ভালোবাসার চিঠি

এক
দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। বাসা নাখারপাড়ার পোস্ট অফিসের গলি। পোস্ট অফিসের পাস দিয়ে একটি গলি ঢুকে গিয়েছে তাই এই গলির নাম পোস্ট অফিসের গলি। সেই গলিতে একরুমের একটি বাসায় আমরা ভাড়া থাকি। আমরা পরিবারের ছয় জনের সবাই এক রুমেই থাকি। রুমটিতে দুইটি জানালা। একটি জানালার মুখোমুখি আরেকটি বাসার বিশাল বারান্দা।

সেই বাসার পরিবারের সদস্য সংখ্যা চারজন। কনা আপা ছোট, বড় আপুটির নাম মনে নেই। খালাম্মা কোন একটা স্কুলে চাকরী করেন, খালু ব্যাংকে চাকরী করেন। কনা আপা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী, আর বড় আপুটা সম্ভবত দশম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন। পড়তেন আমার স্কুলেই, নাখালপাড়া হোসেন আলী উচ্চ বিদ্যালয়।

একদিন স্কুল থেকে দুপুরের দিকে বাসায় ফিরছি হঠাৎ এক বড় ভাই জাহাঙ্গীর ভাই ডাক দিলেন। জাহাঙ্গীর ভাইকে এমনিতেই আমি চিনতাম কিন্তু উনি আমাকে চিনতেন না। ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম কি?’ নাম বললাম। তারপর বললেন, ‘তোমাদের বাসার পাশে যে একটা মেয়ে থাকে ওর নাম কি জানো?’ আমি বললাম, ‘মেয়ে তো দুইটা কোনটার কথা জিজ্ঞেস করেন?’ তিনি বললেন, ‘ছোটটা।’ আমি বললাম, ‘উনার নাম কনা।’ উনি বললেন, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে।’ তিনি আমাকে দোকানে নিয়ে দুইটি নোনতা বিস্কিট কিনে দিলেন। জাহাঙ্গীর ভাই তখন তেজগাঁও কলেজে এইচএসসিতে পড়তেন।

কয়েকদিন পর জাহাঙ্গীর ভাই আবার ডাক দিলেন, ‘শরীফ তোমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে।’ আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কি কাজ?’ ‘কনাকে একটা জিনিস দিতে হবে।’ আমি বললাম, ‘জিনিস? কি জিনিস?’ তিনি আমাকে একটা ম্যাচের বাক্স দিয়ে বললেন, ‘এটা দিয়ে আসো।’ সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই দোকানে নিয়ে গেলেন বিস্কিট কিনে দেয়ার জন্য, আবার সেই নোনতা বিস্কিট। নোনতা বিস্কিটে আমার আপত্তি আছে বললাম, ‘ভাই মিস্টি বিস্কিট দেন। নোনতা বিস্কিট ভালো লাগে না।‘ তিনি তাই দিলেন। আমি কেন জানি সাহসের অভাবে সেই চিঠি কনা আপাকে দিতে পারলাম না। চিঠিটা ড্রেনে ফেলে দিলাম। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কাছ থেকে কখনো কখনো নোনতা কখনো মিস্টি বিস্কিট খেতে থাকলাম।

সামনে ঈদ। ঈদ উপলক্ষ্যে জাহাঙ্গীর ভাই এবার নতুন একটা উপহার দিবেন কনা আপাকে। ডাক পিয়নের দায়িত্ব আমার উপর। এবার আর ম্যাচের বাক্স না। রেপিং পেপারে মোরানো সুন্দর একটা বাক্স। সঙ্গে নিজের হাতে আঁকা মিকিমাউসের ঈদ কার্ড, ফুল আর চিঠি। এই জিনিশ তো আর ড্রেনে ফেলে দেয়া যায় না। এই জিনিস যেভাবেই হোক দিতে হবে। উপহারটা দেয়ার মোক্ষম সময় দুপুরের পর পর। তখন আশেপাশে কেউ থাকে না। সাহস করে দুপুরের পরে বারান্দার সামনে যেয়ে কনা আপাকে ডাকলাম। বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে জিনিশপত্রগুলো দিয়ে দিলাম। উপহার হাতে পেয়ে আমাকে ইচ্ছামতো বকাঝকা দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘যে দিয়েছে সে তোকে কি দিয়েছে?’ আমি বললাম, ‘বিস্কিট খেতে দিয়েছে।’ তিনি বললেন, ‘আর কখনো এইসব জিনিশ আনবি না। ঐ ছেলে বিস্কিটে থুথু দিয়ে তোকে খেতে দিয়েছে। তোর অসুখ হবে মনে থাকবে?’ মাথা হ্যাঁ সূচক কাত করে চলে আসলাম।
বলে রাখা ভালো মিকি মাউসের ঈদ কার্ডটা আমার অনেক পছন্দ হয়েছিলো তাই কার্ডটা দেই নাই।

কনা আপার কথায় আমার মন গললো না। কারণ আমি নিজের চোখে দেখেছি জাহাঙ্গীর ভাই আমাকে বিস্কিট দোকান থেকে কিনে দিয়েছেন থুথু দেয়ার সময় কোথায়!

এর পরে বহুবার জাহাঙ্গীর ভাইয়ের চিঠি কনা আপাকে দিয়েছি তিনি নিয়েছেনও। জানালা দিয়ে দেখতাম কনা সেই চিঠি পড়তেন, মাঝে মাঝে আপন মনে হাসতেন।

একদিন বিকেলে হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, খুলে দেখি বাড়িওয়ালার ছোট ছেলে। আমাকে বললেন, ‘বের হয়ে আসো, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।’ বের হয়ে গেলাম, বাইরে দেখি আরো কিছু ছেলেপেলে। বারান্দায় কনা আপার আব্বা। যা বুঝার বুঝে ফেললাম। বাড়িওয়ালার গুণ্ডা ছেলে আমাকে নিয়ে গেলেন যেখানে জাহাঙ্গীর ভাইরা আড্ডা দেন। গিয়েই প্রথমে জাহাঙ্গীর ভাইকে দুই গালে দুই চর। তারপর নতুন বাড়ি বানাচ্ছে এমন একটা বাড়িতে নিয়ে তাঁকে ভালোমতো পেটানো হলো। আমি সেখানে ছিলাম না। তবে ভাইয়ার জন্য অনেক খারাপ লেগেছিলো। অভিমান করে কনা আপার সঙ্গেও কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। উনি ডাকলেও যেতাম না।

এই ঘটনার অনেকদিন পর্যন্ত জাহাঙ্গীর ভাইয়ের দেখা পাওয়া যায় নাই। বেশ কিছুদিন পর তাঁর দেখা পেয়েছিলাম। ঐ বাসায় যতদিন ছিলাম প্রায়ই জাহাঙ্গীর ভাই আমাকে নোনতা বিস্কিট খাওয়াতো। জিজ্ঞেস করতেন, ‘কনা কেমন আছে?’ এই পর্যন্তই। আর কখনো কনা আপাকে চিঠি দেন নাই। শুধু কনা আপার স্কুল ছুটির সময় পোস্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন কনা আপাকে দেখার জন্য।

ঐ বাসা ছেড়ে দেয়ার পর আর কখনো জাহাঙ্গীর ভাইয়ের দেখা পাইনি। এখনো পর্যন্ত না, কোথায় যে হারিয়ে গেল আল্লাহ জানে।

দুই
চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। থাকি এগার নাম্বার গলিতে। আমরা সমবয়সী ছিলাম প্রায় পাঁচ/ছয় জন। আমি হিমেল, রাজিব, বাবু, পাভেল, বাপ্পি, তমহা। সবাই একসঙ্গে ক্রিকেট খেলি ফুটবল খেলি। আমাদের চাইতে বয়সে একটু বড় হলেই সবাই বড়দের মামা ডাকি। এইরকম একজন ছিলো অপু মামা। তিনি টাঙ্কি মারতেন অন্য এক গলির চার তলার এক মেয়ের সঙ্গে। সেই মেয়ে চার তলার ছাদে টবে ফুল গাছে পানি দিতে আসতো প্রতিদিন বিকালে। মামাও প্রতিদিন বিকালে ছাদে দাঁড়িয়ে ইশারায় কথা বলতেন। কিভাবে যে এতদূরে থেকে ইশারায় কথা বলতেন আল্লাহ জানে। তাঁরা টিএনটি ফোনেও কথা বলতেন। তখন মোবাইল ছিলো না।

একদিন মামার কি ঝোক উঠলো। আমাকে বাসা থেকে বের করে নিয়ে আসলেন। বললেন, ‘শরীফ চল তোর কাজ আছে।’ আমাকে রিক্সায় করে নিয়ে গেলেন ড্রাম ফেক্টরি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছেই। সেখানে গিয়ে বারটা ফুলগাছের চারা কিনলেন। বাসায় ফিরে বারান্দায় রেখে আবার বের হলেন এবার বাজারে, বাজার থেকে ১২ টা টব কিনে আনলেন। সব আনার পর বললেন, ‘আজকের কাজ শেষ, আবার কালকে আসিস।’ পরের দিন শাহীনবাগ থেকে মাটি আনলাম বস্তা ভরে। তার পরের দিন শাহিনবাগ থেকে এক রাখালের কাছ থেকে গোবর আনা হলো। এইসব ছাদে বসে মিক্সট করা গাছ লাগানো, অনেক মজা।

সাতদিন পর মামা আমাকে ছাদে নিয়ে গেলেন। আমাকে একটা বিল্ডিং দেখিয়ে বললেন, ঐ বিল্ডিংয়ের ছাদে এই ফুল গাঁছটা রেখে আসবি। এই নে টাকা রিক্সা দিয়ে যাবি। কিসের রিক্সা কিসের কি টব মাথায় করে হাঁটা দিয়ে রেখে আসলাম বিল্ডিংয়ের ছাদে।

জাহাঙ্গীর ভাই আর অপু মামার কথা চিন্তা করলে মনে হয়, কি পাগলামিটাই না করেছিলেন আরেকজনের জন্য। কিন্তু সেই পাগলামির মধ্যে অদ্ভূত এক ভালোবাসা ছিলো, ভালো লাগা ছিলো। মাঝে মাঝে মনে হয় বেঁচে থাকতে হলে এই ধরনের পাগলামির জন্যই বেঁচে থাকা উচিত।

জীবনটা আসলেই অনেক সুন্দর।

Comments

comments

Comments

  1. mreedul

    বাহ

  2. sayan sarkar

    thanks for you

  3. zahirul Islam

    মনে পড়ে যায় অনেক কিছু। 🙂

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.