৬৪ জেলায় যা দেখেছি–১০

36675_1469045296008_6516117_n

১০ মার্চ (কলমাকান্দা থেকে নেত্রকোনা হয়ে ময়মনসিংহ)

আজকে আমার উদ্দেশ্য নেত্রকোনা হয়ে ময়মনসিংহ পৌঁছানো। নেত্রকোনা শহরে পৌঁছানোর পথে দুইজন মহিলা সাইক্লিস্ট চোখে পড়লো। পোশাক-আশাক দেখে মনে হলো কোন এনজিওতে কাজ করেন। একজন মহিলাকে দেখলাম মোটর সাইকেলও চালাচ্ছেন তিনিও এনজিও কর্মি। মহিলারা সাইকেল চালাচ্ছে এটা অবশ্যই অবাক করার বিষয়। বিশেষ করে আমার কাছে।

ঢাকাতে যে অল্প কয়েকজনকে সাইকেল চালাতে দেখেছি বেশির ভাগই সখ করে সাইকেল চালায়। কিন্তু এখানের ঘটনা ভিন্ন এরা সবাই জীবনের প্রয়োজনে সাইকেল চালাচ্ছে। আরো অবাক করার মতো বিষয় কেউ অন্য ভাবে তাকাচ্ছে না। কিন্তু ঢাকাতে হলে অনেক লোকজন তাকিয়ে থাকতো। এটা হয়তো আমার কাছে অন্যরকম লাগছে। কিন্তু এখানকার লোকজন হয়তো এই দৃশ্য দেখে অভ্যস্থ তাই কেউ অন্য ভাবে তাকাচ্ছে না।

এগারটা কি সাড়ে এগারটার দিকেই পৌঁছে গেলাম নেত্রকোনায়। শহরে পৌঁছেই সবার আগে চলে গেলাম জেলা প্রশাসকের অফিসে। আমার আজকে এখানে থাকার ইচ্ছা নেই, আমার ইচ্ছা ময়মনসিংহ চলে যাওয়ার। ডিসি অফিসে আসার মূল কারণ ডাইয়েরীতে কিছু লিখে নিয়ে যাওয়া। আগের জেলাগুলোতে দেখেছি ডিসি সাহেবরা প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকেন বিভিন্ন কাজে। তাই সরাসরি চলে গেলাম এনডিসি সাহেবের রুমে।

রুমে ঢুকে দেখি তিনি এক জনের সঙ্গে গল্প করছেন। আমি সালাম দিয়ে সব কিছু খুলে বললাম আমার উদ্দেশ্য। তিনি আমার সব কথা শুনে যে ব্যবহার করলেন না, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এমনিতে গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো না। কিন্তু আজকের ব্যবহার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেল।

তিনি প্রথমেই বললেন, ‘আমি আপনার ডাইয়েরীতে কিছু লিখতে পারবো না। আপনি যে সাইকেল চালিয়ে এসেছেন তার প্রমাণ কি? আমি কি আপনার সঙ্গে ছিলাম?’ এই কথাগুলো তিনি বলছিলেন খুবই বাজে ভাবে। আমি সাধারণত খুব শান্ত থাকার চেষ্টা করি কখনো উত্তেজিত হই না। কিন্তু কেন জানি আজকে আমার প্রচণ্ড মাথা গরম হয়ে আসছিলো, কোন রকমে নিজেকে সামলে রেখে খুব শান্তভাবে তার উত্তর দিলাম। বললাম, ‘দেখুন, আপনি কিছু না লিখে দিলে নাই। আমি আমার দেশ দেখতে বের হয়েছি দেশ সম্পর্কে জানতে এবং বুঝতে এসেছি। আপনি যদি ডাইয়েরীতে কিছু না লিখে দেন আমার কিছুই যায় আসে না। পূর্বে অনেক ডিসি/এনডিসি আমার ডাইয়েরীতে লিখে দিয়েছেন, আমার ভ্রমণের উদ্বোধনও করে দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা। আপনার দুই লাইন লিখে দেয়ার জন্য আমার ভ্রমণ আটকে থাকবে না।’ এই বলে আমি তার রুম থেকে বের হয়ে আসছিলাম তিনি পেছন থেকে একবার ডাকলেন কিন্তু আমি পেছনে তাকালাম না। পেছনে তাকানোর আর কোন ইচ্ছাও আমার নেই।

প্রচণ্ড রাগে কাপতে কাপতে জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে বের হয়ে আসলাম। বের হয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম আর কোন ডিসি অফিসে যাব না, দরকার নেই আমার ডিসি অফিসের কোন চিঠি অথবা তাদের লিখিত স্বাক্ষর। আমার ভ্রমণ আমি একা একাই করবো। এর আগেও কয়েকজায়গায় এই ধরনের ব্যবহারের কারণে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম। বের হয়েই ফোন করলাম টুটু ভাইয়ের কাছে। টুটু ভাইয়ে সব খুলে বললাম, আমার সিদ্ধান্তও জানিয়ে দিলাম। টুটু ভাইও আমাকে সাপোর্ট দিলেন। বলে দিলেন, ‘তুমি তোমার মত ঘুরতে থাকো। দরকার নাই যাওয়ার ওদের কাছে।’

37446_1476418480333_2434599_nচল্লিশা বাজার, বাগড়া বাজার, পূর্বধলা বাজার, শ্যামপুর বাজার, কাশীগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি বাজার পার হয়ে একটি বড় ব্রিজ পেলাম। ব্রহ্মপুত্র নদীর উপর এই ব্রিজটি পার হলেই ময়মনসিং শহর। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়েই ফোন করলাম, শামিম ভাইয়ের কাছে। যার কাছে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

শামিম ভাই আমাকে আনন্দমোহন কলেজের যাওয়ার কথা বলে দিলেন, তিনি সেখানেই থাকবেন। আনন্দমোহন কলেজের কথা বলাতে সবাই দেখিয়ে দিলেন কিভাবে যেতে হবে। আনন্দমোহন কলেজের গেইটে গিয়ে তাঁকে ফোন করলাম তিনি এসে আমাকে তাঁর মেসে নিয়ে গেলেন। একটি বাড়ির দ্বিতীয় তলায় তিনি একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন, সঙ্গে তাঁর ছোট ভাইয়েরাও থাকেন। তাঁদের সঙ্গে পরিচিত হলাম, তারপর ফ্রেস হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ভাইয়ার সঙ্গে বের হলাম আসেপাশে ঘুরে দেখার জন্য।

তাঁর কাছ থেকে জানতে পারলাম আসেপাশে যত বিল্ডিং, দোকানপাট আছে সবই কলেজ কেন্দ্রিক। অর্থাৎ সকল বিল্ডিংয়েই কলেজে পড়–য়া ছেলে অথবা মেয়েরা ভাড়া নিয়ে থাকে। এখানে একটি হল আছে কিন্তু সেই হলে সাধারণত ছাত্ররা উঠতে চায়না। মূলত রাজনৈতিক কারণেই উঠতে চায় না। রাজনীতি না করলে হলে সিট পাওয়া কঠিন। হলে সিট পেতে চাইলে প্রধান শর্তই থাকে মিছিল মিটিংয়ে যাওয়ার।

হাঁটতে হাঁটতে আনন্দমোহন কলেজের ভিতরে ঢুকলাম। কলেজটি বেশ পুরনো, জন্ম ১৯০৮ সালে। শামিম ভাই কলেজের ভেতরের বিভিন্ন ভবনগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। জানালের ভবন স্বল্পতার কথাও, জানতে পারলাম বর্তমানে এখানে প্রায় ত্রিশ হাজার ছাত্র-ছাত্রী পড়ালেখা করে। ছাত্র-ছাত্রীর তুলনায় কলেজটি অনেক ছোট পাশাপাশি শিক্ষকদেরও অনেক ঘাটতি আছে। এছাড়া শেসন জট তো আছেই, শামিম ভাই প্রায় সাত বছর যাবৎ এখানে পড়ালেখা করছেন, এখন তিনি চতুর্থ বছরের ছাত্র অর্থাৎ যেখানে চার বছরে পড়ালেখা শেষ হওয়ার কথা সেখানে তাঁর সাত বছর চলছে এবং তাঁর কথামতো হয়তো আরো ছয় মাসের মতো লাগবে। উনার বন্ধুরা অনেকেই ঢাকায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে বিভিন্ন জায়গায় চাকরী করছেন। কলেজের ভবনগুলি অনেকটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের মতো। কলেজের সামনে বিশাল এক মাঠ, সেখানে বসে দুজনে অনেক গল্প করলাম, তিনি আমার ভ্রমণ বিষয়ক গল্প শুনলেন। ফাঁকে ফাঁকে তাঁর নিজের পড়ালেখার বিষয়ে কথাবার্তা বললেন।

৬৪ জেলায় যা দেখেছি–৯

Comments

comments

Comments

  1. আপনার প্রথম পর্বটি পরেই এই কথাটি বলতে চেয়েছিলাম। আপনি হয়ত এই ব্যাপার গুলোর সাথে নতুন তবে আমি অনেক পুরাতন। কোন প্রকার রাখ ডাক না করেই বলে ফেলি, বাংলাদেশে যারা সরকারি চাকরি করে এদের বেশির ভাগ লোকই কুকুরের বাচ্চা! আমি নাম ধরে ধরে বলে দিতে পারব। অনেক গুলো দেশ ভ্রমণ করা হয়ে গেছে। পৃথিবীর আর কোথাও এমন দেখিনি।

    1. আমার অভিজ্ঞতা সব জায়গায় খারাপ না। তবে বেশিরভাগ জায়গায় খারাপ। যেমন হবিগঞ্জের এনডিসি মো: আলতাফ হোসেন আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছেন, তা আমি আজীবন মনে রাখবো। তাঁর সঙ্গে আমি ভ্রমণ শেষ পরেও যোগাযোগ করিছি। তিনি নিজে থেকেও আমাকে ফোন করেছিলেন।

Leave a Reply to Md Shariful Islam Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.