সকালের নাস্তা

আজকে সকালে নাস্তা খেতে খেতে চিন্তা করতেছিলাম, আমার সকালের নাস্তার মধ্যে কয়েকটা বিবর্তনের মধ্যে দিয়া গেছে। ছোট বেলায় যা খেতাম এখন আর তা খাচ্ছি না। একটু একটু করে পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তনের পাশাপাশি অনেক নতুন নতুন নাস্তার সঙ্গে পরিচিতও হয়েছি যা আগে জানতাম না। জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে মানে যখন থেকে বুঝতে শিখেছি বলা যায় সেখান থেকেই শুরু করা যাক। আমি যখন লিটল জুয়েল প্রি-ক্যাডেট স্কুলে পড়তাম তখন সকালে নাস্তায় ছিল আটার রুটি আর দোকানে পাওয়া যেত এমন দুই টাকা দামের লাড্ডু মাঝে মাঝে সন্দেশ। আমরা ছোট দুই ভাই একটা কাজ করতাম। একজনে লাড্ডু চাইতাম আরেকজন সন্দেশ চাইতাম। এটা দুই ভাই যুক্তি করেই চাইতাম। তারপরে এই লাড্ডু সন্দেশ একসঙ্গে মিক্সট করে ফেলতাম। তারপর রুটি দিয়ে খেতাম। বাসায় অনেক পাতলা করে রুটিটা বানানো হতো, খেতে অনেক ভাল লাগতো।

কিছুদিন পরে শিশু বাগান থেকে আমাকে স্কুলে ভর্তি করা হলো, তখনই হঠাৎ করেই আমার মেজ ভাই মারা গেলেন। আমাদের সংসারটা অদ্ভুতভাবে ভেঙ্গে পড়লো। আমরা কিছুদিন গ্রামে থাকলাম। সেখানে সকালের নাস্তা ছিল মিস্টি আলু পোড়া কোনদিন গোল আলুর পোড়া। প্রায়ই ভাত খাওয়া হত। গ্রামে যাওয়ার পরে জানতে পেরেছিলাম যে সকালে ভাতও খাওয়া যায়। এমন কি রোজার মধ্যে ইফারেও ভাত খায় লোকজন।

গ্রামে বেশকিছুদিন থাকার পরে আমরা আবার ঢাকায় ফিরে আসলাম। ঢাকায় ফিরে উপর থেকে নিচের দিকে নামলাম, আগে থাকতাম দুই-তলায় তিন রুমের বাসায়। একরুমে বড় ভাইরা আরেক রুমে আমি ছোট ভাই বোনরা। আরেক রুমে আব্বা-আম্মা। সেই জায়গা থেকে সবাই একটা রুমের একটা বাসায় চলে আসলাম। তখন সকালের নাস্তা ছিল সেই আটার রুটির সঙ্গে শুধু চিনি। চিনি দিয়া কিভাবে খেতে হয় সেটা আব্বার কাছ থেকে শিখে ফেললাম। আব্বা আরেকটা জিনিশ শিখাইল চিনির মধ্যে পানি দিয়া ভালমতো ঘুটা দিলে চিনির সিরা হয়ে যায়। সেটাতে রুটি চুবাইয়া চুবাইয়া খেতে অনেক মজা। শীতের সময় অবশ্য এই রুটিনটা পালটে যেত তখন রুটি আর খেজুরের গুড় দিয়া খেতাম। মাঝে মাঝে ভাত দেয়া হইত, কিন্তু সেটা খেতে একদমই ভাল লাগতো না। এভাবে অনেক বছর শুধু চিনি আর গুড় দিয়াই কাটিয়ে দিলমা।

এরমধ্যে একবার পাঠাগার থেকে পহেলা বৈশাখে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে নিয়ে গেল। সেখানে মধুর ক্যান্টিনে বড় ভাইরা সকালের নাস্তা খাওয়াইল। এর আগে এই রকম নাস্তা কখনো খাই নাই। একটা চারকোনা রুটিকে ত্রিভুজ আকারে কাটা, তারপর দুই রুটির মাঝখানে ছুরি দিয়া মাখন মাখানো। এই জিনিশ সারাজীবন বাংলা সিনেমায় অথবা টিভির নাটকে দেখেছিলাম। ঐ ভ্রমণে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিলাম অনেক কিছু বড় ভাইরা খাওয়াইলেও এই নাস্তা ছাড়া অন্য কিছু মনে নাই।

পরবর্তীতে সংসারে অবস্থা যখন একটু ভাল হইল। তখন নাখালপাড়া রেইলগেটের দিকে নতুন একটা হোটেল খোলা হইল, নাম ‘আস-শামস’। সেখানে সুজির হালুয়া পাওয়া যেত খুবই মজার। আব্বাকে বলে-কয়ে রুটির সঙ্গে সেই হালুয়ার ব্যবস্থা করা হইল। আম্মা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত বলা যায় আমরা আস-শামসের হালুয়া মাঝে মাঝে সবজি কিনে এনে রুটির সঙ্গে খেতাম।

এরপরে কাজের প্রয়োজনে এলিফ্যান্ট রোডে চলে আসলাম। এলিফ্যান্ট রোডে মালঞ্চ নামে একটা দোকান থেকে রুটি আনতাম। সেই রুটি আগে কখনো দেখি নাই। অনেক পাতলা রুটি বেশ বড় হয়। এই রুটিটাকে ঐখানে চাপাতি বলতো। পরে আবিষ্কার করেছিলাম এই রুটিটাকে অনেকে রুমালী রুটিও বলে। সেই রুটিটার দাম ছিল পাঁচ টাকা। এত বড় রুটি একটাতেই হয়ে যেত আমার। প্রতিদিন রুটি আনতাম একটা আর অফিসে চিনি ছিল ফ্রি সেই চিনি আর দিয়া ছোটবেলার সেখা চিনির সিরা দিয়া খেতাম। মাঝে মাঝে চা দিয়েও খেতাম তবে লিকার ছিল অনেক পাতলা চিনি ছিল বেশি। মাঝে মাঝে অবশ্য অফিসে রাতে লোকজন থাকলে সবজি আনানো হইত সেটা দিয়েও খাওয়া হত। তখন রুটি সবজি কোন কিছুই কিনতে হতো না। এই ফ্রি খাওয়াটা যে মানুষটার কাছে বেশি খেয়েছি সে হইল শওকত ভাই।

এর পরে হঠাৎ করেই বলা যায় অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম। ভ্রমণে গিয়ে নানা রকম পদের সকালের নাস্তা খাওয়া হতো যা আগে দেখা হয় নাই। এমন একটা ট্রিপ সারা জীবন মনে রাখার মতো একটা ট্রিপ ঢাকা থেকে সেন্ট মার্টিন গিয়েছিলাম নৌকায় করে। সেই ট্রিপে রাহাত ভাইয়ের ক্যামেরায় অনেকগুলা ছবি-তুলে ছিলাম। ভ্রমণ থেকে ফেরার পরে হঠাৎ একদিন রাতে রাহাত ভাইয়ের ফোন, ‘তুই সকালে আসিস, দেরি করিস না।’ আমি খুবই এক্সাইটেড হয়ে গেলাম, ভাবছিলাম আমার জন্য মনে হয় রাহাত ভাই তাঁবু ম্যানেজ করতে পারছে।

সকালে রাহাত ভাইয়ের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। রাহাত ভাইরা তখন দারুস সালামের অনেক বড় একটা বিল্ডিংয়ে থাকেন। ঐ এলাকায় মনে হয় এত বড় বিল্ডিং ছিল না। অ্যাপার্টমেন্টের নামটা এখন আর মনে নাই। তবে রাহাত ভাই নিচেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমি যাওয়ার পরে আমরা রুটি কিনে বাসায় ঢুকলাম। আমাদের ভ্রমণের সব ছবি একটা সিডিতে করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। বুঝলাম তাঁবু-টাবু কিছু না, এই ছবি দেয়ার জন্যই আনিয়েছেন।

আমাকে বসিয়েই তিনি ডিম ভাজলেন আমাদের দুইজনের জন্য। আমরা যে রুটি আনছিলাম সেই রুটি নিয়া বসলেন সঙ্গে একটা মেশিন। এই মেশিনে রুটি ঢুকিয়ে দিলেন কিছুক্ষণ পরে রুটিটা টাস করে শব্দ করে ভিতর থেকে বের হয়ে আসলো। আমি তো পুরাই থ। এই জিনিশ আগে কখনো দেখি নাই। দুইজনে রুটি আর ডিম ভাজি খেলাম। নতুন করে আরেকটা জিনিশ শিখেছিলাম, এভাবেও নাস্তা করা যায়।

এলিফ্যান্ট রোডে কাজ করতে করতেই ডিসিসিআইয়ের একটা কাজ পেয়েছিলাম। কাজটা করতে হইত বনানীর একটা অ্যাডফার্মে। প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল, ‘স্পেলবাউন্ড’। এই কাজে ঢুকে আমি ৭/৮ দিন সূর্যের মুখ দেখি নাই। পুরাটা সময় অফিসে থাকতাম। একটা গামছা নিয়া গেছিলাম সেটা দিয়েই গোসল করতাম অফিসে থাকা-খাওয়া সব কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত। ঐ অফিসের প্রধান ডিজাইনার রেজা ভাইও মাঝে মাঝে অফিসে থাকতেন। সকালে শান্ত ভাই নাস্তার জন্য জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভাই কি খাবেন?’ আমি বললাম আপনারা যা খান তাই আনেন।

রেজা ভাইয়ের সম্ভবত এই খাবারটা পছন্দের ছিল। দুই টুকরা রুটি আর চকলেট টাইপের একটা জিনিশ। প্রথমদিন যখন খেলাম তখন খুব একটা ভাল লাগলো না। শান্ত ভাইকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারছিলাম এই জিনিশের নাম নুসিলা। শান্ত ভাইকে বললাম, ‘ভাই কাল থেকে আমার জন্য রুটি আর সবজি আইনেন।’ তবে সেদিনও সকালের নাস্তার নতুন একটা আইটেম দেখতে পেরেছিলাম। আর নুসিলা নামে একটা জিনিস আছে সেটাও হয়তো জানা হতো না।

অনেকদিন পরে যখন ইউল্যাবে ঢুকলাম তখন একদিন আমি সত্যি সত্যি দোকান থেকে নুসিলা কিনে আনলাম। এর আগে নাম জানতাম কিন্তু দাম জানতাম না, ২৫০ টাকা।

এভাবে হয়তো মনে করার চেষ্টা করলে অনেক নতুন নতুন আইটেমের কথা মনে করতে পারবো, যা আমার জন্য বেশি বয়সে এসে নতুন নতুন শিক্ষা। আজ এ পর্যন্তই থাক।

বর্তমানে আমাদের সকালের নাস্তা ডিম আর রুটি।

৫ বৈশাখ ১৪২৭

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.