হাতে যখন প্রচুর কাজ থাকে তখন প্রায়ই কাজ করতে ইচ্ছা করে না। অন্য কিছু লিখতে ইচ্ছা করে অথবা অকাজ করতে ইচ্ছা করে। কাজ করতে ইচ্ছা করতেছে না তাই লিখতে বসলাম। আরেকটা কারণ আছে সেটা শেষ লাইনে উল্লেখ করতেছি।
কয়েক বছর আগে আমি সেইফে কাজ করতাম। করতাম বললে ভুল হবে এখনো করি ভলেন্টিয়ারি সুযোগ পেলেই চলে যাই। তখন করতাম প্রফেশনালী। ‘সেইফ’ মানে ‘সেইফটি অ্যাসিস্টেন্স ফর ইমারজেন্সিস’। সেইফ মূলত বিভিন্ন ডিজাস্টার বা জরুরি আপদকালীন বিষয় নিয়ে কাজ করতেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্জার স্পোর্টস নিয়েও কাজ করতো। আমি ঢুকে প্রথমেই যে কাজটা পেয়েছিলাম সেটা ছিল সম্ভবত একটা ম্যারাথনের। নাম ছিল ‘রান ফর দ্যা ওশান’। পাশাপাশি মেরিনড্রাইভ ধরে আমরা সাইক্লিংও করেছিলাম। এই কাজগুলা ছাড়াও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয় নিয়া কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যেমন: নিরপদ পানি, রানা প্লাজা, বন্যায় জরুরি সেবা দেয়া ইত্যাদি।
এমন একটা কাজে যেতে হয়েছিল নুন খাওয়া নামে একটা জায়গায়। সেইফ থেকে প্রথকে একটা দল চলে গিয়েছিল আগেই। মশিউর ভাই, শাওন ভাই, নূর ভাইসহ আরো দুয়েকজন। সেই দলের একটা অংশ ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন দ্বিতীয় দলে আমার যাওয়ার দায়িত্ব পড়লো। শাওন ভাই যখন ফোনে বলছিলেন তখন একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম নুন খাওয়া নামে আবার একটা জায়গা আছে, কি আশ্চর্য!
দ্বিতীয় দলে আমরা ঢাকা থেকে গিয়েছিলাম আমি, নারায়ণগঞ্জ থেকে মুসা ভাই। মুসা ভাইয়ের সেটাই প্রথম পরিচয়। আর ডাক্তার রাজ্জাক। সেখানে দুইটা বিষয়ে কাজ হবে একটা হইল বন্যার পরে পানি চলে যাওয়ার পরে টিউবওয়েলগুলা খুবই খারাপ অবস্থা থাকে সেগুলা ঠিকঠাক করে মানুষ যাতে খেতে পারে তেমন উপযোগী করে দেয়া। আরেকটা হইল মেডিকেল সাপোর্ট দেয়া। সেই কারণেই রাজ্জাক ভাইকে নিয়ে যাওয়া। সেইফে ঢুকে দুইজন ডাক্তারের কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। একজন এই ডাক্তার রাজ্জাক ভাই আরেকজন ডাক্তার জসিম। এঁরা এত আন্তরিকভাবে কাজ করতে পারেন যা বলার মতো না। কিন্তু তাঁরা সেইফ থেকে ঐভাবে কোন সম্মানী নিতেন না বা পেতেন না। শুধু সেবা দেয়ার জন্যই প্রতিটা প্রোগ্রামে নিরলসভাবে ঐসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করতেন।
আমরা যেসব জায়গায় কাজ করতে যেতাম সেখানে থাকা-খাওয়ার কোন ভাল ব্যবস্থা থাকতো না। ইউনিয়ন পরিষদে কম্বল বিছিয়ে ঘুমাতাম অথবা তাঁবুতে কিংবা স্লিপিং ব্যাগে ঘুমাতাম। কাজটা কষ্টের হলেও কষ্ট মনে হতো না। আনন্দের সঙ্গে কাজ করতাম। সত্যি কথা বলতে মানুষের জন্য কাজ করার আনন্দ সব সময়ই অন্য রকম। এই কাজগুলা সব সময় ইনজয় করতাম। কিন্তু অন্যান্য কাজগুলাতে সত্যি কথা বলতে খুব বেশি আনন্দ পেতাম না। যেমন প্রস্তুতির শেষে কোন প্রোগ্রামই আমার ভাল লাগতো না। শুদ্ধমাত্র পেশাগত দায়িত্বের জন্য কাজগুলা করতে হতো। কিন্তু প্রোগ্রামের আগে রেকি করার কাজগুলা খুবই ভাল লাগতো। সত্যি কথা বলতে কোন কিছুর সৃষ্টির পেছনের কাজটার আনন্দটাই আসল। সৃষ্টির পরে আর কেন জানি খুব একটা ভাল লাগে না।
আমরা যথারীতি তিনজনে রওনা দিয়ে কুরিগ্রাম পৌঁছালাম। সেখান থেকে অটোতে তিনজন মিলে নুন খাওয়ায় রওনা দিলাম, নুন খাওয়াটা ভুরুঙ্গামারীর কাছাকাছি একটা জায়গায়। সঙ্গে ফাস্ট এইড বক্স, বেশ কয়েক কার্টুন ঔষধ। প্রথমেই গিয়ে উঠলাম ইউনিয়ন পরিষদের একটা বিল্ডিংয়ে সেখানে নূর ভাইরা ঘুমাচ্ছেন, সঙ্গে বগুড়া থেকে আগত কয়েকজন ভলেন্টিয়ার। পাশাপাশি স্থানীয় কিছু কর্মঠ ছেলে আমাদের সঙ্গে কাজ করতো। আমরা সেখানে কয়েকদিন কাজ করেছিলাম। নৌকা ছাড়া কোথাও যাওয়ার ব্যবস্থা নাই। অনেক জায়গা হাঁটু পানি পার হয়ে যেতে হয়। এর মধ্যে কয়েকটা স্পট ঠিক করে রেখেছেন নূর ভাইরা আগেই। যেখানে আমাদের মেডিকেল ক্যাম্প করবো।
প্রতিদিন সকালে বের হতাম বিকালে ফিরতাম। এমনই একদিন দ্বিতীয় ক্যাম্প করেছি একটা জায়গায় সেখানে এক চাচা আসছেন নিজেকে দেখাতে। আমাদের রাজ্জাক ভাই পরিক্ষানীরিক্ষা করে সবাইকে ঔষধ দিচ্ছিলেন। চাচা বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘আপনে কিসের ডাক্তার? ইনজেকশন দেন না?’ আমরা সবাই চমৎকৃত হলাম। রাজ্জাক ভাই বললেন বিকালে বাজারে ইউনিয়ন অফিসে আইসেন ইনজেকশন দিয়া দিব। চাচা এই কথা শুনে চলে গেলেন। আমরা কাজ করে বিকালবেলা ফিরে আসলাম আমাদের বেসক্যাম্পে। ইফতারের পর পর সেই চাচা সত্যি সত্যি হাজির। তিনি ইনজেকশন নিবেনই। রাজ্জাক ভাইও কম যান না, কার্টুন থেকে রোলেক বের করে চাচার হাতে পুশ করে দিলেন। চাচা খুশি মনে ফিরে গেলেন। এই ধরণের নানা রকম মজার মজার ঘটনা ঘটতো।
সেখানে কাজ করে ফেরার সময় আমরা সবাই কুড়িগ্রাম না ফিরে চলে আসলাম ভুরুঙ্গামারী। ইচ্ছা বোর্ডার সাইটটা দেখবো। আর ভুরুঙ্গমারী থেকে সরাসরি ঢাকার বাস আছে তাই আমাদের সুবিধাই হবে। আমরা সব সময়ই এই কাজটা করতাম কাজ শেষে আশেপাশে একটু ঘুরাফেরা করতাম। আর মশিউর ভাইও যেহেতু আমাদের মতোই ঘুরাফেরার মানুষ সেহেতু এই বিষয়ে তাঁর সব সময়ই সায় ছিল। আর নিজে থাকলেও এই বিষয়ে কখনো কার্পন্য করতেন না।
ভুরুঙ্গামারী ফিরে প্রথমেই আমরা বাসের টিকেট কেটে নিলাম। তারপর হোটেলের রুম ভাড়া করলাম জিনিশপত্র রাখার জন্য। ভুরুঙ্গমারীর দুই দিকের বর্ডার সাইট দর্শন করে সন্ধ্যার দিকে দোকানে ঢুকলাম ইফতার করার জন্য। সেখানে দেখা গেল সবাই ইফতারে ভাত খায়। এই বিষয়গুলা আমাদের কাছে খুব একটা আহামরি কিছু না। কিন্তু সঙ্গে থাকা মুসা ভাই কিছুতেই ভাত খাবেন না। তাঁর মাথাতেই আসলো না ইফতারে কেউ ভাত খেতে পারে! তাঁর মাথায় সেট হয়ে গিয়েছিল ইফতার মানেই ছোলা, পিয়াজু, আলুর চপ, বেগুনী, জিলাপি নানারকম মুখরোচক খাবার।
আমরা হয়তো অনেকেই জানি না। দেশের অনেক মানুষ শুধু ভাত খেয়ে ইফতার করে। তাঁদের কাছে ইফতারটা খুব একটা বিলাসিতা করে খাওয়া না। অথবা আমরা যাঁরা এভাবে ইফতার করি সেই সামর্থ্য অনেকেরই নাই। সেই দিন সবাই মিলে আলুর ভর্তার আর কি কি তরকারী দিয়ে যেন মাটির মানুষগুলার সঙ্গে ইফতার করেছিলাম। অসাধারণ মুহূর্তগুলো আমার সব সময় মনে থাকে।
এই লেখার আরেকটা কারণ আছে। অনেকদিন পরে আজ ইফতারের সময় ভাত খাব। ভাত রান্না হতে হতে এই লেখাটা লিখে ফেললাম।
৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৫
ছবি: সেইফ।


শরিফ ভাই ভালোই লিখেছেন,ঐ প্রোগ্রাম টা মিস করছি, অনেক দিন ধরে কোনো প্রোগ্রাম এ জাইনা, জাই তে খুব ইচ্ছা করছে
অনেকদিন হইল আপনার সঙ্গে দেখা হয় নাই ভাই। 🙁