পাখি

আজ সকালের দিকে ফার্মগেটের দিকে একটা কাজ ছিল। কাজ ছিল বলতে ঠিক করে রেখেছিলাম কয়েকদিন আগেই। সেখান থেকে রহিমমেটাল হয়ে ফিরবো। আমাদের নাখালপাড়ার বহু মানুষের কবর রহিম মেটালে। আমার মায়েরও তাই। কোন কাজ না থাকলে অথবা ঐ দিকে গেলে মাঝে মাঝে রহিমমেটাল হয়ে আসি।
সকালে ভাবছিলাম সাড়ে এগারটার দিকে বের হবো। কিন্তু বের হতে হতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। ছুটির দিনগুলাতে বের হলে সাধারণত চেষ্টা করি একা থাকলে সাইকেল নিয়ে বের হইতে। জ্যামও কম থাকে, সাইকেল চালিয়ে আলাদা একটা আনন্দ পাওয়া যায়। এমনিতেও সাইকেলে উঠলেই আমার অনেক কিছু বদলে যায়।
সাইকেল চালালে মাঝে মাঝে আমি গান শুনি। গান শুনতে শুনতে খুবই আস্তে আস্তে বাঁ দিক দিয়ে চালাতে থাকি। আমার স্ট্রাভার রেকর্ড দেখলে বুঝা যাবে আমি খুবই আয়েশ করে চালাই। অফিসে গেলে অবশ্য সেখানে একটু জোড়ে চালাই। মিউজিক চালালে খুবই হালকা সাউন্ডে চালাই সফট মিউজিক বেশি শুনি। অফিসে গেলে অথবা জোরে চালালে তখন আর্টসেল টাইপের মিউজিক শোনা হয়।
আজ র‌্যান্ডম কয়েকটা গানের পরেই লীলা ব্যান্ডের একটা গান আসলো। অনেকবছর আগে তাজরীন গার্মেন্টসের আগুন নিয়া গানটা উনারা লিখছিলেন। ঐ গানটা আসার পরে প্রথম লাইনটা শুনার পরেই মনে হইছে এই গানটা আজ সারাদিন শুনতে হবে। গানের প্রথম লাইনটাই ছিল এমন, ‘আহারে মোর সোনার ময়না কলিজার টুকরা’। আমি গান শুনলে মাঝে মাঝে অদ্ভুত একটা কাজ করি একটা গান অনেকবার শুনি। টানা ৮/১০ দিন শোনারও রেকর্ড আছে। আজকের এই গানটা পুরা তিন ঘণ্টা শুনছি, পুরাটাই সাইকেল চালানোর অবস্থায়। হিসাব করে দেখলাম প্রায় ৪২/৪৩ বার হবে।
আমার মায়ের সাথে মাঝে মাঝেই মিউজিক নিয়া কথা বার্তা হইত। আম্মা বেশিরভাগ গানকেই দেহতত্ত্ব বা ঈশ্বরতত্ত্বের দিকে নিয়ে যেতেন, ঐভাবেই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতেন। আমার সাথে মাঝে মাঝেই বিতর্ক হইত বিচ্ছেদ আর দেহতত্ত্ব বা ঈশ্বরতত্ত্ব নিয়া।
যাই হোক আজকের গানটা যখন শুনতেছিলাম তখন পুরা পৃথিবীর মায়েদের কথাই মনে হচ্ছিল। সত্যবতী যখন পৃথিবীতে আসে তারপর থেকে ওকে ওর মা প্রায়ই পাখি বলে। তারপর দেখলাম ওর বোনের মেয়ের বাচ্চা হইল তখনও ওর মা বাচ্চাকে পাখি ডাকতেছে। সুরাইয়ার বড় বোনও পাখি ডাকে। সবাই আলাদা আলাদা পাখির নাম দিয়াও ডাকে।
কিন্তু আমরা ছেলেরা মনে হয় ঐভাবে পাখি হিসাবে ডাকি নাই। ঐভাবে আহ্লাদ করে ডাকি নাই। আমি এটা পারি নাই কেন জানি। এই পাখি ডাকটা মনে হয় মেয়েরাই বেশি ব্যবহার করে। পাখি কলিজার টুকরা মনে করতেছে। মায়েদের কাছে আমরা সবাই হয়তো তাই। পাখি আর কলিজার টুকরা।
আরেকটা জায়গায়ও পাখি ডাকতে শোনা যেত আগে। এখন হয়তো বাবু নামটা চলে আসছে। কিন্তু একটু আগের দিকে তাকালে পছন্দের মানুষদের পাখিই ডাকতো। তখন একটু হাস্যকর লাগলেও আজ কেন জানি এই বিষয়টা অতটা হাস্যকর লাগে নাই। এই যে আমাদের মায়েরা বা নারীরা ইমোশন দিয়ে মন থেকে ডাকে, সেটা বাচ্চাদের হোক আর পছন্দের মানুষদেরই হোক না কেন তাঁদের ইমোশনটা বেশ স্ট্রংই।
পাখি বিষয়টা আমাদের কবিতা, গান, উপন্যাস মোটামুটি সব জায়গাতেই আসছে বলা যায়। বিশেষ করে আমাদের মাটির যে গানগুলা যেমন বাউল গান, রাধা-রমন, ভাটির গান থেকে শুরু করে পাখি অনেক স্ট্রংভাবেই আসছে। পাখিটাকে যদি মানুষের মন বা হৃদয় দিয়ে ব্যাখ্যা করলেও ভুল হবে না অথবা আত্মার সাথেও তুলনা করা যেতে পারে। যেটাকে ধরা যাচ্ছে না কিন্তু শুধু অনুভবই করার চেষ্টা করা যায়।
আমাদের নারীরা সম্ভবত এই পাখি বলতে এই হৃদয় বা আত্মাকেই বুঝিয়েছেন। নিজের সন্তানদের বা নিজের প্রিয় মানুষটাকে তাঁরা নিজের আত্মাই মনে করে, কলিজার টুকরাই মনে করে।
লীলার তাজরীন গার্মেন্টসকে স্মরণ করে যে গানটা গাইল এটার কথা আমার বিশেষভাবে মনে আছে। একটা কারণ একশর উপরে মানুষ মারা গেল। আরেকটা কারণ হইল একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ছিল। সেই দিনটা আবার আমার জন্মদিন বলা যায়। ঐ দিনটাকে আমি অনেক আগে থেকেই লুকিয়ে রাখছিলাম। খুব কাছের মানুষ ছাড়া কেউ এইটা জানে না। এই দিনটা পালন করতে ভালো লাগে না অনেক আগে থেকেই। কিছুদিন আগে চলে গেল সেই দিনটা। দেখা গেল এই দিনটার কথা তিনজনের মনে আছে। সেই তিন জনই আবার নারী।
লীলার গানের ময়না পাখিটা কয়লা হয়ে গিয়েছিল। আমার মাকে দেখেছি কোন স্বপ্ন ছিল না। থাকলেও আমরা জানতাম না। আমাদের নারীদের জীবনটা অনেকটাই এমন। সবকিছু আরেকজনের উপর নির্ভর। লীলার পুরা গানের মধ্যে তিনটা লাইন মাথায় বেশি বাজছে।
নারী হওয়ার বিষম জ্বালা
ঘরে বাইরে শতেক তালা
জীবন যৌবন অন্যের হাতে রয়…
২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.