কেমন আছিস তুই?

সারাদিন বাসায় ঘ্যানঘ্যান করে। পড়তে বস, এইটা কর, ঐটা কর। পড়ালেখা ছাড়া সবই ভাল লাগে। বিশেষ করে স্কুলে যেতে একদম ইচ্ছা করে না। মনে হয় যদি স্কুলে না যেয়ে থাকা যেত! শুধু পরিক্ষা দিতাম, বাসায় বসে পড়তাম। এই কথা বাসায় বলার পর ধারণা হইল ছেলে একদম গেছে। পড়ার জন্য প্রেসার দেয়া দুই গুণ বেড়ে গেল। এমন এক অবস্থা হইল বাসার সবাইকে শত্রু মনে হওয়ার শুরু হইল। মনে হইল এই বাসা আমার না। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার জন্য জোর করা। তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পাড়ি। প্রতিদিন সিদ্ধান্ত নেই একদিন কোথাও না কোথাও চলে যাব। যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে।

একদিন সত্যি সত্যি সকালে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম কাউকে কিছু না বলে। বের হওয়ার পরই কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগতেছিল। কিন্তু কই যামু জানি না। হাঁটা শুরু করলাম, মাথার মধ্যে নানা রকম চিন্তা। একটা ঘোরের মধ্যে হাঁটতে থাকলাম। চিন্তা করতেছিলাম, একদিন বড় হবো, পড়ালেখা করার জন্য কেউ কিছু বলবে না, এত না না শুনতে হবে না। এক সময় ঘোর কাটলো নিজেকে আবিষ্কার করলাম শাহবাগের সামনে। কিভাবে ঐ বয়সে হেঁটে হেঁটে ঐখানে গেলাম বলতে পারবো না। তখন অবশ্য জায়গার নাম জানতাম না, একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম এটা শাহবাগ।

বাসা থেকে যখন বের হই তখন ছিল সকাল দশটার মতো। শাহবাগ যেতে ১২ টা হবে। হেঁটে যেতে যেতে ক্ষুদা লেগে গেছে। পকেটে সাড়ে তিন টাকা আছে। এক দোকান থেকে দেড় টাকা দিয়ে তিনটা নোনতা বিস্কিট খেয়ে নিলাম, সঙ্গে দেড় গ্লাস পানি। তখন পানি টাকা দিয়ে খেতে হতো না ফ্রি খাওয়া যেত। বিস্কিটা খাওয়ার পর একটু ভাল লাগলো। হেঁটে হেঁটে পুরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চক্কর দিলাম। দুইটা জায়গা বেশ ভাল লাগলো, চারুকলা আর শহিদ মিনার। চারুকলায় ঢুকে পুকুর দেখে একটা প্রশ্ন জাগল এই পুকুরে পানি নাই কেন?

চারুকলা এক ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো, এখন নাম মনে নাই কিন্তু মনে আছে উনি নারায়ণগঞ্জের ছিলেন। চেনে না জানে না বলে চলো ক্রিকেট খেলতে যাই। আমিও সঙ্গে সঙ্গে রাজি। কয়েকজন মিলে হাঁটতে হাঁটতে রমনা পার্কে হাজির। সেখানে বিকাল পর্যন্ত খেললাম। তারপর সবাই যাঁর যাঁর মতো বিদায়। সন্ধ্যা হয়ে আসতেছে এখন কি করবো?

লোকজনদের জিজ্ঞেস করে ফার্মগেটের দিকে হাঁটা দিলাম। শাহবাগ গিয়েছি ঠিকই কিন্তু ফার্মগেট চিনি না। এক সময় ফার্মগেট পৌঁছালাম। চিন্তা করতেছিলাম এখন কি করবো? বাসায় ফিরে যাব? গেলে কপালে দুর্গতি আছে। ফার্মগেট এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে এইসব চিন্তা করতেছি এমন সময় দোকারেন মালিক জিজ্ঞেস করল, কাজ করবি?

মাথা নেরে না বলে আবার হাঁটা দিলাম। হেঁটে হেঁটে সংসদ ভবন, সেখান থেকে চন্দ্রিমা উদ্যান। এই রাস্তা সব আমার চেনা। সন্ধ্যার দিকে আবিষ্কার করলাম আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। হাঁটা দিলাম নাখাল পাড়ার দিকে। হেঁটে হেঁটে নাখালপাড়া শহীদ মিনার, সেখানে ভ্যানগাড়ির উপর অনেক্ষণ শুয়ে থাকলাম। এলাকায় ৯ টার দিকে প্রতিদিন বিদ্যুৎ চলে যেত। বিদ্যুৎ চলে গেলে আমরা গলিতে টিলেস্প্রেস খেলতাম। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর গলিতে ঢুকলাম। ঢুকেই বড় বোনের কাছে ধরা খেয়ে গেলাম। তাঁরা সারাদিন আমাকে পথে পথে খুঁজেছে। বিশেষ করে ছোট ভাই আর আপা বেশি চিন্তা করতেছিল। আমাকে পেয়ে আপা কোলে করে একদম বাসায়।

বাসায় যাওয়ার পর আমাকে মাইরের বদলে অনেক আদর যত্ন করা হইল। বলা হইল আর স্কলে যেতে হবে না শুধু বাসায় বসে পড়লেই হবে, শুধু পরিক্ষা দেয়া লাগবে। এতে আমি রাজি। কিন্তু ৪/৫ দিন যাওয়ার পর যেই লাউ সেই কদু। আমার সেই আগের অবস্থা। স্কুলে যেতেই হবে।

এর পর থেকে শুরু হইল আমার জীবনের নতুন অধ্যায় স্কুল পালানো। চতুর্থ শ্রেণির পরে আর কোন ক্লাশেই আমি বছরে ১২/১৫ দিনের বেশি ক্লাশ করি নাই।

.

এখন মাঝে মাঝে পুরনো দিনের কথা চিন্তা করতে করতে নিজেকেই প্রশ্ন করি, ‘কেমন আছিস তুই?’

.

৩০ আশ্বিন ১৪২২

Comments

comments

Comments

  1. স্কুল-পালানোর অভিজ্ঞতা কিংবা সাহস, কোনটাই আমার হয় নি। নিজের শৈশব-কৈশোর কোন ফাঁকতালে কেটে গেছে, টেরই পাই নি। তাই, এখন আমি আমার জন্মকাল হিসেব করি কৈশোরের শেষ থেকে নিয়ে…। 🙂 ভালো লাগলো পড়ে। নিজের ফেলে আসা সময়টুকুতে আরেকবার চোখ রাখার সুযোগ হলো। ভালো থাকুন 🙂

Leave a Reply to নীরব মাহমুদ Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.