৬৪ জেলায় যা দেখেছি–২৩

২৩ মার্চ (জয়পুরহাট থেকে বগুড়া হয়ে নওগাঁ)

খুব ভোরে কোরেশী ভাই ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। বেশিরভাগ জায়গায় আমি নিজে থেকেই উঠতাম এবং একটু দেরি হতো ঘুম থেকে উঠতে। কোরেশী ভাই ভোরে উঠে নামায পড়েন, তাই তিনি নামায শেষে আমাকে ডেকে তুললেন। এতে আমার জন্য ভালই হইল। কারণ আজ বগুড়া শহর থেকে নওগাঁ চলে যাওয়ার ইচ্ছা।

ফ্রেশ হয়ে কোরেশী ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দিলাম বগুরার উদ্দেশে। বটতলা বাজার, কালাই, পাঁচশিরা বাজার, কিচক হয়ে আমতলী বাজারে এসে থামলাম। এক হোটেলে ঢুকলাম নাস্তা করার জন্য। হোটেলের মালিক জানতে চাইলেন আমি কোথায় যাব, কি কারণে বের হয়েছি। তাকে আমার ভ্রমণের বিস্তারিত বললাম। তিনি সবকিছু শুনে মূল রাস্তার বাইরে নতুন একটা রাস্তার সন্ধান দিলেন। যে রাস্তা দিয়ে গেলে একদম মহাস্থানগড়ের সামনে দিয়ে বের হওয়া যাবে। এতে আমার লাভ হবে রাস্তাও কিছুটা কম হবে আর মহাস্থানগড়ও দেখা হয়ে যাবে। তাঁর প্রস্তাব আমার কাছে বেশ ভাল লাগলো।

তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে কিভাবে যেতে হবে। আমতলী হয়ে ডানদিকে একটি রাস্তা মহাস্থানগড় হয়ে বগুড়ার দিকে চলে গেছে। তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে পথে নামলাম। আমার নতুন গন্তব্য তৈরি হলো মহাস্থানগড়। শীবগঞ্জ পার হওয়ার একটা গবেষণাগার দেখলাম। যার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না, সাইবোর্ডে লেখা মশলা গবেষণা কেন্দ্র। এটা আমার কাছে একদম নতুন কল্পনারও অতীত। মশলা নিয়ে যে গবেষণা হতে পারে আমার ধারণা ছিল না। প্রায় চল্লিশ মিনিট সাইকেল চালানোর পর পৌঁছালাম মহাস্থানগড়ের জাদুঘরের গেইটে।

41205_1523627660533_7821268_n

জাদুঘরে টিকেট কেটে ঢুকতে হয়। টিকেট কেটে ঢুকা সমস্যা না, সমস্যা দেখা দিল সাইকেল নিয়ে, কোথায় রাখবো। বাইরে খুব বেশি জায়গা নেই আর চুরিরও সম্ভাবনা আছে বিশেষ করে এখানে অনেক লোকজন। টিকেট কাটার সময় কাউন্টারের লোককে ভালমতো বুঝিয়ে বললাম। তিনি আমার কথা বেশ খুশি হলেন বিরক্ত হওয়ার বদলে। তিনি নিজেই কাউন্টার থেকে বের হয়ে আসলেন। তারপর আমার সাইকেলসহ ভিতরে ঢুকার অনুমতি দিলেন। আর কাউন্টারের পিছনে একটা জায়গা দেখিয়ে দিলেন বললেন ঐখানে তালা দিয়ে রাখতে এবং তিনি নিজেই চোখে চোখে রাখবেন যাতে আমার সাইকেলের কোন সমস্যা না হয়।

আমি নিশ্চিন্তে ঢুকে পড়লাম জাদুঘরে। মূল ভবনে ঢুকার আগে লেখা আছে ছবি তোলা যাবে না। তাই ভিতরে ছবি তোলা থেকে বিরত থাকলাম, বেশকিছু পোড়াকৃর্তি দেখলাম যা বেশ পুরান ১২ শতক থেকে ১৮ শতকের পোরা মাটির জিনিশপত্র এখানে স্থান পেয়েছে। একটি ভাঙ্গা বৌদ্ধমুর্তিও দেখলাম। জাদুঘর থেকে বের হওয়ার পরে আশেপাশে একটু ঘুরতে যাব। কিন্তু গেটের কাছে আসতে আসতে দেখি এলাহি কাণ্ড।

আমার সাইকেল ঘিরে লোকজন গিজগিজ করছে। গেইটের দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য একজন আরেকজনের সঙ্গে গল্প করেছিলেন যে এই সাইকেল নিয়ে আমি বাংলাদেশ ভ্রমণে বের হয়েছি। আর এই গল্প এককান দুইকান হতে হতে ২০ মিনিটে ৫০/৬০ জন লোক জড়ো হয়ে গেছে। আর ঐ ৫০/৬০ জন লোকের জটলা দেখে হুহু করে লোকজন বাড়তে থাকলো। তারপরে মরার উপর খাড়ার ঘা। দুইটা বাসে করে শিক্ষা ভ্রমণে এসেছে দুইটা গ্রুপ তাঁরাও আমাকে ঘিরে ধরলেন।

আমি চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলাম। লোকজনের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। অনেক কষ্ট করে তাঁদের হাত থেকে নিস্তার পেলাম। নিস্তার পাওয়ার আগে অনেকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে ছবি তুলতে হলো।

ভিতরে ছবি তুলতে না পারলেও বাইরের কিছু ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছিলাম। রওনা দিলাম বগুড়া শহরের উদ্দেশে। গোকুল হয়ে বগুড়া শহরে ঢুকলাম। বগুড়া আসার আগেই আমাকে রঞ্জু ভাই বলে দিয়েছিলেন, তাঁর এক আত্মীয় আছেন আমি যেন অবশ্যই তাঁর সঙ্গে দেখা করে যাই। রঞ্জু ভাই লালমনিরহাটে আমাকে একটা বড় বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলেন। তখনই তিনি বলে রেখেছিলেন তাঁর আত্মীয়ের সঙ্গে যেন অবশ্যই দেখা করি।

বগুড়ার বেলাল ভাই
বগুড়ার বেলাল ভাই

রঞ্জু ভাইয়ের কথামতো উনার আত্মীয়কে ফোন দিলাম। তাঁর নাম বেলাল, বেলাল ভাই বলে দিলেন আমি যেন সাতমাথায় আশি তিনি সেখানেই আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। লোকজনদের জিজ্ঞেস করে সাতমাথার উদ্দেশে রওনা দিলাম। এক মাঠে বাণিজ্য মেলা চলছিল। আমার ধারণা ছিল ঢাকা ছাড়া অন্য কোথাও বাণিজ্য মেলা হয় না। কিন্তু এই ভ্রমণে এসে দেখলাম সব জেলাতেই কোন না কোন মেলা হয়ই। বাণিজ্য মেলা, বইমেলা আর স্থানীয় মেলা তো আছেই।

সাত মাথায় পৌঁছালাম। পথে যেতেই মাথার মধ্যে ঘুরছিল। জায়গার নাম সাত মাথা কেন। ঢাকায় সাত রাস্তা আছে সাতটা রাস্তা কারণে এইখানেও কি ঐ রকম। সাত মাথায় পৌঁছে সবার আগে রাস্তা গুনলাম। আসলেই সাতটা রাস্তা। সাতটা রাস্তা একসঙ্গে মিলেছে তাই সাত রাস্তার মাথাকে সাত মাথা নাম দিয়েছে। বগুড়া শহরটা অনেক ব্যস্ত শহর মনে হচ্ছিল। আর সাতমাথাকে বগুড়া শহরের জিরো পয়েন্ট বলা যায়। আর সাতমাথা ঘিরেই সকল চাঞ্চল্য।

ফোন দিলাম বেলাল ভাইকে আমার অবস্থান জানিয়ে। তিনি দুই মিনিটের মধ্যেই চলে আসলেন। তিনি আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। বেলাল ভাই অমায়িক একজন মানুষ। প্রথম অনেক জোরজবরদস্তি করার চেষ্টা করলেন তাঁর বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং আজ রাতে আমাকে রেখে দিতে চান। কিন্তু আমি নওগাঁ চলে যাব শুনে একটা হোটেলে ঢুকালেন দুপুরের খাওয়ানোর জন্য।

ঢুকেই তিনি বিরিয়ানির অর্ডার দিলেন। ভ্রমণে এই জিনিশ খাওয়া একদমই ঠিক না কিন্তু আমার এই জিনিশ খেতে হলো। বিরিয়ানি খাওয়ার এক কেজি দইয়ের অর্ডার দিলেন। এক প্লেট বিরিয়ানি খাওয়ার পর আবার এক কেজি দই খাওয়া আমার জন্য বিশ্ব জয়ের সমান। দই খেতে আমি রাজি আছি বগুড়ায় এসে দই না খাওয়াটা এক ধরনের অপরাধ। কিন্তু এক কেজি দই কিভাবে খাব মাথাতেই ঢুকছিল না। তিনি আমাকে জোর করে আধা কেজির মতো খাওয়ালেন। খাওয়ার পর আর নরাচরার অবস্থা নাই। এতটা পথ কিভাবে সাইকেল চালাবো সেই চিন্তাই করছিলাম।

বেলাল ভাই অভয় দিলেন। ভাই চিন্তা কইরেন না। দই অনেক দ্রুত হজম হয়ে যায় বিশ মিনিটের মধ্যে দেখবেন সব ঠিক। তিনি আমাকে চারমাথা বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। খুব হাসফাস লাগছিল বেশি খাওয়ার কারণে। খুবই আস্তে আস্তে চালাচ্ছিলাম। কানাই, বিবিরপুকুর পার হয়ে দুপচাঁচিয়া তারপর আদম দিঘি।

মেহেদি হাসান ও তাঁর বন্ধু
মেহেদি হাসান ও তাঁর বন্ধু

দুপচাঁচিয়া একটা থানা। সেখান থেকে অনেকদূর পর্যন্ত আমাকে দুই জন মাদ্রাসার ছাত্র সঙ্গ দিয়েছিলেন। দুই জনের মধ্যে একজনের নাম মেহেদি হাসান। কথাবার্তার বিষয় ছিল অন্য রকম। উনারা যেহেতু মাদ্রাসা থেকে পড়ছিলেন তাই মনে জেনারেল এডুকেশনের উপর বেশ আগ্রহ দেখলাম। কথা বলতে বলতে উনারা আমার নাম্বার নিলেন পরে ফোন দিবেন বলে আর আমার ছবি তুলে নিলেন দুয়েকটা। আমিও উনাদের দুয়েকটি ছবি তুলে নিলাম।

আমতলা বাজার পার হয়ে নওগাঁ শহরে প্রবেশ করলাম। অনেক ক্লান্ত ছিলাম রুমে ঢুকেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি অন্ধকার হয়ে গেছে। রাতের খাবারের জন্য ভাল হোটেল খুঁজতে থাকলাম। লোকজনদের জিজ্ঞেস করে পেলাম একটা হোটেল। কি কি আছে জিজ্ঞেস করাতে হাঁসের মাংস পেলাম। তাই দিয়েই রাতের খাওয়া শেষ করলাম।

40595_1526594854711_3882803_n

Comments

comments

Comments

  1. কোরেশী

    তোমার লেখায় নিজের নাম দেখতে ভালোই লাগছে 😀 ।

Leave a Reply to কোরেশী Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.