আমাকে কেন জানি পাহাড় খুব একটা টানে নাই। কেন টানে নাই এটা আমি জানি না। আমার নানা রকম সুযোগ বুবিধা ছিল মাউন্টেনিয়ারিং করার। বাংলাদেশে মাউন্টেনিয়ারিংকে যাঁরা এগিয়ে নেয়ার জন্য কাজ করেছেন মোটামুটি সবার সাথেই ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল অথবা এখনও আছে। পরবর্তীতে আমাদের দেশে যাঁদের আমরা এক নামে মাউন্টেনিয়ার হিসাবে চিনি তাদের মধ্যে ওয়াজফিয়া নাজরিন ছাড়া মোটামুটি সবার সাথেই ভ্রমণ করার সৌভাগ্য হয়েছে। ইন্সপায়ারেশনের কোন কমতি ছিল না বলা যায়।
তারপরেও কেন জানি আমাকে সাইকেল আর সাইকেল ভ্রমণের সময়কার মানুষই বেশি আকৃষ্ট করেছে। সেটা সমতলের মানুষই হোক আর পাহাড়ি মানুষই হোক। এটা একটা নেশার মতো। কোন কারণ ছাড়াই মানুষ দেখা, মানুষের চলাফেরা দেখা। কারও সঙ্গে কথা না বললেও মানুষের আসা-যাওয়া দেখতেও আমার কেমন জানি নেশা ধরে যায়।
২০০৮ সালে আমি যখন তেঁতুলিয়া টেকনাফ সাইক্লিং শুরু করি তখন বাবু ভাই ভারতে সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ কোর্স করছিলেন। বাবু ভাই মানে মীর শামছুল আলম বাবু। বাবু ভাইয়ের সঙ্গে তখন সরাসরি ঐভাবে পরিচয় ছিল না, একটু দূরত্ব ছিল। বাবু ভাই আমাদের এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা ওরফে কাক-এ ফটোগ্রাফির কোর্সের ক্লাশ করাতেন।
বাবু ভাই আমার ফটোগ্রাফির সরাসরি শিক্ষকও। যদিও আমার ফটোগ্রাফি করা হয় নাই কখনো।
বাবু ভাই, শওকত ভাইরা কাকের ক্যান্টিনে বসে একটা সংগঠন তৈরি করেছিলেন, নাম ছিল দীপ্র। তাঁরা ১৩ জনের একটা দল কেওক্রাডং যাবেন ছবি তুলতে। ঢাকায় ফিরে সেটার উপর ভিত্তি করে একটা ফটো এক্সিবিশন হবে। তাঁদের প্রস্তুতি থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানের সকল কাজই বলা যায় কাকের ক্যান্টিনেই হয়েছিল। এমনকি সব কিছুর পরে একটা গেট-টুগেদারও হয়েছিল কাকের ক্যান্টিনে। তখন পাহাড় সম্বন্ধে বিস্তাতির অনেক কিছু জেনেছিলাম। এর আগে অবশ্য সাইকেল ট্যুরে মনা ভাইয়ের কাছ থেকে ভাসা ভাসা পাহাড় সম্বন্ধে অনেক গল্প শুনেছিলাম।
বাবু ভাই দীপ্রর ফটোগ্রাফি এক্সিবিশনের প্রেস রিলিজ লিখতে দিয়েছিলেন ফেনির কাজী জাহিদ ভাইকে। জাহিদ ভাই আবার সেই কাজটা আমাকে দিয়ে করিয়েছিলেন। কারেকশনের সময়ই মূলত ভাইয়ের সাথে সরাসরি ভালোমতো কথা হয় বলা যায়। সেই থেকে শুরু। বিভিন্ন কাজে অকাজে নানা রকম বিষয় নিয়ে বাবু ভাইয়ের সাথে আলাপ আলোচনা।
বাবু ভাইয়ের সাথে সবচাইতে বেশি কাছাকাছি আসা হয়েছে বলা যায় নৌকা ট্রিপে। নৌকায় ঢাকা থেকে আমরা সেন্টমার্টিন গিয়েছিলাম। সেন্টমার্টিন যাওয়ার পরে সবাই ফিরে আসলেও আমি, রাহাত ভাই, বাবু ভাইরা রয়ে গিয়েছিলাম। আমি মাত্র তখন প্রথম ভোটার হয়েছি, সেন্টমার্টিনে থাকা অবস্থায় ভোট হয়। আমার অবশ্য এই পর্যন্ত কোন নির্বাচনেই ভোট দেয়ার সুযোগ হয় নাই।
নৌকা ট্রিপ ছাড়াও ভ্রমণ বাংলাদেশের অঘোষিত অফিস চারুকলার সামনে আমরা প্রতিদিন সন্ধ্যায় আড্ডা দিতাম। বাবু ভাইয়ের সঙ্গে প্রফেশনালী বেশ কিছু কাজ করা হয়েছে। পরিচয়ের পরে বাবু ভাইয়ের যতগুলা বই বের হয়েছে বেশির ভাগই বইয়েরই অক্ষর বিন্যাস আমার করা। এমনকি অনেক অপ্রকাশিত কাজও করা আছে, হয়তো ভবিষ্যতে আলোর মুখ দেখবে। প্রকাশনা বিষয়ক কাজগুলা যে শুধু অ্যাডভেঞ্চার কেন্দ্রিক ছিল তা না। বাবু ভাইয়ের আরেকটা বড় পরিচয় হলো তিনি চলচ্চিত্র বিষয়ে অনেক গবেষণা করেন।
এই ধরনের কাজের বাইরেও একটা রিয়েলিটি শোয়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম বাবু ভাইয়ের সাথে। সেটা ছিল হরলিক্স ফিউচার ফোর্স। রাহাত ভাই, সনি ভাই, ইশতিয়াক ভাই, তুষার ভাই, অভি ভাইসহ আরো অনেকে মিলে প্রায় তিন সপ্তাহের মতো গাজিপুরে ছিলাম। সেখানে একদম সরাসির মাউন্টেনিয়ারিংয়ের বিভিন্ন ইকুয়েপমেন্ট সম্বন্ধে জানতে পেরেছিলাম, ব্যবহারও করতে পেরেছিলাম। এমনকি আমরা প্রতিদিন কাজের পরে রুমে পাহাড় বিষয়ে নানা রকম সিনেমাও দেখতাম। অবসর সময়ে আর্টিফিসিয়াল রকে ক্লাইম্বিং প্রেকটিস করতাম।
একবার রাহাত ভাই রাব্বি ভাইরা পাহাড়ের দিকে ট্রিপ আয়োজন করতেছিলেন। এদিকে বাবু ভাই মাসুদ ভাইরাও প্ল্যান করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত বাবু ভাইদের সঙ্গে গেলাম, সেটাই ছিল বলা যায় প্রথম পাহাড়ে যাওয়া। বড় পাথরে আমরা একপাশ থেকে আরেক পাশে রিভার ক্রসিং করেছিলাম দুই পাশে দড়ি টানিয়ে। সেই ট্রিপে অবশ্য রাব্বি ভাইদের সাথে দেখাও হইছিল।
হরলিক্স ফিউচার ফোর্স প্রোগ্রাম থেকে ফেরার পরে বাবু ভাই আমাকে আর ইশতিয়াক ভাইকে সুন্দর একটা অফারও দিয়েছিলেন। রাহাত ভাইকে দিয়েছিলেন কিনা মনে নাই। আমাদের দুইজনকে বলেছিলেন, ‘তোমরা যদি বেসিক মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স করতে যাও অর্ধেক খরচ আমি দিব।’ তখন বেসিক কোর্স করতে ২০০ ডলার লাগতো, অর্থাৎ আমরা যদি কোর্স করতে যাই তো বাবু ভাই নিজে ১০০ ডলার দিবেন। আর বাবু ভাই ঐ প্রোগ্রামের ব্যবহৃত একটা হ্যালমেট দিয়েছিলেন সাইক্লিংয়ের জন্য। সেটাই আমার প্রথম হ্যালমেট। এখনো আছে ব্যবহার করা হয় না।
বাবু ভাই এভাবেই পাহাড়ে নেয়ার জন্য আমাদের নানাভাবে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। দেখা গেল আমরা সেন্টমার্টিন যাচ্ছি বাবু ভাই সব ইকুইপম্যান্ট নিয়ে যাচ্ছেন। আমরা সেখানে গাছের মধ্যে ঝুলাঝুলি করতেছি অথবা রাহাত ভাইয়ের বাড়িতে যাচ্ছি সেখানে জিনিশপত্র নিয়া হাজির। লোকজনদের ক্যারাবিনার, ফিগার অপ এইট, জুমারসহ নানা রকম ইকুইপমেন্টের সঙ্গে পরিচিত করছেন।
সত্যি কথা বলতে এই একটা মানুষকে দেখলাম মানুষকে পাহাড় সম্বন্ধে নানারকম সহযোগিতা করে গেছেন এখনও যাচ্ছেন। আমার সাথে হয়তো বেশিরভাগ বর্তমান অথবা আগের তরুণ প্রজন্মও একমত হবেন বাবু ভাইকে পাহাড় সম্বন্ধে সহযোগিতা চেয়ে পান নাই এমন খুব কমই হয়েছে। বরং অন্যান্য অনেক সফল মাউন্টেনিয়াররা কোন এক অজানা কারণে একটু দূরে দূরেই ছিলেন। অথবা নতুন নতুন বেশিরভাগ আগ্রহী পাহাড় প্রেমিরা সহযোগিতার জন্য অন্যান্যদের কাছে যাওয়ার আগে বাবু ভাইয়ের কাছেই গিয়েছেন।
এটা কেন হয়েছে? সেটা অবশ্য একটা বড় প্রশ্নেরই বিষয়ই।
এই করোনার দিনে মেঘদলের ভোকাল শিবু কুমার শীলের একটা ইন্টারভিউ দেখতেছিলাম। সেখানে অ্যাঙ্কর শিবুদাকে একটা প্রশ্ন করলেন। প্রশ্নটা ছিল এমন, দাদা আপনার সম-সাময়িক ব্যান্ড শিরোনামহীন, আর্টসেল, ব্ল্যাক থেকে শুরু করে অনেক ব্যান্ডের ভোকাল বেশ বিখ্যাত। কিন্তু আপনে তো অত বিখ্যাত না এটা আপনার কেমন লাগে?
শিবুদার এক কথার উত্তর ছিল- কষ্ট হয়, খারাপ লাগে। পরে আবার তিনি আরেকটা সুন্দর উত্তর দিয়েছিলেন। আমার মনে হয় সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দাদা বললেন, বিখ্যাত না হওয়ার একটা সুবিধাটাও আছে সেটা হলো আমি আমার কাজটা করতে পারছি, আমি যে গানটা করতে চাই সেটা করতে পারছি। আমি সাধারণ মানুষদের মতো লোকাল বাসে উঠতে পারছি। আমার মধ্যে কোন চাপ নাই।
আমার মনে হয় বাবু ভাইয়ের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টা সত্যি। বাবু ভাইকে যে আমরা ডাকলেই পাই, যে কোন জায়গায় চলে যেতে পারেন এটা সম্ভবত চাপহীন হওয়ার কারণেই। আর এই চাপহীন থাকাটাও খুব একটা সহজ বিষয় না। কারণ আমরা সবাই-ই আসলে একটু হলেও বিখ্যাত হতে চাই। আমি নিজেও আসলে কোন না কোন ভাবে বিখ্যাত হতে চাই।
আর আমার মনে হয় বিখ্যাত হওয়ার আগ পর্যন্তই সবাই সবার বেস্ট কাজটা করে।
৮ বৈশাখ ১৪২৭
ছবিটা কে তুলছিল মনে নাই। রাহাত ভাই অথবা রাব্বি ভাই হবে।
