প্রতিদিন বাসা থেকে অফিসে আসার সময় মাথার মধ্যে দুয়েকটা গল্প ঘোরাফেরা করে। গল্প বলতে ছোট ছোট ঘটনা যার ভিতর দিয়ে আমি এসেছি এগুলোকে ছোট ছোট স্মৃতিচারণও বলা যেতে পারে। প্রতিদিন যে একটা ঘটনাই মনে পড়ে তা না, অনেকগুলা। প্রতিদিনই ভাবি আজ একটা লিখবো। কিন্তু লেখা হয় না। লেখা হলেও যেটা ভাবি সেটা আর হয় না। এই লেখাটা মনে হয় যেটা নিয়ে ভাবতেছিলাম সেই বিষয় নিয়েই লিখতেছি।
ছোটবেলায় একটা ঘটনা মনে দাগ কেটেছিল। এলাকায় এক বাসায় খুব শোরগোল, আশেপাশের অনেক বাসা থেকে লোকজন ঐ বাসায় ভিড় করেছে। বেশিরভাগই মহিলা, বাইরের লোকজনগুলা ফিসফিস করে কথা বলছেন। কেউ কেউ জোড়ে জোড়ে। আর যে বাসা নিয়ে ঘটনা সেই বাসা থেকে শুধুই কান্নার শব্দ, মা এবং মেয়ে দুইজনেরই। যাঁদের বাসায় এই ঘটনা তাদের সবাইকেই আমি চিনি। কিন্তু এত শোরগোলের কাহিনী পরিষ্কার না আমার কাছে। আর আমি যেহেতু অনেক ছোট ছিলাম তাই আমাকে ঝাড়ি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু দূরে সরিয়ে দিলেও এই ঘটনার জানাজানির আর বাকি ছিল না। মোটামুটি দাবানলের মতো ঘটনা ছড়িয়ে গেল। বাড়িওয়ালা এসে ভাড়াটিয়াদের বলে দিয়ে গেলেন বাসা ছেড়ে দিতে হবে।
ঐখানে আসলে কি হয়েছিল সেটা পরে আসতেছি। তখনকার আসেপাশের মানুষজন এখনকার মতো ছিল না। ঐ সময় নাখালপাড়ায় মোটামুটি সবাই সবাইকে চিনত। বিশেষ করে একই পাড়ায় থাকলে। আমি এখন যে এলাকায় থাকি এ এলাকার মানুষজন আমাকে তেমন একটা চেনে না। পাশের ফ্লাটে কেউ মরে গেলেও জানে না। কিভাবে যে আস্তে আস্তে সব চোখের সামনে বদলে যাচ্ছে…
যেই পরিবারের কথা বলছিলাম, সেই পরিবারটি ঐ বাসায় একদিন কি দুইদিন ছিল। তারপর তাঁরা যে কোথায় চলে গেল কেও জানল না। কোন এক রাতে সবাই চলে গেল। এক রাতের মধ্যে সবাই চলে গেল জিনিষপত্র সহ। তাঁদের বাসাটা এক মাস ফাঁকা থাকলো। তারপর নতুন ভাড়াটিয়া চলে আসলো। উনাদের সবাই ভুলে গেল। আমি কেন জানি ভুলতে পারি নাই। এলাকায় হাঁটাহাঁটি করার সময় খুঁজেছিলাম। কিন্তু আর পাই নাই, তাঁরা সম্ভবত নাখালপাড়া ছেড়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল।
প্রতিদিন যেহেতু বাসা থেকে অফিসে আসি হেঁটে তাই অনেকগুলা মুখ পরিচিত হয়ে গেছে। যেই রাস্তা দিয়ে আসি সেই রাস্তা টং দোকানগুলার চেহারা মোটামুটি পরিচিত হয়ে গেছে। দোকানদার ছাড়াও একই সময় একজনকে প্রায়ই দেখি জায়ান্ট সাইকেল নিয়ে কোথায় যেন যায়, আরেকজনের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয় সে আমার পুরানা অখ্যাত একটা রোড বাইকের মতো হুবহু একটা সাইকেল চালায় নাম ‘গোল্ডেন বাইক’। একজন জটাধারীরও দেখা পাই আবহানী মাঠের পিছনে সারাদিন ভুশভুশ করে সিগরেটের ধোয়া ছাড়ে।
আরেকজন আছে মহিলা। তাঁকে প্রায়ই দেখি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, ময়লা কুড়াচ্ছেন। ময়লা দিয়ে উনি কি করে কে জানে। মাঝে মাঝে দেখি আলমাসের পাশে ফুটপাতে শুয়ে আছেন। মাঝে মাঝে ছোট্ট টং দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। দোকানওয়ালা মাঝে মাঝে মহিলাকে রুটি অথবা বিস্কিট দেন। উনাকে আবার প্রায়ই দেখি উচ্চস্বরে গালাগালি করছেন কোন কারণ ছাড়াই। উনার মাথায় সমস্যা থাকার কারণে সবাই দেখতাম পাগলী বলে ডাকছে। দোকানদাররাও খাবার দেয়ার সময় পাগলী বলে ডাকতেন। আগে প্রায়ই রাত করে বাড়ি ফিরতে হতো তখন ধানমন্ডির বিভিন্ন ফুটপাতে তাঁকে দেখতাম একটা বস্তা বিছিয়ে ঘুমাচ্ছেন। বেশিরভাগ সময়ই ডাস্টবিনের পাশে ঘুমাতেন।
গত এক দুই বছরে উনাকে প্রায়ই দেখতাম। হঠাৎ করে অনেকদিন যাবৎ উনি হারয়ে গেলেন। রাস্তা দিয়ে হাঁটি কিন্তু উনাকে আর দেখি। রাস্তার সবকিছুই আগের মতই, পরিবর্তন বলতে নতুন নতুন কিছু দালান আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। শুধু ঐ মহিলাটা নাই।
অনেকদিন পরে মহিলার দেখা পেলাম আবার। তাঁর শারিরীক অবস্থা দেখেই বুঝতে পারলাম পৃথিবীতে নতুন কেউ আসতেছে। এখন আমার চিন্তার ধরন কিছুটা পাল্টে গেছে। আগে চিন্তা করতাম মহিলাকে নিয়ে। কিন্তু এখন আমার মাথার মধ্যে চিন্তার পুরাটা ঘুরে চলে গেছে সেই মানুষটার উপরে যেই মানুষটা ভিতরে আছে।
সে কি পৃথিবীতে আসবে? নাকি আসবে না? আর যদি আসে তাহলে সে কিভাবে বড় হবে? সীতা হয়ে নাকি ঈসা অথবা যীশু হয়ে? এখন তো আর যীশু অথবা সীতার যুগ নাই। তাহলে সে কার মতো হবে…

