৬৪ জেলায় যা দেখেছি-৬

432257_3391506156328_1559714207_n

৬ মার্চ (হবিগঞ্জ থেকে মৌলভীবাজার)

সকালে ঘুম থেকে উঠলাম ৮:৩০ টায়। আজকে যেতে হবে ৬০ থেকে ৬৫ কিলোমিটার তাই একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠা। সবকিছু গুছিয়ে রুম থেকে বের হতে হতে ৯:৩০ বেজে গেল। রওনা দিলাম মৌলভী বাজারের উদ্দেশে। শায়েস্তাগঞ্জ এসে একটি গোলচত্বর পেলাম নাম খোয়াই চত্বর, সেখানে বাম দিকের রাস্তায় দিক নির্দেশনা দেয়া আছে মৌলভী বাজার। রওনা দিলাম সেই রাস্তা ধরে। কিছুদূর এগোনর পর একটি ব্রীজ পড়লো, ব্রীজ পার হয়ে আরো কিছুদূর সামনে এগোনোর পর দুটি রাস্তা পাওয়া গেল। একটি সোজা সিলেটের দিকে চলে গেছে অন্যটি ডান দিকে শ্রীমঙ্গল হয়ে মৌলভী বাজার।

কিছুদূর যাওয়ার পর একটি দোকানে হালকা নাস্তা করে নিলাম সঙ্গে থাকা পানির বোতলটি খালি হয়ে গিয়েছিলো সেটি ভরে নিলাম। পাশাপাশি বিশ্রাম ও দোকানদারের সঙ্গে গল্পগুজব করা। অল্প কিছুদূর পরেই শুরু হলো শ্রীমঙ্গল এর চা বাগান, এই দিকে প্রথম আসা মুগ্ধ হয়ে চা বাগান দেখছি। রাস্তাও অসাধারণ উচু-নিচু, আঁকাবাকা, দুই পাশে চা বাগানের মাঝখান দিয়ে রাস্তা পুরোপুরি ছবির মতো। সাইকেল চালানোর স্পিড ইচ্ছে করেই কমিয়ে দিলাম যাতে আরাম করে দেখতে পারি। গাড়ির সংখ্যা অনেক কম, অনেক্ষণ পর পর একটা দুইটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে পাশ দিয়ে সাই সাই করে চলে যাচ্ছে। সামান্য ভয় ভয়ও লাগছিল কারণ রাস্তা এত নির্জন অনেক্ষণ পর পর একটা দুইটা গাড়ি ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না, কোন মানুষজন নেই। এভাবেই দুপুরের পর পৌঁছালাম মৌলভী বাজার শহরে, ঘড়িতে সময় ৩ টা।

বেশ কিছুদিন আগে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র থেকে একটি সাইক্লিং এর প্রোগ্রাম আয়োজন করেছিল, নাম ছিল ‘বাংলাদেশকে জানো’ ঐ প্রোগ্রামে ১৩ জনের গ্র“প নিয়ে একটি সাইকেল ট্যুরে গিয়েছিলাম মুন্সিগঞ্জ সেখানে পরিচয় হয়েছিল জিসান নামে একজনের সঙ্গে। তাঁর বাড়ি এই মৌলভী বাজারে, জিসান ভাইয়ের সাথে আগেই যোগাযোগ করে রেখেছিলাম। জিসান ভাই ঢাকাতে তবে তিনি তাঁর বড় ভাইকে ফোন করে বলে দিয়েছেন আমার কথা। এবং তাঁর বড় ভাইয়ের নাম্বারও আমাকে দিয়ে রেখেছেন।

30513_1450248266094_7227900_nআমি শহরে পৌঁছে সবার আগে ফোন করলাম জিসান ভাইয়ের বড় ভাইয়ের কাছে। তিনি কেন জানি ফোন ধরলেন না, বাধ্য হয়ে রওনা দিলাম জেলা প্রশাসকের বাস ভবনে। সেখানে তাঁকে পেলাম না, সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না কি করবো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চিন্তা করলাম কি করা যায়? রওনা দিলাম সার্কিট হাউজের দিকে। সার্কিট হাউজের দায়িত্বে থাকা কেয়ারটেকার আমায় বলে দিলেন সার্কিট হাউজে কোন রুম খালি নেই। তবে আমি চাইলে এনডিসি সাহেবকে ফোন করতে পারি। তিনি হয়তো কিছু একটা করতে পারবেন। কারণ সার্কিট হাউজ ছাড়াও আরো কিছু ডাকবাংলো আছে।

কেয়ারটেকারের কাছ থেকে এনডিসি সাহেবের ফোন নাম্বার নিয়ে তাকে ফোন করলাম। ফোন ধরলেন তাঁর স্ত্রী, তিনি কিছুক্ষণ পরে ফোন দেয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। আমি প্রায় ৩০ মিনিট পর আবার ফোন করলাম, এইবার এনডিসি সাহেব নিজেই ফোন ধরলেন। তাঁকে সব কিছু খুলে বললাম, আমাকে রাতে থাকার ব্যবস্থা করা দেয়ার জন্যও অনুরোধ করলাম। তিনি বললেন ঠিক আছে আপনি জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে চলে যান আমি সেখানকার কেয়ারটেকারকে বলে দিচ্ছি।

খুঁজে বের করলাম জেলা পরিষদের ডাকবাংলো, সেখানকার কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করলাম এনডিসি সাহেব ফোন করেছিলো কিনা? উত্তরে ‘না’ বলে দিলেন। আমি প্রায় এক ঘণ্টার মতো অপেক্ষা করলাম জেলা পরিষদের বাংলোর বারান্দায়। কিন্তু এনডিসি সাহেব কেয়ারটেকারকে আর ফোন দেন না। আমিও কিছুক্ষণ পর পর কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করতে থাকলাম ফোন এসেছে কিনা? বারবার একই উত্তর, ‘না’; বাধ্য হয়ে আবার ফোন করলাম এনডিসি সাহেবকে কিন্তু তিনি ফোন ধরলেন না, আরো দুই তিনবার ফোন করলাম একই ফলাফল ফোন ধরলেন না। এর মধ্যে প্রায় বিকাল হয়ে গেছে, ঠিক করলাম হোটেলেই উঠে যাব। এই ঝামেলা আর ভালও লাগছে না।

জেলা পরিষদ থেকে বের হতে যাব এমন সময় জিসান ভাইয়ের বড় ভাইয়ের ফোন। ‘ভাইয়া তুমি কোথায়? আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তাই ফোন ধরতে পারিনি।’ উত্তরে বলরাম, ‘আমি জেলা পষিদের ডাক বাংলোর সামনে আছি।’ তিনি আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। অল্প কিছুক্ষণ পরই মোটরসাইকেল নিয়ে তিনি ও তাঁর এক বন্ধুকে নিয়ে হাজির। সবকিছু শুনে তিনি আমাকে সাইকেল নিয়ে সার্কিট হাউজে যেতে বললেন। আর বললেন ওখানে অপেক্ষা করো, আমিও সেখানে আসছি।

সার্কিট হাউজের কেয়ারটেকারকে বলে দিলেন আমাকে যেন কোন এক জায়গায় আপাতত বিশ্রাম করার জন্য বসতে দেয়া হয়। তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ব্যবস্থা করছেন। আমাকে বসতে দেয়া হলো বিশাল এক রুমে, বুঝতে পারলাম এটা সভাকক্ষ, সার্কিট হাউজটি বেশ আধুনিক। তিন তলা সার্কিট হাউজটি নতুন করে তৈরি করা হয়েছে, উদ্বোধন করেছেন এম সাইফুর রহমান। আমাকে যে সভাকক্ষে বসানো হলো সেই রুমটিও বিশাল। রুমে যে বিশলা টেবিলটি আছে সেটার মাপ ক্রিকেট খেলাম পিচের সাইজের অর্থাৎ বাইশ গজের কম হবে না, আর পুরো রুমটা হবে পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ গজের মতো।

আমি আবার অপেক্ষা করতে থাকলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোন আসলো জিসান ভাইয়ের ভাইয়া বললেন, ‘তুমি আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো, ওরা তোমাকে একটা রুম দিবে। রুম পাওয়ার পর আমাকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়ো।’ আমি রুমের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। যেই কেয়ারটেকার বলেছিলেন সার্কিট হাউজে কোন রুম সেই কেয়ারটেকার এসে জানিয়ে দিলেন, ‘আমার রুমের ব্যবস্থা হয়ে গেছে।’

কি অদ্ভূত, যে লোকটা দুই ঘণ্টা আগেই বলে দিলেন কোন রুম নেই সেই লোকই আমাকে রুমের খবর দিলেন। যে এনডিসি আমার ফোনই ধরলেন না এখনও পর্যন্ত। অথচ এনডিসি ছাড়াই রুমের ব্যবস্থা হয়ে গেল। একেই হয়তো বলে ক্ষমতা, একেই বলে জোর যার মুল্লুক তার।

কেয়ারটেকার একটি খাতা নিয়ে আসলেন নাম ঠিকানা লেখার জন্য। সবকিছু লিখে দেয়ার পর আমাকে রুমের চাবি দিলেন এবং দেখিয়ে দিলেন আমার রুম, রুমের দরজায় লেখা আছে হাসনাহেনা অর্থাৎ আমার রুমের নাম হাসনাহেনা। এটি অবশ্য তিনতলা বিল্ডিংয়ের মধ্যে না। মূল ভবনের পাসেই একটি টিনসেডের বিশাল সার্কিট হাউজ, মনে হচ্ছে এটা পুরাতন সার্কিট হউজ। রুমে ঢুকেই ভাইয়াকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম।

যে রুমটা পেলাম সেটাও বিশাল রুম, রুমে সবকিছুই আছে, ফ্রিজ, টিভি, আলমারিসহ সব। গোসল করার জন্য টয়লেটে ঢুকলাম, টয়লেটটাও বিশাল, চাইলে টেবিল টেনিস খেলা যাবে। বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বের হলাম সাইকেলের ব্যগটা নিয়ে, কারণ ব্যগটা একটু ছিড়ে গেছে সেলাই করতে হবে। ব্যাগটা সেলাই করে শহরে অনেক্ষণ এলোমেলো ভাবে হাটাহাটি করলাম শহরটা দেখার জন্য। যদিও এতো কম সময়ে সবকিছু দেখা যায় না তারপরেও সামান্য বৃথা চেষ্টা।

একটি দোতলা বাড়ির সামনে বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন দেখে চোখ আটকে গেল। লেখা আছে ফার্নিচারসহ বাড়ি ভাড়া দেয়া হবে। ফার্নিচারসহ বাড়ি ভাড়া এই ধরনের বিজ্ঞাপন এর আগে দেখেছি বলে মনে পড়লো না। কৌতুলী হয়ে গেটে কড়া নাড়লাম, ভেতর থেকে একজন মধ্য বয়স্ক লোক বের হয়ে আসলেন, জিজ্ঞেস করলেন কি চাই? তাকে সব খুলে বললাম, আমার কৌতুহলের কারণ। তিনি হেসে সিলোটি ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন। এই বাড়ির মালিক লন্ডনে থাকেন ২/৩ বছর পর পর দেশে আসেন। এমনিতে বাড়িটি খালি পরে থাকে তাই ফার্নিচারসহ বাড়ি ভাড়া দেয়া হয়। বাড়ি ভাড়ার সঙ্গে আবার একটা শর্তও জুড়ে দেয়া হয়। শর্তটি হলো, মালিক যদি দেশে আসে তখন বাড়ি ছেড়ে দিতে হয়। অবশ্য মালিক দেশে ফেরার তারিখ আগেই জানিয়ে দেয়া হয়।

শহরে দোকানপাট অনেক বেশীই মনে হলো। এখানকার যুবক ছেলেরা বেশ স্টাইলিস ভাবে চলাফেরা করে। পোশাক আশাক দেখে তাই মনে হলো, আমরা এটাকে বলি মাঞ্জা মেরে চলা। বোঝা যাচ্ছে এদের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ভাল। অবশ্য ভালো হওয়াই স্বাভাবিক এখানকার বেশির ভাগ লোকজনই প্রবাসে থাকে।

বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমান লাইব্রেরীও দেখা গেল। শহর বেরানোর পাশাপাশি মনে মনে ঠিক করে নিচ্ছিলাম রাতে কোন হোটেলে খাওয়া যায়। খাওয়ার চিন্তা করতে করতেই জিসান ভাইয়ের ফোন, ‘শরীফ ভাই আপনি কিন্তু রাতে আামাদের বাসায় খাবেন, ভুলেও বাইরে খাবেন না। আপনার জন্য বাসায় রান্না হচ্ছে।’ যাক এই বেলা বাইরে খাওয়ার চিন্তা বাদ গেল, মৌলভীবাজারের ঘরের খাবার কেমন তা টেস্ট করা যাবে।

30513_1450248306095_8378250_nআমি হোটেলের খাওয়ার চিন্তা বাদ সার্কিট হাউজের দিকে রওনা দিলাম, সার্কিট হাউজে ফেরার সময় দোকান থেকে খেজুর কিনে নিলাম। আগামীকাল কাজে লাগবে এই ধরনের শারীরীক পরিশ্রমের ভ্রমণে খেজুর বেশ কাজে দেয়। শোনা যায় আমাদের নবীজী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীরা নাকি যুদ্ধের সময় অন্য খাবার-দাবার না থাকলে খেজুর দিয়েই চালাইতেন। এই সবকথা চিন্তার মধ্যে ভাটা পড়লো দূর থেকে বিচিত্র শব্দের জন্য, দূর থেকে ভো! ভো! করে একদল ছেলেপেলে মটর সাইকেল নিয়ে আমার পাশ দিয়ে চলে গেল সংখ্যায় তারা ৩০/৪০ জনের কম হবে না। অর্থাৎ মোটর সাইকেলের সংখ্যা ২০/২৫ এর কম না।

সার্টিট হাউজে ফিরে অপেক্ষা করতে থাকলাম জিসান ভাইয়ের বড় ভাইয়ের জন্য। একসময় তিনি আসলেন, এবার আর সঙ্গে মোটর সাইকেল না একটা প্রাইভেটকার নিয়ে। আমাকে উঠতে বললেন, উঠার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি চলতে শুরু করলো। কিছু উচুনিচু রাস্তা পার হয়ে প্রায় দশ মিনিট পরেই পৌঁছে গেলাম তাঁদের বাড়িতে। পরিচয় হলো তার আব্বা-আম্মার সঙ্গে আরো পরিচয় হলো মামাতো তাঁর বোনের সঙ্গে।

খেতে বসে মোটামুটি সবকিছুই পেলাম গরুর মাংস, গুড়া মাছ, ডিমের তরকারি ও ডাল। এতো কিছু খাওয়ানোর পরেও তাঁর আব্বা বললেন খুব তাড়াতাড়ি এইসব ব্যবস্থা করতে হয়েছে, তাই আমার জন্য বেশি কিছু করতে পারেন নি। আমি মনে মনে ভাবলাম এত তাড়াতাড়ি এত রকমের তরকারি তৈরি হয়ে গেলো। আর সময় পেলে তো আমার খবর ছিলো।

খেতে খেতে জিসান ভাইয়ের আব্বার কাছে নিজের জীবনবৃত্তান্ত দিতে হলো। খাওয়া-দাওয়ার পর সার্কিট হাউজে ফিরে ঘুমের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।

৬৪ জেলায় যা দেখেছি-৫

Comments

comments

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.