শেখ সিরাজাম মুনির

ছবি: মেহেরুন ফারুক
ছবি: মেহেরুন ফারুক

‘শরীফ ভাই কেমন আছেন? অনেক দিন দেখা হয় না।’ মুনির ভাইয়ের সঙ্গে সব সময় ফেসবুকের ক্ষুদে বার্তায় কথোপকথন শুরু হতো এভাবেই। এই মানুষটা যতদিনই ফেসবুকে কথা বলতেন কোনদিন আমার নামের বানান ভুল করেন নাই। অনেকেই আমার নামের বানান ইংরেজিতে লেখার সময় লিখতেন, ‘Sorif’ অথবা ‘Sarif’। কিন্তু তিনি যতবার আমার নাম লিখেছেন ততবারই সঠিক বানানে লিখেছেন।

কিন্তু আমরা তাঁর নামের বানান সঠিক লিখতে পারি নাই। টিওবির প্রথম প্রকাশনা ‘ভ্রমণ কথামালা ১’ এ তার নাম লিখা হয়েছিল ‘শেখ সেরাজুম মুনির’। কিন্তু তাঁর নামের বানান হবে ‘শেখ সিরাজাম মুনির’। নামের বানান ভুল লেখা হয়েছে সেটা তিনি কোনদিন বলেন নাই আমাকে। কিন্তু ভুল বানানে নাম লেখার দায় অবশ্যই আমার উপর বর্তায় অথবা আমাদের উপর। উনার নামের সঠিক বানান পরে জানতে পেরেছিলাম ‘চাকা’ পত্রিকায় উনার একটা ছবি ব্যবহার করার সময়। উনার কাছ থেকে ছবি নেয়ার পরে বললাম, ‘ভাই এইবার আপনার নামের বানান কন’। উনি বাংলা লিখে দিলেন, ‘শেখ সিরাজাম মুনির’। আমারা জিজ্ঞেস করলাম, ‘সিরাজাম?’ নাকি ‘সিরাজুম?’ উনি উত্তরে বললেন, সিরাজাম।

‘তার মানে আপনার নামের বানান টিওবির বইতে ভুল ছাপা হইছিল?’
‘জি 🙁 ’
সঙ্গে সঙ্গেই হাসিমুখ দিয়ে বললেন, ‘ব্যাপার না’।

New Picture (2)

মুনির ভাইয়ের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথাবার্তার মধ্যে তিনি প্রায়ই আমার কাজে উৎসাহ দিতেন। তাঁর ‘চাকা’ পত্রিকা নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ ছিল। দেখা হইলেই বলতেন, ‘নতুন সংখ্যা বের হইছে? বের হইলেই কিন্তু আমাকে এক কপি দিবেন।’ তিনি মাঝে মাঝে ‘চাকা’র জন্য চাঁদাও দিতেন।

আমার অনেক কাজের মধ্যে ফেসবুকে বাংলায় তারিখ দেয়াটা তাঁর খুব পছন্দের ছিল। আমি বেশ কয়েকদিন বাংলায় তারিখ না দেয়ায় ম্যাসেজ করে বলেছিলেন, ‘ভাই বাংলা মাসের রিমাইন্ডার দেন না কেন?’

New Picture (1)

মুনির ভাইয়ের সঙ্গে কিছুদিন পর পরই ছবির হাটে দেখা হত। দেখা হলেই তাঁর প্রধান কথা ছিল, ‘বই কতদূর?’ দ্বিতীয় ভ্রমণ কথামালার সময় কথায় কথায় বলতেছিলেন, ‘আপনে থাকাতে দুইটা বই বের হয়ে যাচ্ছে। চালাইয়া যান ভাই শুধু আপনে থাকলেই হবে আর কাউরে লাগবো না, কেমনে একলা এত কাজ করেন?’
‘আরে আমি কিছুই করি না সবাই করে, একলা এত কাজ করা যায় নাকি মিয়া? আমি শুধু সঙ্গে থাকি।’

মুনির ভাইয়ের সাথে শেষ কথা হইল ফোনে। পিক৬৯ এ টাকা দেয়ার জন্য আসছিলেন। ফোনে বলতেছিলাম ভাই আপনার কিন্তু বই নেয়ার কথা। ‘ভ্রমণ কথামালা ১’ বিভিন্ন পাঠাগারে ফ্রি দিবেন বলছিলেন। উনি বলেছিলেন ভাই বান্দরবার যাচ্ছি ফিরে এসে নিয়ে যাব। আপনে আর কখনও আসবেন না জানি।

মুনির ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম ভালোমতো দেখা বা সখ্যতা হয় নারায়ণগঞ্জে। নারায়নগঞ্জ গিয়েছিলাম পিক৬৯ এর জন্য সাইক্লিংয়ের টি-শার্ট কিনতে। সেখানে সালেহীন ভাই পরিচয় করিয়ে দেন। সালেহীন ভাই পরিচয় করিয়ে দিয়ে অফিসে চলে যান মুনির ভাই আমাকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন। কথায় কথায় বলতেছিলেন আপনার সম্বন্ধে কিন্তু আমি অনেক কিছু জানি। আপনে একলা একলা ৬৪ জেলা ঘুরছেন। সারাদেশ হাঁটছেনও। আমিও হাসতে হাসতে বলতেছিলাম আমি কিন্তু আপনার সম্বন্ধে কিছুই জানি না। আমরা নদীর তীর ধরে হাঁটতেছিলাম আর কথা বলতেছিলাম। হঠাৎ কি মনে করে বললেন, ‘শরীফ ভাই আপনাকে আমার অনেক পছন্দ হইছে।’ আমি স্বভাবসুলভ হাসি দিয়েছিলাম। তিনি বলতেছিলেন, আমিও একা একা বাংলাদেশের অনেক জায়গায় হেঁটে বেড়িয়েছি, কিন্তু আপনার মতো না। তবে ভাই একলা একলা হাঁটার মধ্যে কিন্তু একটা আনন্দ আছে। আমার মাঝে মাঝে ভালো লাগে একলা একলা হাঁটতে।’

সত্যিই ভাই একলা হাঁটার মধ্যে অনেক আনন্দ আছে। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলা যায় কেউ থাকলে তা বলা যায় না। নিজের সঙ্গে ছাড়াও একা একা থাকলে অনেকের সঙ্গে কথা বলা যায়।

আমি যখন একলা একলা হাঁটবো মাঝে মাঝে আপনার সঙ্গে কথা বলবো…

New Picture (3)

.

.

 

মুনির ভাই আজ কিন্তু ২৪ আষাঢ় ১৪২২…

 

Comments

comments

Comments

  1. মানুষের চলে যাওয়াটা এতো বেশি রূঢ় হয় কেনো…:( হিসেবের ভেতরে থাকা মানুষগুলোকেই কেনো সবসময় আগে চলে যেতে হবে…:( যদিও জানি, সৃষ্টিকর্তার নির্ধারিত সময়েই সবাই চলে যায়। তবুও আমাদের মনে হয়, আর কিছুদিন থেকে গেলেইতো হতো…। মুনির ভাই যেখানেই হোক ভালো থাকবেন। ঘুরে বেড়াবেন হয়তো সেখানেও..। হয়তো এমন ট্রেকিংও করে বেড়াবেন ম্যালেরিয়াশূন্য কোন স্বর্গীয় পাহাড়ে..। জানি না কী করবেন। শুধু জানি, মুনির ভাই আর ফিরবেন না। ভালো থাকুন 🙁

Leave a Reply to Nirob Mahmud Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.