
ঘনবসতিপূর্ণ এলকায় থাকলে নানা রকম সুবিধা আছে। অনেক কিছু দেখা যায়। নাখাল পাড়া রেললাইন জুড়ে হরেক রকম মানুষ আসতো হরেক রকম জিনিসপত্র বিক্রি করতে। এইসব বিচিত্র জিনিশপত্রের কিছু কিছু বিষয় আমাকে বেশ আকৃষ্ট করতো। ঠিক জিনিশপত্রর জন্য আকৃষ্ট করতো না, করতো সেইসব বিক্রেতাদের নানা রকম কর্মকাণ্ডের জন্য। আমাকে যেসব বিক্রেতারা বেশি আকৃষ্ট করতেন–শাণ্ডার তেল, কাশির ঔষধ, গোলকৃমি, বাত, তাবিজ-কবজ ইত্যাদি।
একদিন এক লোক আসছে। তাবিজ-কবজ দেয়। সকল বালামসিব্বত দূর করেন তিনি। তাঁর তাবিজে নানারকম গাছপালা। পুরুষ লজ্জাপতি গাছ বিশেষ উপকারী। এর মধ্যে তিনি লেকচারে আরো জানালেন একটা গাছ তিনি জঙ্গল থেকে এনেছেন। সেই জঙ্গলে যেতে হলে অনেক সাহসী হতে হয়। তিনি কামরূপ কামাখ্যাও গিয়েছেন। কেন জানি এই নামটা মাথার মধ্যে ঢুকে গেল। তখন অবশ্য এই উচ্চারণে ঢুকে নাই। আমি শুনেছিলাম কারুক কামাখ্যা। এই নামটাকেন জানি মাথা থেকে আর বের হয় নাই। আর এই নামটা রাস্তার বহু ঔষধ বিক্রেতার কাছে শুনেছি।
পরবর্তীতে আরেকটা বিষয় আমার মাথার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল জানার জন্য। সেটা হইল হিন্দু ধর্ম। এর কারণ অনেকগুলা। একটা কারণ সম্ভবত জীবনে প্রথম যে মেয়েটার প্রেমে পড়েছিলাম সেই মেয়েটা। তাঁকে দেখার সময় জানতাম না তাঁর ধর্ম কি। পরে জেনে ছিলাম, কিন্তু সেই প্রেমের কথা কখনো তাঁকে বলা হয়নি। কিন্তু হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে আগ্রহটা রয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়াও অনেক কারণ আছে সেটা আরেকদিন বলা যাবে।
তো এই দুইটা বিষয়ে কোন কিছু দেখলেই পড়ি আর দেখি। এমনিতেও সবই পড়ার চেষ্টা করি কিন্তু সময় করে উঠতে পারি না। এই দুইটা বিষয় আলাদা করে বলার কারণ অনেকদিন পরে দুইটার যোগসূত্র আবিষ্কার করলাম। মানে আমার জন্য আবিষ্কার। অন্যদের জন্য হয়তো সাধারণ বিষয়। নিচে ছোট্ট করে এই গল্পটা তুলে ধরছি। এখানে কোন রেফারেন্স দিচ্ছি না, কারণ গল্পটা নিজের মতো করে বলছি। পুরা বিষয়টাই বিভিন্ন জায়গা থেকে পড়া, কিছুটা শোনা, কিছুটা দেখাও। এর মধ্যে কয়েকটা উল্লেখ করি: রাস্তার ঔষদ বিক্রেতা, আনন্দবাজার পত্রিকা, ইউটিউবে দেখা মা দূর্গা সিরিয়াল, পরিচিত কয়েকজনের কাছ থেকে গল্প শোনা এবং ইন্টারনেটের বিভিন্ন লেখা।
হিমালয় রাজের প্রাসাদে এক মহাযজ্ঞ। আর সেখানে নিজের কন্যা সতীকে নিমিন্ত্রত করা হয়নি। কারণ সতী বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে চালচুলোহীন শিবকে বিয়ে করেন। শিব বাঘের ছাল পরেন, গলায় থাকে সাপ, সঙ্গীসাথীরা ভুতপ্রেত। খবর পেয়ে সতী রেগে গেলেন, তিনি যাবেনই। স্বামী দেবাদিদেব অনেক বুঝিয়েও তাকে ঠেকাতে পারলেন না এবং অঘটন ঘটল দক্ষের প্রাসাদে। সকল অতিথিদের মাঝেই অপমানিত হলেন। কিন্তু স্বামীর উদ্দেশ্যে পিতার কটূক্তি সহ্য করতে পারলেন না। রাগে-দুঃখে তিনি সেখানেই প্রাণত্যাগ করলেন। খবর পেয়ে মহাদেব ছুটে গেলেন প্রাসাদে এবং সতীর প্রাণহীন দেহ দেখে কাধে তুলে নিলেন নিথর দেহ। রাগে-দুঃখে শুরু করলেন বিধ্বংসী নৃত্য। অনেকেই শান্ত করার চেষ্টা করলেন কিন্তু। পারলেননা। পৃথিবী ধ্বংষ হয়ে যাবে এমন অবস্থা। সেই সময় পৃথিবী রক্ষার জন্য বিষ্ণু তাঁর চক্র দিয়ে সতীর দেহ টুকরো টুকরো করে দিলেন। এক সময় শান্ত হলেন শিব।
গল্প এখানেই শেষ না। সতীর দেহ একান্ন টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা পৃথিবীতে। পৃথিবী মানে পুরা ভারতবর্ষ তখন কিন্তু বাংলাদেশও এর অন্তর্ভুক্ত। সতীর দেহের একান্ন টুকরার প্রত্যেকটি জায়গায় একটি মাতৃমন্দির স্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশেও কয়েকটা আছে যেমন: আদিনাথ।
যে কথা বলছিলাম, ‘কামরূপ কামাখ্যা’। ‘কামরূপ কামাখ্যা’ নামে একটি মন্দির আছে। সতীদেহের একান্ন টুকরার এক স্ত্রী-অঙ্গ পড়েছিল গোয়াহাটিতে। গোয়াহাটি স্টেশন থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই নীলাচল পর্বত সেখানেই এই মন্দির।
মন্দির তৈরি নিয়েও এক মজার ঘটনা আছে, নরকাসুরের ইচ্ছে হল দেবী কামাখ্যাকে বিয়ে করবেন। কিন্তু দেবী তো আর অসুরকে বিয়ে করতে পারেন না। কিন্তু দেবী সরাসরি নাও করলেন না। অসুরকে শর্ত দিলেন এক রাতের মধ্যে যদি সে মন্দির নির্মাণ করতে পারে তবেই তার সাধ পূর্ণ হবে। অসুরও কম যায় না, প্রবল উৎসাহে অসুরও কাজে নেমে পড়ল। রাত শেষ হওয়ার আগেই মন্দিরের কাজ প্রায় শেষ। দেবীও কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন বিপদ বুঝে মন্দিরের সিড়ি বানানো শেষ হওয়ার আগেই এক মোরগ ছেড়ে দিলেন। ভোর না হতেই সে ডেকে উঠল। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময় শেষ। অথচ কাজ তখনও বাকি। তাই নরকাসুরের আর দেবীকে বিয়ে করা হল না। অনেকের মতে বর্তমান মন্দির সেই নরকাসুরেরই তৈরি।
এভাবেই কৃষ্ণ থেকে শুরু করে দেব-দেবীরা নানারকম ছলনা করে অসুরদের সঙ্গে জয়ী হয়ে আসছে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় দেবতাদের চাইতে বুঝি অসুররাই বেশি শক্তিশালী। শুধু ছলনার কারণে তাঁরা দেবতাদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারে না।
এক সময় আমি বাজার থেকে এক রঙ্গের টি-শার্ট কিনতাম। সেখানে নিজেই নানা রকম শব্দ লিখতাম। একবার এক টি-শার্টে লিখলাম ‘অসুর’। তখন আমি ‘তেজগাঁও মডেল স্কুলে’র নবম শ্রেণির ছাত্র। স্কুলের এক স্যার পথে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি তোমার টি-শার্টে অসুর লিখছো কেন? তুমি যান অসুর অপদেবতা? লিখলে কোন ভাল দেবতার নাম লিখ, অপদেবতা কেন? ফাজিল!’