একটি ব্যর্থ সাইক্লিং শুরুর গল্প

এটা তেঁতুলিয়া টেকনাফ সাইক্লিং শুরুর ব্যর্থতার গল্প বলা যায়। ‘কাক’ এ কাজ করার সুবাধে নানা রকম লোকজনের সঙ্গে পরিচয় হইত। সবাই যাঁর যাঁর মতো এটা সেটা করে। সবাই অনেক বড় বড় স্বপ্ন। অদ্ভূত অদ্ভূত স্বপ্ন। আমার মাথায় যেসব কখনো চিন্তায়ও আসে নাই ঐ টাইপের কাজ করে। কেউ সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখে, কেউ ভাল ফটোগ্রাফার হবে এমন স্বপ্ন দেখে। নানা রকম কর্মকাণ্ড। এই মানুষগুলাকে আমার কাছে অন্য রকম লাগে।

একটা ফটোগ্রাফি কোর্সের পরে ঠিক হইল দুইটা ব্যাচকে একসঙ্গে নিয়ে তাঁদের তোলা ছবি নিয়ে একটা ফটো এক্সিবিশন হবে। এক্সিবিশনটি হয়েছিল গুলশান আড়ংয়ের দিকে লিংক রোডে। গ্যালারীর নাম ছিল ‘ডটস’। ডটস এখনো জানি কিনা কে জানে। সেখানে ছাত্র-ছাত্রীরাই ফ্রেমের কাজ থেকে অনেক রকম কাজ করেছিল। তখন মনা ভাই ‘কাক’ এ একটা কোর্স করেছিলেন তিনিও সেই প্রেক্ষিতে এসেছিলেন কাজ করতে। মনা ভাই আমার সাইকেল দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এইটা কি আপনার?’ উত্তরে হ্যাঁ বলার পরে বলেছিলাম, ‘এইটা দিয়ে টেকনাফ তেঁতুলিয়া সাইক্লিং করবো।’ মনা ভাই আমার এই স্বপ্নের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘আমিও টেকনাফ তেঁতুলিয়া টেকনাফ সাইক্লিং করেছি ১৯৯৮ সালে।’ আমি তাঁর কথা শুনে খুবই অবাক! অনেক্ষণ কথা হয়েছিল এই বিষয়ে। কিন্তু কোন কারণে তাঁর ফোন নাম্বারটা আর রাখা হয় নাই।

তারপর অনেকদিন আর ঐটা নিয়া চিন্তা করি নাই। হঠাৎ করেই আবার মাথায় আসলো এই কাজটা করে ফেলা উচিত। প্রথম যেই মানুষটার সঙ্গে এইটা নিয়া প্ল্যান করেছিলাম বা শেয়ার করেছিলাম সেটা হইল সুমন আরেফীন ভাই। সুমন ভাইয়ের সঙ্গে রাসেল ভাইয়ের মাধ্যমে ‘কাকে’ই পরিচয় হয়েছিল। আমার মত সুমন ভাইয়েরও তখন বয়স অল্প ছিল তিনি শোনার প্রথম কথাতেই রাজী হয়ে গেলেন। উত্তরবঙ্গে কোথায় কোথায় তাঁর বন্ধু আছে থাকা যাবে সেটার হিশাবও হয়ে গেল। তারপর নিজেদের লোকজনকে যখন বলা শুরু করলাম অনেকেই পাগল বলা শুরু করলো। কেউ কেউ খুবই উৎসাহ দিল। বন্ধুবান্ধবের মধ্যেই অনেকই আগ্রহও দেখাইল, আমার নেংটা কালের বন্ধু বাবুও রাজি হয়ে গেল সঙ্গে তাঁর দুয়েকজন বন্ধুও যাবে ঠিক হইল। প্রথমে ছিলাম আমি আর সুমন ভাই কিন্তু একসময় দেখা গেল দলে জুটে গেছে ১০/১২ জন। কিন্তু শেষ সময়ে এসে আর কাউকেই পেলাম না। এমনকি সুমন ভাইকেও না।

প্রচণ্ড হতাশ হয়ে গেলাম। মনে হইল আর হবে না। কিন্তু তারপরে আবার মনে হইল, না এটা করতেই হবে। আবার নতুন করে শুরু করলাম অনুসন্ধান কি করা যায়। ভাবলাম একাই যাব। কিন্তু কিভাবে কি করবো? কিছুই তো জানি না। অফিসে একটা পাঠাগার ছিল ‘আহমদ ছফা স্মৃতি পাঠাগার ও মহাফেজখানা’। সেখানে একটা বই পেয়ে গেলাম। বইয়ের নাম ‘সঙ্গী সাইকেল ও আরাধ্য পৃথিবী’। লেখক আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল। বইয়ে একটা ফোন নাম্বার ছিল। উজ্জ্বল ভাইকে ফোন দিলাম। ফোনে কথাবার্তা হইলো, উনার বাসা তখন ধানমন্ডি। একদিন বাসায় যেতে বললেন আলাপ আলোচনার জন্য। কিন্তু কোন কারণে আর তাঁর বাসায় যাওয়া হয় নাই তখন। আর উনার বই পড়ে কথাবার্তা বলে বুঝতে পারলাম উনি দেশের চাইতে দেশের বাইরেই সাইকেল নিয়ে বেশি ঘুরেছেন। উনার অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান অন্য লেভেলের।

তখন যদি ফেসবুক পপুলার হইত তাহলে খুবই ভাল হইত। টিওবি অথবা বিডিসিতে একটা পোস্ট দিয়ে কত সহজে করে ফেলতে পারতাম। আমার অনুসন্ধান আর থেমে ছিল না। খুঁজতে ছিলাম কাউকে, অন্তত যে একটা ভাল দিক নির্দেশনা দিবেন। হঠাৎ মনে হইল রনি ভাইয়ের কথা। রনি ভাই আগে ‘কাক’ এ আসতেন, দোতলায় একটা অফিস নিয়ে টুকটাক কাজ করতেন নাটক বানাতেন। রনি ভাই থাকেন নারায়ণগঞ্জ কাজ করেন একুশে টেলিভিশনে। একুশে টিভির নিচে গিয়ে রনি ভাইকে ফোন দিলাম। রনি ভাই নামলেন, তাঁকে বললাম ভাই এই রকম একটা বাসনা নিয়া রাস্তায় নামবো। আপনে একটু আদেশ-নির্দেশ দেন কিভাবে কই থাকা যায়।

রনি ভাই নানা রকম গল্প করলেন। একটু সাহসও পাইলাম, তাঁর পাগলামীতে। উনারা তিন/চার বন্ধু নারায়ণঞ্জের চাষাড়া থেকে বের হয়েছিলেন। যতদূর মনে পড়ে দুয়েকজন বাসায় না বলেই বের হয়ে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে আবার একজনের সাইকেলও ছিল না। কোত্থেকে জানি একটা সাইকেল চুরি করে চালিয়ে চালিয়ে সরাসরি ঢাকার সদরঘাট। সদরঘাট গিয়েই প্রথমে লঞ্চে করে বরিশাল। তারপর ঘুরাঘুরি শুরু। প্রথমেই কোন একটা এলাকায় চেয়ারম্যানকে খুঁজে বের করতেন, চেয়ারম্যানই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। টাকা-পয়সাও খুব একটা হাতে নেন নাই। আরো নানা রকম মজার মজার ঘটনা। পুরাই থ্রিলিং ব্যাপারসেপার। এখনকার সালেহীন ভাইদের আগেও যে নারায়ণগঞ্জবাসীরা এইসব বিষয়ে একটু এগিয়ে রনি ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় না হইলে বুঝতেই পারতাম না।

যাইহৌক মোটামুটি তারিখ ফাইনাল করলাম। কোন একটা কাজে এলিফ্যান্ট রোড থেকে ঢাকা কলেজের সামনে দিয়ে নীলক্ষেতের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে মনা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। মনা ভাই জিজ্ঞেস করলেন কি খবর? বললাম ভাই মনে মনে তো আপনাকেই খুঁজতেছিলাম আগামী সপ্তাহে যাচ্ছি তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ সাইক্লিং করতে। মন ভাই হাসি দিয়ে বলেছিলেন, ‘মন থেকে চাইলে আল্লাহই সবকিছু মিলিয়ে দেন।’ তারপর কি একটা চিন্তা করে বললেন, ‘আরেকটা সপ্তাহ পেছনো যায় না? তাহলে আমিও একটু চেষ্টা করতাম।’ একটু চিন্তা করে দেখলাম এর আগে তো সবাই যাবে যাবে বলেও গেল না। হয়তো মনা ভাইও যাবে না। তবুও কি মনে করে সাতদিন পেছালাম। বললাম ঠিক আছে আগামী সপ্তাহে যাব না কিন্তু আগামী সপ্তাহে বাসের টিকেট কেটে ফেলবো।

শেষ পর্যন্ত মনা ভাইয়ের সঙ্গে শেষ করেছিলাম তেঁতুলিয়া টিকনাফ সাইক্লিং।

২১ চৈত্র ১৪২৫

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.