সংগঠন

আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি তখন প্রথম এলাকার একটা পাঠাগারে গিয়েছিলাম। পাঠাগারের নাম ছিল ‘শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার স্মৃতি পাঠাগার’। পরবর্তীতে এই পাঠাগারের নাম পরিবর্তন হয়ে হয়েছিল ‘শহীদ বুদ্ধিবীজী স্মৃতি পাঠাগার’। ঐটাই ছিল আমার প্রথম কোন সংগঠনে যুক্ত হওয়া। তখন তেমন কিছুই বুঝতাম না।

যখন তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি তখন এলাকার চিপা গলিতে ক্রিকেট খেলতাম বড় ভাইদের সঙ্গে। সেখান থেকে একবার টুর্নামেন্ট খেলতে যাওয়া হইল বিজি প্রেস মাঠে। আমরা জিতে গেলাম একটা ম্যাচ, সেই ম্যাচে তাবন ভাই ফিফটি করে ফেললো আর কয়টা যেন উইকেন পাইল। সব মিলিয়ে তিনি ম্যান অব দ্যা ম্যাচ। ছোট্ট একটা কাপও পাইল। সেই কাপ দেখাইয়া এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমরা টাকা তুললাম। সেই টাকায় দুইটা ব্যাট, স্টেম্প, বল থেকে শুরু করে সবকিছু হয়ে গেল। আমাদের একটা ক্রিকেট ক্লাব হয়ে গেল।

সেই এলাকার বড় ভাইদের দেখেই অনেক কিছু শিখে ফেলিছলাম। বিশেষ করে কিভাবে কাজ করতে হয়, টাকা পয়সা কিভাবে তুলতে হয়। টাকা চাইতে মানুষদের সঙ্গে এপ্রোচ কিভাবে করতে হয়। বড় ভাইরা শুধু ক্রিকেট-ফুটবলই খেলতো না। নানা রকম সামাজিক কাজও করতেন। আমরা পেছন পেছন ঘুরতাম আর উনাদের ফরমায়েশ খাটতাম। যেমন ১৬ ডিসেম্বরে পুরা এগার নাম্বার গলি বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে সাজিয়ে ফেলতে হবে। যা যা দরকার সব বড় ভাইরাই যোগাড় করতেন আমরা শুধু কাজ করতাম।

তাবন ভাই, মিথুন ভাই, বাবু মামা, শরীফ মামা উনারা যখন আরো বড় হয়ে গেলেন তখন দেখা গেল উনারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। কিছুই করতেছেন না। কথায় উনারাই বুঝিয়ে দিলেন এবার আমাদের উপর দায়িত্ব। ট্রেনিং আগে থেকে নেয়াই ছিল। তাই দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছিলাম। যে বড় ভাইরা আগে চাঁদা তুলতেন এবার তাঁরা চাঁদা দিলেন। পাশাপাশি আমাদেরও একঝাক ছোট ভাই জুটে গেল। টুকু, হাফিজ, বাপ্পি, শুভ, হাসান, আল-আমিনসহ অনেকে। বিশাল বাহিনী। আমরা কয়েকজন শুধু টাকা তুললাম, পতাকা, সুতা আর আঠা বানিয়ে দিলাম। বাকি কাজ ছোট ভাইরাই করে ফেললো।

সংগঠন শুধু একটাতেই ছিলাম না। একটু বড় হতে হতে কিভাবে কিভাবে যেন অনেকগুলা সংগঠনে যুক্ত হয়ে গেলাম। নাখাল পাড়ার পাঠাগার ক্লাবের বাইরেও শাহীন বাগে টাইগার ক্রিকেট ক্লাবেও যুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সেখানেও দেখা গেছে দুই তিন জেনারেশন মিলে একটা দল হয়েছিল। অসাধারণ একটা ক্লাব ছিল সেটা। সেখান থেকে বড় ভাইদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আমি যখন সেই ক্লাবে প্রথম ঢুকি তখন সদস্যা ১০/১৫ জনের মতো। কিন্তু দিন দিন দেখা গেল সদস্য বাড়তে বাড়তে ২৫/৩০ জন হয়ে গেল। তখন মূল দলে জায়গা পাওয়াটা ছিল খুবই কঠিন কাজ।

একটা সময় টাইগার ক্রিকেট ক্লাবের বড় ভাইরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেল। তখন সবাই মোটামুটি ব্যস্ত হয়ে গেল। রিংকু ভাই, ফুয়াদ ভাই, হাবিব ভাইদের মতো অসাধারণ কিছু বড় ভাই ছিল আমাদের। যাঁরা একটা তৈরি করা ক্লাব আমার আর বাবুর হাতে ছেড়ে দিয়ে গেলেন। আমরা মোটামুটি ২/৩ বছর সেই ক্লাব চালাতে পারছিলাম। নাখাল পাড়া ছাড়ার সময় আর দায়িত্ব ধরে রাখার কোন মানে হয় না।

কিন্তু এই সংগঠনের নেশা থেকে আর বের হতে পারি নাই। কর্মসূত্রেও এমন এক জায়গায় আসলাম এখানেও সাংগঠনিক কার্যক্রম। এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভায় তখন ৮ টা শাখা ছিল। ঢাকা ফটোগ্রাফি সোসাইটি, ঢাকা ফিল্ম সোসাইটি, ঢাকা আর্ট সেন্টার, প্রকাশনাসহ আরো কয়েকটা। এইসব শাখার আবার আলাদা আলাদাভাবে পরিচালনা হতো।

এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভায় অনেক সংগঠনের জন্ম হতে দেখেছি, আবার মৃত্যুও হয়েছে। যেমন বাবু ভাইরা ‘দীপ্র’ নামে একটা সংগঠন করেছিলেন সেটা এখন আর বেঁচে নাই। আবার মোরশেদ ভাইরা ‘বাংলাদেশ চিলড্রেন ফিল্ম সোসাইটিজ’ নামে একটা সংগঠন করেছিলেন সেটি এখনো টিকে আছে এবং প্রতি বছর বেশ বড়সড় প্রোগ্রামই করে।

এইসব সংগঠনের বাইরেও সাইক্লিংয়ের কল্যাণে অনেক ঘুরাঘুরির সংগঠনের সঙ্গেও মেশা হয়েছে। কয়েকটায় আবার নিজে যুক্ত থেকে প্রতিষ্ঠার সঙ্গেও থাকতে হয়েছে। এর মধ্যে নতুন পুরানো মিলে কিছু সংগঠন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আবার নতুন কিছু সংগঠন তৈরি হয়ে অনেক বড়ও হয়ে গেছে।

এ পর্যন্ত যত সংগঠনে ছিলাম এর মধ্যে দুই শ্রেণির মানুষজন পেয়েছি। এক শ্রেণির লোকজন সংগঠন দিয়ে একা কর্তৃত্ব ফলায়। কখনো অন্যকে কাজ করতে দেয় না। নিজের জায়গা ছাড়ে না। আরেকটা শ্রেণি এরা একটা সময় অন্যকে দায়িত্ব দিয়ে দেয়। কোন এক কারণে এই দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষদের আমি ব্যক্তিগতভাবে ঈর্ষা করি। এঁদেরকে অনেক বড় মনের মানুষ মনে হয়। আমার সৌভাগ্যই বলবো এই টাইপের প্রচুর বড় ভাই-বোন পেয়েছি। এঁদের কাছ থেকেই সম্ভবত আমি সেরা শিক্ষাটা পেয়েছি।

সেই ছোটবেলার ক্লাব থেকে শুরু করে যদি বলি, এগারো নাম্বার গলির তাবন ভাই-শরীফ মামারা। টাইগার ক্রিকেট ক্লাব থেকে রিংকু ভাই-ফুয়াদ ভাইরা থেকে শুরু করে ট্র্যাভেলার্স অফ বাংলাদেশের রাহাত ভাই, রাব্বি ভাই, ফয়সাল ভাইরা নিজেরা জায়গা ছেড়ে দিয়ে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন নতুনদের জন্য জায়গা ছেড়ে দাও। একটা সময় জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। এটাই আসলে নিয়ম। নিজেও আগাও অন্যকেও আগাইতে দাও।

 

২৮ পৌষ ১৪২৬

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.