অফিস অথবা অন্যান্য কাজের বাইরে সম্পূর্ণ নিজের কিছু কাজ আছে। সেই কাজগুলার জন্য প্রতিদিন অল্প অল্প করে সময় দেই। বর্তমান পরিস্থিতে ভেবেছিলাম বেশ কিছু সময় পাওয়া গেল, এই সুযোগে কিছু কাজ এগিয়ে রাখা যাবে। কিন্তু এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি কোনভাবেই স্বাভাবিক কাজ করা যাচ্ছে না। এইসব কাজগুলা সম্ভবত স্বাভাবিক পরিস্থিতি না আসলে করা যাবে না।
মাথার মধ্যে অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয় ঘুরতেছে।
বুঝতে শেখার পরে যখন পরিবারের সঙ্গে ছিলাম এবং আম্মা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত সবাই এক সাথেই ছিলাম বলা যায়। তখন সবাই গাদাগাদি করে একটা রুমেই থাকতাম। তিন ভাই এক বোন আর আব্বা-আম্মা। সবাই একটা রুমে। ঐটাই ছিল আমাদের নিয়তি। তখন প্রাইভেসি বলে যে একটা বিষয় আছে সেটা জানতামই না। কি আজব একটা বিষয় একটা ঘরে আমরা ছয়টা মানুষ থাকি। এবং এইটা ছোট বেলা থেকেই দেখে আসতেছি। শুধু আমরা একা তাও না। আশেপাশের ঘরগুলাও এমন ছিল। হয়তো কয়েকটা পরিবার মিলে দুইটা চুলা।
এখন মাথার মধ্যে একটা প্রশ্নই ঘোরাফেরা করে, আব্বা-আম্মা আলাদা করে নিজেদের জন্য সময় কাটায় না? তাদের কি আলাদা করে কোন সময় প্রয়োজন হয়ত না?
একটু বড় হওয়ার পরে যখন আরো বুঝতে পারলাম তখন দেখি বন্ধুদের অনেকেরই আলাদা আলাদা রুম। দেখে প্রচণ্ড হিংশা হইত। ভাবতাম ইশ কবে যে আমার আলাদা একটা রুম হবে।
এমন একটা অবস্থা ছিল যে কোন বন্ধুদেরই বাসায় আনতাম না। নানা-রকম ছুতায় ওদেরকে দূরে রাখতাম। নিজেদের দৈন-দশা কাউকে দেখাতে চাইতাম না, প্রচণ্ড লজ্জা লাগতো।
এভাবেই সবার কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে রাখতে আস্তে আস্তে অনেক একা হয়ে গেলাম। কিভাবে কিভাবে যেন এই একাকীত্বকে প্রচণ্ড উপভোগ করতে শিখে গেলাম।
কিছুদিন আগে একটা তালিকা করেছিলাম সেখানে দেখা গেল প্রায় ১৪০০ মানুষের ফোন নাম্বার আছে আমার কাছে। প্রতিটা মানুষের সাথে আমার সামনাসামনি পরিচয় ছিল অথবা আছে। কিন্তু এত মানুষের ভিরেও আমিও একা। তার কারণ বেশিরভাগ মানুষের সঙ্গেই আমার চিন্তা-চেতনায় ঠিক মিলে না। সবার সঙ্গে খুব হাসিখুশিভাবে মেলামেশা করি, কিন্তু প্রতিটা মানুষই কেন জানি দূরের মনে হয়। তারা সবাই খুবই আন্তরিক তবুও কিছু কিছু জায়গায় গিয়ে আমি বুঝতে পারি আমি তাদের সাথে ঠিক মানানসই না।
আব্বা প্রতিদিন সকালে ব্যবসার কাজে বের হতেন, সন্ধ্যায় ফিরতেন। প্রতিদিনের বেচা-বিক্রির টাকা দিয়েই আমাদের প্রতিদিনের বাজার হতো। এখনকার পরিস্থিতিতে যদি পড়তাম তাহলে কি হতো? আব্বা কিভাবে এই সংসার চালাইত? এই কথাটাই মাথার মধ্যে বার বার ঘুরতেছে। বেশি হলে ৪/৫ দিন সার্ভাইব করা যেত। এর বেশি সম্ভব হইত না। এর পরে হয়তো আশে-পাশের লোকজনের কাছে হাত পাততে হইত। কিন্তু সেটাই বা কতটুকু?
যেই ছেলেটা বস্তি থেকে উঠে আসছে তার চিন্তাভাবনাও খুব সম্ভবত এমনই হয়, এটাই স্বাভাবিক আমার জন্য…
১৩ চৈত্র ১৪২৬