে। তুমি আর কখনো কম্পিউটার চালাইও না।’ এই কথা শুনে আমার প্রচণ্ড মন খারাপ হল। কেন জানি আত্ম-সম্মানেও লাগলো। (আত্ম-সম্মানে লাগার কোন কারণই ছিল না)
আমার একটা হাতে বানানো গান শোনার জন্য একটা সাউন্ড সিস্টেম ছিল। হাতে বাননো বলতে, একটা স্পিকার, একটা পাওয়ার সাপ্লাই আর সিডি রোম দিয়ে গান শোনার ব্যবস্থা। শওকত ভাইয়ের নিষেধের পর থেকে আমি প্রতি রাতে ঐভাবেই গান শুনতাম। কম্পিউটারে বসতাম না।
অফিসে মাঝে মাঝে রাসেল ভাই আসতেন। কম্পিউটারে কি সব হাবিজাবি কাজ করতেন। রাসেল ভাই তখন গণযোাগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে প্রথম অথবা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কাকে যাঁরা আসতো তাঁরা সবাই ছিল বয়সে অনেক বড়। রাসেল ভাই ছিলেন অপেক্ষাকৃত সবার চাইতে বয়সে ছোট। আর রাসেল ভাইয়ের সাথে এক ধরনের বন্ধুত্বও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। রাসেল ভাইকে একদিন বলে ফেললাম, ‘ভাই কম্পিউটার শিখতে চাই।’ রাসেল ভাইও সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘অবশ্যই শিখবা, শিখে ফেল। এখানে তো কম্পিউটার আছেই।’ রাসেল ভাইকে সব খুলে বললাম। যদি কম্পিউটার নষ্ট করে ফেলি?
রাসেল ভাই হেসে সবকিছু পুরাপুরি উড়াইয়া দিলেন। ‘কম্পিউটার নষ্ট করা কি এত সোজা নাকি? আমি তোমাকে কম্পিউটার দিচ্ছি, তুমি পারলে নষ্ট করো তো?’ তারপর ভালমতো বুঝিয়ে দিলেন, ‘কম্পিউটার আসলে নষ্ট করার কিছু নাই। যেটা হতে পারে তুমি যদি কখনো কোন ফাইল ডিলেট করে দাও তাহলে সমস্যা আছে। তুমি তো সামান্য ইংরেজি জানই, শুধু কোন কিছু ডিলেট করবা না। তাহলেই হলো। তারপরেও তোমাকে আমি কিছু কিছু কাজ দিব তুমি এইগুলা করে দিবা। তাহলে আমার কাজও হবে তোমার শেখাও হবে।’ অফিসের নিচ তলায় একটা পুরানো কম্পিউটার ছিল যেটা সবাই ব্যবহার করতো না। রাসেল ভাই আমাকে সেই কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড বলে দিলেন। আর কাজ দিয়ে দিলেন। আর বলে দিলেন যদি কেউ কিছু বলে যেন উনার কথা বলে দেই।
রাসেল ভাই নিচের কম্পিউটারের কথা বললেও। আমার আকর্ষণ যে কম্পিউটারে বসতে নিষেধ করা হয়েছে সেই কম্পিউটারে বসা। আমি যথারীতি প্রতি রাতেই উপরের কম্পিউটারে বসা শুরু করলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে কম্পিউটার চালু করি আর সব সময় কান খাড়া রাখি যদি নিচ থেকে শব্দ আসে তাহলেই কম্পিউটার বন্ধ করে দিব। উপরের তলার কম্পিউটারের সব চাইতে বড় সমস্যা ছিল ফিলিপ্স কিবোর্ডে বাংলা ছিল না, সবই ইংরেজি। নিচের কম্পিউটারে সারাদিন বাংলা লেখার সময় যা যা মনে থাকতো তাই চেষ্টা করতাম উপরের কম্পিউটারের কিবোর্ডে। এতে আমার সবকিছু দ্রুত মুখস্থ হয়ে গেল।
বিপত্তি লাগলো পরে এসে যখন দেখলাম কম্পিউটার আসলে অনেক বড় কিছু। অনেক অনেক সফটওয়ার। শওকত ভাই প্রায়ই এডোব ইলাস্ট্রেটরে কাজ করেন। আমি উনার পাসে বসে অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে তাঁর পোস্টার ডিজাইন দেখি। জামান ভাইয়ের দ্রুত কম্পোজ করা দেখি আর ভাবি কবে যে এইসব শিখতে পারবো। জামানা ভাইয়ের মতো দ্রুত কম্পোজ করতে পারবো। মাইক্রোসফট অফিস, কুয়ার্ক এক্সপ্রেসের অনেক কাজ রাসেল ভাইয়ের কাছে শিখলাম। শওকত ভাইয়ের কাজ দেখে দেখে সাধারণ ধারণা পেলাম ইলাস্ট্রেটরের। কাজী জাহিদ ভাইয়ের কাছ থেকে ফটোশপের কিছু ধারণা পেয়েছিলাম। উনার কাছ থেকেই প্রাথমিক এক্সপি সেটাপ দেয়াও শিখে নিলাম। কিন্তু পুরাপুরি পারতাম না।
উপরের তলায় এক রুম নিয়ে ‘নিউজনেট’ নামে একটা অনলাইন পত্রিকা চালাতো একজন। সেখানে কাজ করতেন, সোহাগ ভাই। একদিন উনাদের কম্পিউটারের কি একটা ঝামেলা হল। দুইজনে মিলে গেলাম সেটাপ দিতে। সেটাপ দিতে গিয়ে সব ড্রাইভ মুছে ফরমেট দিয়া একটা ড্রাইভ বানাইয়া ফেললাম। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম সেদিন। পরে জানতে পেরেছিলাম সব ফাইলই সিডিতে ব্যাকআপ আছে। ঐদিন ঠিক করলাম আর জীবনেও সেটাপ দিব না। অন্তত সেটাপ না শিখে কোথাও সেটাপ দিতে যাব না।
অফিসে প্রায়ই খালেক ভাই নামে একজন আসতেন। ৬/৭ মাস পর পর এসে কম্পিউটারে সেটাপ দিয়ে ৩০০ টাকা নিয়ে চলে যেতেন। উনার সেটাপ দেয়া দেখতাম মনোযোগ সহকারে। একদিন সাহস করে কাউকে না জানিয়ে অফিসের কম্পিউটার সেটাপ দিয়া দিলাম কোন ঝামেলা ছাড়াই। সেই দিনের আনন্দ ছিল অসাধারণ। এখনও যখন নতুন নতুন কিছু শিখি অদ্ভূত ভাল লাগে। নিজে নিজে শেখার আনন্দটা অন্য রকম, মাঝে মাঝে চিৎকার দিয়ে উঠি কম্পিউটারের কোন সমস্যা সমাধান করতে পারলে। মনে হয় পৃথিবী জয় করে ফেলেছি।
সেই রাতের ঘটনার প্রায় ৫/৬ বছরের পরের ঘটনা। কচি ভাইয়ের বাসার কম্পিউটারে একটা সমস্যা হইছে। ভাইয়া বললেন আমার কম্পিউটারটা ঝামেলা করতেছে তুমি একবার বাসায় এসে ঠিক করে দিয়ে যাইও তো। একদিন ভাইয়ার বাসায় গেলাম। ভাইরাসের কারণে কম্পিউটার অনেক স্লো হয়ে গেছে। নতুন করে সেটাপ দিয়ে দিলাম। কম্পিউটার আগের মতো ফাস্ট হয়ে গেল। ফেরার সময় ভাইয়া ৩০০ টাকা ধরিয়ে দিলেন। এটা রাখ খরচ কইর। বেতনের বাইরের টাকা পেতে মন্দ লাগতো না। কচি ভাই ঐ টাকাটা না দিলেও সমস্যা ছিল না।
১৯ পৌষ ১৪২২
ভাই, আমার বাসার পিসিটাও স্লো হয়ে আছে। ঠিক করে দেবেন? 🙂
অভিজ্ঞতা সংরক্ষণ এবং এর ব্যবহার, মানুষকে মেশিন থেকে আলাদা করে দিয়েছে 🙂
আপনারটা আপনেই ঠিক করতে পারবেন। =D