৫ মার্চ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে হবিগঞ্জ)
আমার পরবর্তী জেলা হবিগঞ্জ। সকালে মোবাইলে এলার্ম বাজতেই উঠে পড়লাম ঘুম থেকে। উঠেই বেগ গুছিয়ে রওনা দিলাম আমার পরবর্তী জেলার উদ্দেশে। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা, তেমন কোন যানবাহন চলাচল চোখে পড়ছে না। সূর্যের তেজ অনেক কম, কিছু ছেলেমেয়েকে দেখা গেল স্কুলের জামা পড়ে স্কুলের পথে রওনা দিয়েছে। কেউ রিক্সায় কেউ পায়ে হেঁটে আবার কেউ সাইকেলে। কয়েকজন অবাক হয়ে আমাকে দেখছে, তাঁদের চোখই বলে দিচ্ছে তাঁরা আমাকে প্রশ্ন করছে, আপনি কোথা থেকে এসেছেন? কোথায় যাচ্ছেন? কিন্তু সাহসের অভাবে অথবা জড়তার কারণে জিজ্ঞেস করতে পারছে না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে বের হয়ে আবার গতকালের মূল রাস্তায় উঠে পড়লাম, ঢাকা সিলেট হাইওয়ে। লোকজন যে কেন হাইওয়ে রোড বলে? বিশ্বরোডও তো বলতে পারে। মেইন রোডে চালাতে বেশ ভাল লাগছে গাড়ির তেমন চাপ নেই। অনেকটাই ফাঁকা ফাঁকা, এক ছোট বাজারের কাছে এসে থামলাম সকালের নাস্তা করার জন্য। ভ্রমণে বের হয়ে এই অল্প কয়েকদিনেই একটা রুটিনের মতো হয়ে যাচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি রাতে ঘুমোতে যাচ্ছি এবং ভোরে উঠে পড়ছি। আবার প্রতিদিন সকালে ১০/১৫ কিলোমিটার চালানোর পরেই নাস্তা করার জন্য থামছি। অথচ ঢাকায় থাকা অবস্থায় কখনোই রাত ১২ টার আগে ঘুমানো হতো না। যদি বিশেষ কোন কাজ থাকতো তাহলে তো কথাই নেই ঘুমাতে ঘুমাতে রাত ২/৩ টাও বেজে যেত। আর ভোরে তো অনেক দূরের ব্যাপার, প্রতিদিন উঠতাম সকাল ৯ টা বা ১০ টার দিকে।
নাস্তা শেষ করে আবার সাইকেলে উঠে পড়লাম। এবার সাইকেল চালাতে একটু ক্লান্ত লাগছিল তাই আস্তে আস্তে চালাচ্ছি, ভোরের সেই স্পিড আর নেই গতি অনেক কমে গেছে। সকাল ১১ টার দিকে চালাতে আরো বেশি সমস্যা হলো, একে তো সূর্য মাথার উপরে উঠে গেছে তার উপর উল্টা দিক থেকে বাতাস এসে আমার গতি আরো কমিয়ে দিতে থাকলো। বাতাসের বিপরীতে এক রকম যুদ্ধ ঘোষণা করেই চালাতে হলো, রাস্তার দুই দিকে খোলা মাঠ। দুপুর নাগাত চার রাস্তার এক গোলচত্ত্বরে পৌঁছালাম, গোলচত্ত্বরের নাম মুক্তিযোদ্ধা চত্ত্বর, মাধবপুর।
সিদ্ধান্ত নিলাম এখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে নেব। কারণ পরবর্তীতে আবার কোথায় খাবার হোটেল পাব তার ঠিকঠিকানা নেই। এখানে কয়েকটি খাবার হোটেল চোখে পড়লো। একটিতে ঢুকে পড়লাম, হাতমুখ ধুয়ে খাসির মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে নিলাম। ভাত খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম হোটেলে বসেই।
কিছুক্ষণ চালানোর পরেই একা ব্রীজ পেলাম, নীচ দিয়ে একটি নদী চলে গেছে। নদীর নাম সুতাং, রবীন্দ্রনাথের আমাদের ছোট নদীর চাইতে অনেক বড় কিন্তু পানি হাটুরও অনেক নীচে। শায়েস্তাগঞ্জ পার হয়ে বিকালের দিকে পৌঁছালাম হবিগঞ্জ জেলায়।
আজ শুক্রবার, ছুটির দিন ডিসি অফিসে গেল কাউকে পাওয়া যাবে না। এটা মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে না গেলে ডিসি অথবা এনডিসি কারও ঠিকানাই সহজে বের করা যাবে না। খুঁজে খুঁজে বের করলাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জানা গেল এখানে নতুন একজন ডিসি আসবেন বর্তমানে কেউ এই দ্বায়িত্বে নেই। তবে এনডিসি আছেন, জেনে নিলাম কিভাবে এনডিসির বাসায় যাওয়া যায়। আবার শুরু হলো খোঁজাখুঁজি এই দিকে অবশ্য কোন কিছু খোঁজ করা তেমন কঠিন কাজ না মোটামুটি সবাই চেনে।
লোকজনকে জিজ্ঞেস খুঁজে বের করলাম এনডিসি (নেজারত ডেপুটিকালেক্টর) বিল্ডিং। বিল্ডিং তো পাওয়া গেল কিন্তু সমস্যা আরেকটা রয়েই গেল, কয়তলায় কোন ফ্ল্যাটে থাকেন উনি তা তো জানি! নীচে সাইকেল রেখে উপরের দিকে উঠতে শুরু করলাম। নীচ তলায় দুই পাসে দুইটি ফ্ল্যাট কোন দরজাতেই নাম লেখা নেই কার বাসা। ভাগ্য ভাল দ্বিতীয় তলাতেই পেয়ে গেলাম এনডিসির বাসা। দরজায় একটি সাদা কাগজে লেখা আছে।
দরজায় কড়া নাড়তেই একজন অল্প বয়স্ক লুঙ্গি পড়া ভদ্রলোক উকি দিলেন পড়নে সেন্টু গেঞ্জি ও লুঙ্গী। দরজা ফাঁক করে আমার উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন, কাকে চাই জানতে চাইলেন। উত্তরে বললাম আমি এনডিসি সাহেবের সাথে দেখা করতে চাই। উত্তরে বললেন অপেক্ষা করেন। বলেই তিনি ভেতরে ঢুকে গেলেন, কিছুক্ষণ পর সার্ট পড়ে ফিরে আসলেন আমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে সোফা দেখিয়ে বসতে বললেন এবং বললেন আমিই এই জেলার এনডিসি।
তাঁর কথা শুনে কিছু চমৎকৃত হলাম, আমি ভাবতে পারিনি এতো কম বয়সী এমন একটি লোক এই রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারেন। কথায় কথায় জানতে পারলাম তিনি বুয়েট থেকে পাস করে বের হয়েছেন। আমি যেমন তাঁকে দেকে চমৎকৃত হয়েছি, তিনিও আমাকে দেখে এবং আমার কর্মকাণ্ড দেখে চমৎকৃত হলেন। ভেতর থেকে তাঁর ছোট ভাইকে ডেকে নিয়ে আসলেন, আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
আমি আমার ডাইরীটি তাঁর হাতে বাড়িয়ে দিলাম এবং বললাম কিছু একটা লিখে দেওয়ার জন্য সাথে যদি সম্ভব হয় স্বাক্ষর এর নীচে একটা সীল দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি বললেন তাঁর কাছে সীল নেই, সীল অফিসে। তিনি প্রথমে পূর্বের কয়েকটি পৃষ্ঠা দেখলেন এবং দেখে বললেন বিরবির করে বললেন, এরা (পূর্বের জেলার ডিসিরা) এইগুলা কি লিখছে? একটা ছেলে দেশ দেখতে বের হয়েছে আর কি সব লিখে দিয়েছে! তিনি কয়েকটি লাইন লিখে দিলেন, এবং স্বাক্ষর করে দিলেন। ফোন করে আমাকে ডাকবাংলোতে থাকার ব্যবস্থা করে করে দিলেন।
আমাকে বলে দিলেন ডাকবাংলোতে কেয়ারটেকারকে বললেই আমাকে রুম দেখিয়ে দিবেন। এবং আমার শুভ কামনা করলেন। আমি ডাকবাংলো খুঁজে বের করলাম, কেয়ারটেকারকে বলতে রুমের চাবি দিয়ে দিলেন। রুমে ঢুকে মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল মোটামুটি সুন্দর রুম রুমের ভেতরেই টয়লেট ঝকঝক করছে। রুমে একটা টিভিও আছে। ফ্রেশ হয়ে ডাইরীতে চোখ রাখলাম কি লিখে দিয়েছে এই এনডিসি দেখার জন্য। তাঁর লেখা দেখা মনটা আরো ভাল হয়ে গেল, আমি মনে হয় এই ট্যুরের সবচাইতে সুন্দর লেখাটি পেয়ে গেছি। এমন লেখা মনে হয় কোন ডিসি অথবা এনডিসি লিখে দিতে পারবেন না। লেখাটা ছিল এই রকম,
মো: শরীফুল ইসলাম একজন সাইক্লিস্ট। তবে আমার মনে হয়, তিনি একজন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। নিজে স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্নের পিছু ছুটছেন অহর্নিশ। তাঁর এই প্রচেষ্টা সত্যিই আমাকে অবাক করেছে। এই ছুটে চলাই তাঁর জীবন, এই বয়ে চলাই তাঁর স্বপ্ন। তাঁর স্বপ্ন সফল হোক এই কামনা করি। (মো: আলতাফ হোসেন, নেজারত ডেপুটি কালেক্টর, হবিগঞ্জ)
সন্ধ্যার একটু আগে আগে বের হলাম শহর দেখার জন্য। এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যেতে সময় লাগলো মোটামুটি ৩০ মিনিট এর মতো। এই ৩০ মিনিটে মোটামুটি বুঝে নিলাম শহরটা কেমন। শহরটা মোটামুটি একটি রাস্তার উপরই সিমাবদ্ধ, তবে সেই রাস্তার সঙ্গে কয়েকটা ছোট অলিগলিও যুক্ত হয়েছে। চোখে পড়ার মতো একটি অন্যরকম খাবারের দোকান, নাম কলাপাতা। নামের সঙ্গে দোকানের ডেকোরেশনের একটা ভাল মিল আছে। শহরে রিক্সার চাইতে বেটারী চালিত অটোরিক্সাই বেশি চোখে পড়লো। আর চোখে পড়ার মতো বেশ কয়েকটি স্টাইলিশ কাপড়ের দোকান অনেকটা ঢাকার এ্যালিফেন্ট রোডের মতো এবং বড় একটি শপিং মল নাম খাজা গার্ডেন সিটি।


[…] ৬৪ জেলায় যা দেখেছি-৫ […]