
যাঁরা ব্যাচেলার থাকেন তাঁদের কাছে ডিম হল জাতীয় খাবার। আশা করি এটাতে মোটামুটি একমতই হবেন। ডিম রান্না বা ভাজার মত সহজ কাজ আর মনে হয় নাই। জীবনে নিজে একটা ডিম ভাজেন নাই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া নিশ্চয়ই কঠিন হবে। আমাদের এলাকায় মানে সাকিনে ডিমকে বৈদা বলে। অনেক এলাকায় আন্ডা, আরো অন্যান্য এলাকায় নিশ্চয়ই অন্য নামও আছে।
পৃথিবীকে যদি দুইটা শ্রেণিতে ভাগ করি তাহলে ডিম মোটামুটি দুইটা শ্রেণিরই খাবার। উচ্চ শ্রেণিও খায় নিম্ন শ্রেণিও খায়। যদি মধ্যম শ্রেণি নামে আরেকটা শ্রেণি ধরি তাঁরাও খায়। শ্রেণিকে আরো ভাগ করলে নিশ্চয়ই আরো দুইটা করা যাবে, সেদিকে না যাই। উচ্চ শ্রেণিদের মধ্যে এখন একটা জিনিশ দেখা যায়, তাঁরা ডিমে হলুদ অংশটা খায় না। এটাতে নাকি সমস্যা হয়। এটার অবশ্যই ডাক্তারি ব্যাখ্যা আছে। উচ্চ শ্রেণির আরেকটা অংশ আছে মোটা হওয়ার ভয়ে ডিম খায় না। মধ্যম শ্রেণির কিছু কিছু মানুষও ঐ একই কারণে খায় না। কিন্তু নিম্ন শ্রেণিরা এই বিষয়ের ধার ধারে না।
ছোট বেলায় বাসায় নিয়মিত বাজার করতে হত আমার। আমিও আনন্দের সঙ্গেই করতাম। কারণ বাজার করলে দুই/তিনটা মারিং করা যাইত। সেই টাকা দিয়ে ভিডিও গেম মোস্তফা খেলতাম (এখনও বাসায় মাঝে মাঝে কম্পিউটারে খেলি)। যেমন বাসা থেকে যদি বলত দশ টাকার এক ভাগা চিংড়ি মাছ আনতে আমি দামাদামি করে আনতাম আট টাকা দিয়ে। যেদিন আব্বার ব্যবসা একটু খারাপ যেত ঐদিন শুধু ডিম আনতাম।
তখন হাসের ডিম ছিল দশ টাকা হালি মানে দশ টাকায় চারটা ডিম পাওয়া যেত। আরো কম দামে পাওয়ারও একটা বুদ্ধি ছিল। বাসা থেকে সেই কাজই বেশি করা হত। সেটা হল বাজারে ডিম ওয়ালার কাছে ফাটা ডিম পাওয়া যেত সেই ডিম আবার সাত/আট টাকা হালিতে পাওয়া যেত। আম্মার কথা ছিল এই রকম, “ডিম আনার পরে তো ফাটাতেই হবে, শুধু শুধু ভাল ডিম আইনা দুই/তিন টাকা বেশি দেয়ার কি আছে?” এই বিষয়ে আমার আবার চরম আপত্তি ছিল, কারণ ডিম দেয়া হত পলিথিনে। আর পলিথিন দিযে আনলে সেটা বাইরে থেকে দেখা যেত, এটা ছিল আমার জন্য চরম অপমান আর লজ্জার। কারণ বন্ধুরা যদি দেখে তাহলে মান-সম্মান আর থাকবে না। আমিও বিশেষ বুদ্ধি বের করে ফেললাম। ডিম ওয়ালারে কইতাম কালা পলিথিন দেন, তা না হলে নিমুনা। অথবা কাগজের ঠোঙ্গা দেন।
ডিম আনা হত সব সময় চারটা। বাসায় আমরা মানুষ ছিলাম সর্বমোট ছয় জন। আম্মার ডিমের রান্নার হাত ছিল চমৎকার (অবশ্য সবার মার হাতের রান্নাই যার যার কাছে চমৎকার) প্রথমে মশলা দিয়ে ঝোল করা হত, তারপর ঝোলের মধ্যে ডিম ছাইড়া দেওয়া হত। যেহেতু হাসের ডিম ছিল সেহেতু ডিম কিছুটা বড় থাকত। রান্না শেষে ডিম গুলারে একেকটা ডিমরে দুইভাগ করা হত একটা ডিম ছাড়া। আমাদের সবাইকে অর্ধেক ডিম দেওয়া হত আর আব্বাকে দেয়া হত একটা ডিম। আমি সব সময় এক দেড় প্লেট ভাত খেতাম ঝোল দিয়ে। আর ডিমটা খেতাম সবার শেষে আর চিন্তা করতাম কবে যে একটা আস্ত ডিম খেতে পারব। সব সময় যে অর্ধেক খেতাম তা না মাঝে মাঝেই আস্ত ডিম খাওয়ার সৌভাগ্য হত। কিন্তু আমি চাইতাম সবসময় আস্ত ডিম খেতে।
আস্ত ডিম খাওয়ার সৌভাগ্য হইছে মা মারা যাওয়ার পরে। আম্মা মারা যাওয়ার পর যখন আব্বা চলে গেল তখন আমরা দুই ভাই একসঙ্গে থাকতাম। নিজেরা রান্না করার সময় সব সময়ই ডিম রান্না করে খেতাম। তারপর কাজের খাতিরে এ্যালিফ্যান্ট রোডে আসলাম। তখন থেকে মোটামুটি আমার জাতীয় খাবার ডিম। আলু ভর্তা, ডাল আর ডিম। এই তিনটা আমার প্রিয় খাবারও বটে। যখন সারাদিন কাজের শেষে বাসায় যেয়ে রান্না করতে ইচ্ছা করে না তখনও কোন রকমে চাল শেদ্ধ করে একটা ডিম ভেজে খাই, এর চাইতে সহজ খাওয়া আর কি হতে পারে?
এতদিনে ডিমের দাম অনেক বেড়েছে, বেড়েছে আমার ডিম খাওয়াও। ডিম না থাকলে কি যে হত আমাদের…
আমার এই লেখা সেইসব মানুষদের জন্য যাঁরা প্রতিদিন রাতে বাসায় ফিরে একটা ডিম ভেজে ভাত খান তাঁদের জন্য।
আণ্ডা কা ফাণ্ডা! :-p
সুন্দর লেখা । ধন্যবাদ ।
আমিও আছি এই শ্রেণীতে