নেফারতিতি

DSC00297

বেশিরভাগ সময়ই স্কুল ছিল আমার খারাপ লাগার জায়গা। তাই আমার স্কুল জীবনের বেশিরভাগ সময় গেছে স্কুল পালিয়ে। সবচাইতে বেশি স্কুলে গিয়েছি যে বছরে সেই বছরটা ছিল আমার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়। পুরা বছরে মাত্র ১০/১২ দিন অনুপস্থিত ছিলাম। এটা ছিল আমার জন্য অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কারণ আমি সাধারণত স্কুলে বছরে ১০/১২ দিন যেতাম। ঐ বছরে স্কুলে যাওয়ার মূল কারণ ছিল হেলেনা আপা। হেলেনা আপা আমাদের বাংলা পড়াতেন। বলা যায় হেলেনা আপার প্রেমে পড়েই অবিশ্বাস্যভাবে অনেকদিন ক্লাসে ছিলাম। আজকে অবশ্য আমার প্রেমের গল্প বলার জন্য এই ব্লগ লিখছি না। সেই গল্প আরেকদিন বলব।

আমরা তখন এগার নাম্বার গলিতে থাকি। এলাকায় মোটামুটি সমবয়সী অনেক ছেলেপেলে। এর মধ্যে একই ক্লাসে পড়ি এমন ছেলেদের সংখ্যা কম না। আমি, বাবু, পাভেল, হিমেল, রাজিব, বাপ্পি। আমাদের সবার মধ্যে বাবু আর তমহা ছাড়া সবাই হোসেন আলী স্কুলেই পড়তাম। সব বন্ধুদের মধ্যে বাবু ছিল সব চাইতে পুরনো বন্ধু। আমরা একসঙ্গে লিটল জুয়েল প্রি-ক্যাডেট স্কুলে পড়েছি। পরবর্তীতে বাবু চলে গেল বিজ্ঞানে আর আমি হোসেল আলীতে।

একবার এলাকাতে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হল। দুই দলের টুর্নামেন্ট। এলাকার বড়রা শরীফ মামা তাবন ভাইরা এই আয়োজন করল। মুখোমুখি আমরা সমবয়সী ছয় খেলোয়াড়। আমার দলে আমি বাবু আর সম্ভবত তমহা। সেই খেলায় আমরা পাভেল-হিমেলদের সঙ্গে হেরে গেলাম। হারার পর সব পুরষ্কার পাভেলরা নিয়ে গেল। আমাদের অধিনায়ক ছিল বাবু। খেলায় হেরে বাবু প্রচণ্ড কান্নাকাটি করল। আমি আর তমহা নিশ্চুপ। এইরকম আরেকটা টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হলো। এই খেলায় বাবু আমার বিপক্ষে। সেই খেলাতেও বাবুরা হেরে গেলো। হারার পর আবার সেই একইভাবে হাউমাউ করে কান্নাকাটি।

এক সময় বাবুদের চেরাগ আলীতে জায়গা কেনা হল। আমাদের বিদায় জানিয়ে চেরাগ আলী পাড়ি জমালো। যাওয়ার দিন সকালে আমি আর পাভেল এগিয়ে দিতে গেলাম। বাবুরা বেবিটেক্সিতে করে আমাদের ছেড়ে চলে গেল। বাবুরা যাওয়ার সময় আমি আর পাভেল খুব স্বাভাবিক ছিলাম। বেবিটেক্সি যখন চলে গেল। আমরা গলিতে ঢুকলাম। গলিতে ঢুকেই পাভেল আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলে। আমিও কান্না ধরে রাখতে পারি নাই।

প্রথম দিকে বাবু প্রতি বৃহস্পতিবার চলে আসত। আবার শনিবার ভোরে চলে যেত। আমরা শুক্রবার সারাদিন খেলতাম এখানে সেখানে ঘুরতাম। আগে যখন বাবু এলাকায় থাকত, তখন আমরা প্রায়ই ভিডিও গেম খেলা দেখতে যেতাম। আমার কাছে টাকা থাকলেই খেলতাম। কিন্তু বাবু কখনও খেলত না, শুধু দেখত। ওর কোন রকম এই ধরনের নেশা ছিল না। সব সময় পড়ালেখা নিয়েই থাকত। আমাদের সবার মাঝে ভাল ছাত্রও ছিল। বাবুর জন্য আমি আর পাভেল মিলি খালাম্মার কাছে বকাও খেতাম। ঈদের দিনটা ছিল আমাদের জন্য অনেক আনন্দের। আমরা বাবুর জন্য অপেক্ষা করতাম, বাবু আসলে ঈদের সালামী খরচ করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় চলে যেতাম দল বেঁধে।

বাবুরা চলে যাওয়ার পর কয়েক বছর ওদের জায়গায় এক হিন্দু পরিবার আসল। তখন আমরা নবম/দশম শ্রেণিতে পড়ি। ঐ হিন্দু পরিবারের এক মেয়েকে আমার প্রচণ্ড ভাল লাগত। ঐ বয়সে মোটামুটি সবারই মনে মনে কাউকে না কাউকে ভাল লাগে। কারো কারো প্রকাশ্যেও। বাবু ছিল পুরা উল্টা। ও পড়ালেখা ছাড়া অন্য কিছুর দিকে তাকানোর সময়ই ছিল না। সব সময় যা করবে একটু চিন্তা ভাবনা করেই করত। সেই ভাল লাগা, ভাল লাগা পর্যন্তই ছিল আমার। বেশি দূর এগুতে পারে নাই।

আমরা একসঙ্গে যেই কাজটা বেশি করেছি সেটা হল কনসার্টে যেয়ে গান শোনা। এ ছাড়াও অনেক কাজ আমরা এক সঙ্গে করতাম। দেখা গেল জামা-কাপড় কেনা দরকার বাবু নিউমার্কেটে যাবে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেত। দেখা গেছে টি-শার্ট কেনা হইছে দুইটা কেনা হল। একটা আমার একটা বাবুর। আমাদের বন্ধুত্বটা ছিল এই রকম।

বাবুর আবার নামের ব্যাপারে একটা কাহিনী ছিল। বাবু নামটা বলা যায় পারিবারিক। যেমন নাখালপাড়ায় থাকার সময় ওর স্কুলের নাম ছিল সাজ্জাদ। আমরা এলাকায় ডাকতাম বাবু। কিন্তু চেরাগ আলী যাওয়ার পর নিজের নাম পাল্টে রেখে দিল রূপক। এখন ঐ এলাকায় গেলে বাবু নামে মনে হয় তেমন কেউ চেনে না। রূপক নামেই সবাই সম্ভবত চেনে।

একবার বেশ সময় নিয়ে প্ল্যান করলাম আমরা কক্সবাজার যাব। অনেক প্ল্যান করার পর ঠিক হল চেরাগআলী থেকে ওর কয়েকজন বন্ধু যাবে আর আমি এখান থেকে যাব। শেষ পর্যন্ত ওর বন্ধুদের নানারকম সমস্যা কারণে কেউ যেতে পারবে না। ওদের বন্ধুদের জন্য বাবুও যাবে না ঠিক করল। আমার প্রচণ্ড রাগ হল। আমি রাগ করে কমলাপুর চলে গেলাম টিকেট কাটতে। কি মনে করে ফোন দিলাম বাবুকে বলে দিলাম তুই না গেলে নাই। আমি টিকেট কাটতে আসছি, এখন কাটব তুই গেলে বল তোর জন্যও কেটে ফেলি। কেটে ফেললাম দুইজনের টিকেট। আমাদের দুইজনের প্রথম সমুদ্র দেখা একসঙ্গে, সেটা এক অসাধারণ মুহূর্ত।

আমাদের মধ্যে মাঝে মাঝে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হলেও বিশেষ বিশেষ সময়ে আমরা একজন আরেকজনকে মনে করে থাকি। যেমন আমার মা যাওয়ার পর বাবুকে ফোন দিয়ে জানানো। পরের দিন বাবুর চলে আসা ছিল খুবই স্বাভাবিক। আবার ওর মা মারা যাওয়ার পর কয়েকদিনের মধ্যেই বাবুও চলে আসল দেখা করার জন্য। বিশেষ কোন কিছু ঘটলেও একজন আরেকজনকে অন্তত জানানোটা ছিল ফরজ।

আমি তখন তেঁতুলিয়া টেকনাফ হাঁটা ট্যুরে। তখন বাবুর কাছ থেকে মোটামুটি একটা সবুজ সংকেত পেলাম। শেষ পর্যন্ত কোন এক নেফাতিতির দেখা পেয়েছে এবং গভীরভাবেই তাঁকে চায়। সেই খবরটা আমার জন্য ছিল একদমই অন্য রকম। ঐ ভ্রমণেই নেফাতিতির সঙ্গে আমার কথাও হল। নেফাতিতি আমার এক অদ্ভূত নামও দিল “সেলিব্রেটি”। সে আমার কিছু পত্রিকার নিউজও কেটে রাখত।

দোস্ত এখন বুঝতে পারতেছি তোদের মধ্যে একটা টানা-পূরণ চলছে। জানি না এটা কোথায় থামবে…

তোকে শান্তনা দেব না, আমি শান্তনা দিতে জানি না। সময়ের উপর সব ছেড়ে দেই। সময়ই সব বলে দিবে। শুধু এটুকুই বলব তুই ছোট বেলা থেকেই বড্ড বেশি, “আবেগপ্রবণ”…

নেফারতিতি–মেঘদল

যাচ্ছো চলে নেফারতিতি
বিষন্ন চুল উড়ছে হাওয়ায়
সবুজ আকাশ দূরে সরে যায়
পথের এখনো কিছুটা বাকি…

এখনি নামবে সন্ধ্যা
পৃথিবীর পুরনো পথে
ল্যাম্পোস্ট নতজানু
প্রার্থনায় একা দাঁড়িয়ে থাকে

হাত বাড়িয়ে ছুয়ে দিতে তুমি পারো না
একা চাঁদ চাঁদের কঙ্কাল
হেটে যেতে যেতে ভুল পথে তুমি থামো না
খুজো না উদার আকাশ
কিছু সূর্যবন্দী মেঘ
কিছু বিস্মরণের নদী
বয়ে যায় তোমার আত্মার কাছাকাছি
নেফারতিতি

যাবেই চলে চলে নেফারতিতি
বিষন্ন চুল উড়ছে হাওয়ায়
সবুজ আকাশ দূরে সরে যায়
শহরে আজো বৃষ্টি নেই
তোমার শঙ্খ শরীরে জলপদ্ম রেখা
এখনি যেওনা অন্ধকারে
আমাকে ফেলে একা…

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.