
পরে এই ঘটনা সম্পর্কে নানা গল্প শুনেছিলাম। কোনও একটি লোক নাকি একেবারে উধাও হয়েছিল আর একটি লোক নাকি গুরুতর আঘাতে অনেক দিন শয্যাশায়ী ছিল। এখন কথা হল এমন হয় কেন?
নবপরিচিত বাংগালীর সংগে খাবারের ব্যবস্থা করেছিলাম। খাবারের উত্তম ব্যবস্থা ছিল। অনেক দিন বিদেশে থাকার জন্য হাতে ভাত খেতে মোটেই ভাল লাগল না। তাদের ঘরেও কাঁটা চামচ থাকত। তারা যখন আমার এক সঙ্গে খেত, কখনও তাদের হাতে ভাত খেতে দেখিনি। আমার ধারণা ছিল, কাঁটা চামুচ দিয়ে এরা শুধু আমারই সামনে খায়, অন্যথায় দক্ষিণ হস্তের ব্যবহারই করে। এরা সাত তলাতে থাকত। তাদের খাবারের ঘরের খিড়কী দরজা যখন খোলা থাকত, তখন ষ্ট্রীটের বিপরীত দিকের মুখোমুখী বাড়ির লোক এদের খাবার ঘরে কি হচ্ছে না হচ্ছে বেশ ভাল করেই দেখতে পেত। সেজন্য খিড়কী দরজার পরদা প্রায় সব সময়ই বন্ধ থাকত। একদিন আমি খিড়কী দরজার পর্দা সরিয়ে দিয়ে হাত দিয়েই ডাল ভাত খেতে লাগলাম। তখন অন্যান্য লোক বসার ঘরে বসে গল্প করছিল। হঠাৎ একজন এসে যখন দেখল আমি খিড়কী দরজা খুলে হাত দিয়ে ভাত খাচ্ছি, তখন সে চটপট করে খিড়কী দরজার পর্দা নামিয়ে দিয়ে আমার দিকে রক্ত চক্ষু করে বলল আমরা ভাবতাম আপনি অনেকগুলি দেশ দেখে একটু সভ্য হয়েছেন, কিন্তু এখন দেখছি আপনার কিছুই পরিবর্তন হয়নি। সভ্যই হউন আর না হউন তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না, আমাদের এই সমাজে থাকতে হয়, অতএব এই সমাজের নিয়ম মেনে চলাই হ’ল এক মাত্র কাম্য। আমরা স্বদেশ যেতে চাই না। মজুরের স্বদেশ বলতে কিছুই নাই। যেখানে মজুর পেট ভরে খেতে পায়, থাকবার উত্তম স্থান পায় এবং মজুরের মজুরীর সংগে উপযুক্ত সম্বল পায় সে স্থানই হ’ল মজুরের স্বদেশ। আমরা যদিও নাগরিক হইনি, একদিন নাগরকি হব এই আশা করেই এখানে আছি।” আমি লোকটির কথায় মোটেই জবাব দিলাম না, কারণ এটা হ’ল আমার ইচ্ছাকৃত কাজ। খাবার খেয়ে বসবার ঘরে গিয়ে দেখলাম সকলেই মাথা নত করে রয়েছে। আমি এদের এই দুরবস্থা দেখে, নিজের দোষ স্বীকার করলাম এবং তাদের বললাম, “আপনারা যে এতটুকু উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছেন, সেজন্য আপনাদের ধন্যবাদ।”
আর একটি লোক দুঃখ করে বলল, “অনেকে স্বদেশ স্বদেশ বলে চিৎকার করে, কিন্তু যারাই দেশে গিয়েছে তারাই বুঝতে পেরেছে স্বদেশের মানে কি? কলিম উল্লার ছেলে ছলিমের দেশে যাবার পর সে জ্ঞান বেশ হয়েছে। ছলিমের সমাজে একটুও সম্মান ছিল না। দেশে ফিরে যাবার পর তাকে কেউ সম্মান ত দেয়ই নি উপরন্তু হিংসার বশবর্তী হয়ে তার যথাসর্বস্ব অপহরণ করেছে। আমরা আর দেশে যেতে চাই না। এদেশেই যাতে আমরা সুখে থাকতে পারি, তারজন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি। এতে যদি আপনাদের মত নবাগত এসে বাদ সাথে, তবে আমরা তা নীরবে সহ্য করব না। আপনি বোধ হয় শুনেছেন, আমাদের দেশের কতকগুলি মোকদ্দমা-প্রিয় লোক এদেশে এসেও পূর্বের অভ্যাসমত এখানেও অনর্থক মিথ্যা মোকদ্দমার সৃষ্টি করেছিল। তারা এত দূরে এসেও এত নিকৃষ্ট কাজে অগ্রসর হওয়াতে অনেকেরই দৃষ্টি তাদের উপর পড়ল। অনেকে তাদের ভাল উপদেশ দিল, কেউ বা ভয়ও দেখাল। কিন্তু কিছুতেই যখন কিছু হ’ল না তখন উপযুক্ত ব্যবস্থার ফলে এখন তারা সে কুঅভ্যাস পরিত্যাগ করেছে। আপনিও যদি পুনরায় হাতে খান তবে আপনার প্রতিও সেরূপ কোন ব্যবস্থা হতে পারে।”
বৃটিশ কলোনীতে উৎশৃংখল ভাবে চলাকেই ডিমক্রেসী বলে। উৎশৃংখলতার প্রশ্রয় সর্বত্র দেওয়া চলে না। ভারতে যেমন করে ধর্মের নামে উৎশৃংখলতার প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে অন্যত্র তেমন কোথাও দেওয়া, হয় না। প্রথম প্রথম যারা আমেরিকাতে গিয়েছিল তারা পাজামা পরে লশ্বা সার্ট গায়ে দিয়ে পথে যেত। শ্রীহট্টের লোক জাল বুনে নদী নালা হতে মাছ ধরত। শিখরা পাগড়ী বেঁধে থিয়েটারের যেত। এসব অন্যায় কাজ হতে বিরত থাকবার জন্য সর্বসাধারণ যখন নিষেধ করত, তখন সেই পুরাতন ধর্মপ্রীতি এবং বর্বরোচিত স্বদেশপ্রেম জেগে উঠত। ফলে ভারতবাসীকে আমেরিকানরা নাগরীকত্ব আর দিল না। যাদের দিয়েছিল তাও কেড়ে নিল। কোনও অন্যায় কাজ করে তাকে স্বদেশীকতার আবরণ দিয়ে, সেই অন্যায়কে চালাবার চেষ্টাকেই বর্বরোচিত স্বদেশপ্রেম বলে। এরূপ হীন কাজ যাতে আর না হয় সেজন্য অনেকগুলি ভারতবাসী আপ্রাণ চেষ্টা করছে দেখে আনন্দিত হয়েছিলাম।
“আমি মোকদ্দমা করব, আমি পাজামা পরব, আমি পাগড়ী বাঁধব তাতে তোমার কি? যদি কোন অনিষ্ট হয় তবে আমার হবে।” এই রকমের কথা যারা বলে এবং এরকমের কথা যারা মেনে চলে তারা সমাজে বাস করার উপযুক্ত নয়। যে কয়জন ভারতবাসী এরকমের কথা বলে নিজের মতকে সমর্থন করেছিলেন; শুনেছি তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। যারা শাস্তি পেয়েছিল তাদের অনেকে নাকি “ডিস্এপিয়ার” হয়েছিল। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যতদিন আমেরিকায় থাকত ততদিন হাতে খাব না, কাঁটা চামচ ব্যবহার করব, নতুবা “ডিস্এপিরার” হতে হবে।
আমেরিকাতে যাবার পর হিন্দুরা এক নতুন জীবন লাভ করে। সেই নতুন জীবনে তারা যা পায় তারা আটকে রাখতে চায়। তাই তারা টাকা পায় না, তারা সম্মান পায় না, তারা পায় সুখ এবং সুবিধা। একখানা ফারনিস্ট ফ্ল্যাটে তারা পায় চারটি রুম। একখানা বসবার ঘর–যাতে থাকে একটা লম্বা ভেলভেট দিয়ে মোড়া বেন্চ, যাতে বসলে কোমরের অর্ধেকটা ডেবে যায় এবং স্প্রিংএর বেশ সুন্দর একটা ঝাঁকানি লাগে। এতে ইচ্ছা করলে শুয়েও থাকা যায়। তারপর আরও কিছু থাকে, যেমন দুখানা টেবিল, দুখানা আরাম চেয়ার, চারখানা বসবার চেয়ার ইত্যাদি। শোবার রুমে থাকে এমন একখানা বিছানা যা ভারতবাসী অনেক সময় সেই বিছানার কথা কল্পনাও করতে পারে না। কাছেই বাধরুম। সে রুমে থাকে গরম এবং ঠা-া জলের নল–টবে সে জল নিযে যত ইচ্ছা তত স্নান কর। রান্না ঘরে বাসন এবং গামছা দেওয়াই থাক, গ্যাসের উনুন থাকে, হাত ধুইবার জন্য গরম এবং ঠা-া জলের পাইপ থাকে। এরূপ আরামদায়ক রুম তার সাপ্তাহিক ভাড়া মাত্র আট ডলার। যে সকল দরিদ্র মজুর কুঁড়ে ঘরে বাস করেছে, চৌকীদার হতে আরম্ভ করে যার তার কাছে সকাল হতে ঘুমানো পর্যন্ত অপমানিত হয়েছে, সেই লোকরাই আমেরিকায় গিয়ে ইংলিশ শিখে জগতের সংবাদ রাখবার ক্ষমতা অর্জন করেছে। তাকে যদি তুমি পন্চাশ ডলার পাবার বদলে ভারতে পাঠাবার বন্দোবস্ত কর তবে সে প্রতিহিংসা নিবে না কেন? এই করে আমেরিকায় হিন্দু হিন্দুর রক্তে প্রায়ই হাত কলংকিত করছে।
আমি অপরের কথিত সুসমাচার আমার বই-এ লিপিবদ্ধ করব না, আমি নিজে যা দেখেছি এবং আমার নিজের জীবনের উপর দিয়ে যা ঘটে গেছে তারই কথা শুধু বলব। অনেকে হয়ত বলবেন, এযে আত্মজীবনী হয়ে যাচ্ছে। আমরা আমেরিকার সম্বন্ধে আরও অনেক কিছু জানতে চাই। ভ্রমণ-কাহিনীতে নিজের ভ্রমণ কথা ছাড়া আরও কিছুই থাকে না। আমার দৃষ্টিতে যা আসবে তাই আমি পাঠক সমাজকে ভাষার সাহায্যে বলতে চেষ্টা করব। এর বেশী বলতে গেলেই আমার পক্ষে অনধিকার চর্চা হবে। অনধিকার চর্চায় কুফল যেমন হয় তেমনটি অন্য কিছুতে হয় না।
সান্ফ্রানসিসকো যাবার পর আমি ঔপন্যাসিক ধরনে স্থানীয় তথ্য যোগাড় করতে লাগলাম। আমি ভেবেছিলাম এই অজ্ঞাত স্থানে কে আমার শত্রুতা করবে! একটি ব্যাংকে আমার টাকাগুলি জমা রেখে দিয়েছিলাম। টাকা আনবার জন্য প্রায়ই আমাকে ব্যাংকে যেতে হত। একদিন টাকা নিয়ে বের হয়েছি এমনি সময় দেখলাম একজন পান্জাবী আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আমার তাতে চিন্তা করার কি আছে? তবে এই মাত্র ভেবেছিলাম লোকটি আমার স্বদেশবাসী পান্জাবী–শীতের দেশে অনেকদিন বাস করে তার শরীরের রং বদলে গেছে এবং দেখতে অনেকটা গৃক অথবা ইটালীয়ানদের মতই হয়ে গেছে। এরপর আমি এন্এপলজির কথা নিজেই চিন্তা করছিলাম।
কয়েকদিন পরই একটি আমেরিকান যুবকের সংগে আমার পরিচয় হয়। যুবকটি অলস এবং বেকার। এরূপ ভেগাব- আমেরিকায় প্রায়ই দেখা যায়। এরা কোন কাজই করতে রাজি নয়। যুবকটী আমার কাছ হতে সামান্য সাহায্য চেয়েছিল, আমি তাকে তার আশার অতিরিক্ত কিছু দেওয়ায় সে প্রায়ই আমার রুমে আসত এবং কালিফরনিয়অর হিন্দুদের কথা বলত। সে এমন কিছু বলত না যাতে আমি ওদের জীবনযাত্রার কিছু বিশষত্ব অনুভব করতে পারি। সে শুধু বলত হিন্দুরা বড়ই কৃপণ, তাদের পকেটে একটি ডলার যদি একবার প্রবেশ করে তা আর বের হয় না। হিন্দু অতি অল্প খাদ্য খেয়ে সন্তুষ্ট থাকে। তার সেই কথাটির সত্যতা আমিও অনুভব করেছিলাম। একটি লোকের নিদরল্যা- ব্যাংকে পন্চাশ হাজার ডলার জমা ছিল, সেই লোকটির ঘরে গিয়ে দেখি যে সামান্য কয়টি মূলা পাতা সিদ্ধা করে তারই সাহায্যে চাপাতি খাচ্ছে। এরূপ কৃপণের পন্চাশ হাজার ডলার আমেরিকাতে থেকে জমানো কষ্টকর কাজ নয়।
একদিন সেই যুবকটির সংগে আমি একটি সিনেমা দেখতে যাই। রাত বারটার সময় সিনেমা ঘর হতে বের হয়ে সে মারকেট স্ট্রীটের দিকে রওয়ানা হয়েছিল আর আমি হাওয়ার্ড স্ট্রীট ধরে থার্ড স্ট্রীটের দিকে চলছিলাম। পথে দোকানগুলিতে কি কি জিনিস সাজিয়ে রাখা হয়েছে তার দৃশ্য দেখে চলছিলাম। একটি সিনেমা ঘর পার হয়ে দুখানা দোকানের সামনে যে বাতি ছিল তা অতীব অনুজ্জ্বল এবং সেই অনুজ্জ্বল আলোয় সাজানো জিনিসগুলি বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমি যখন মন দিয়ে সেই দৃশ্য দেখছিলাম তখন হঠাৎ আমার পেছন দিক হতে একটা লোক পিস্তলের অগ্রভাগ দিয়ে আমাকে একটা খোঁচা মারে। আমি তৎক্ষণাৎ তার দিকে ফিরেই দেখলাম লোকটি আমেরিকান এবং আমাকে হত্যা করার জন্যই দাঁড়িয়ে আছে। আমি একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে লোকটিকে বললাম “বস গিভ মি এ বাট” অর্থাৎ হে প্রভু দয়া করে আমাকে আপনার হাতের অর্ধদগ্ধ ভুক্তাবশিষ্ট সিগারেট কুটরাটি দিয়ে বাধিত করুন। আমার কথা শুনে লোকটি আমার দিকে একটু চেয়ে দেখল তারপর আমার হাঁটুতে এবং উরুতে কয়েকটি পদাঘাত করে তার হাতের সিগারেটটি আমার হাতে দিয়ে বলল “গেট আউট ইউ ডেম নিগার, ইউ আর সেইভড” অর্থাৎ অসভ্য নিগ্রো এখান হতে চলে যা, তুই আজ বেঁচে গেলি। আমি ক্ষণকাল বিলম্ব না করে নিকটস্থ একটি রেস্তোঁরাতে গিয়ে দাঁড়ালাম এবং নিগ্রো প্রথায় এক পেয়ালা কাফি চাইলাম। দোকানী আমাকে এক পেয়ালা কাফি দিল এবং তাই হাতে করে নিয়ে ফুট-পাথের উপর বসে টুপিটা আরও একটু টেনে দিয়ে কাফি খেতে লাগলাম। যখন আমি কাফি খাচ্ছিলাম তখন সেই পিস্তলধারী লোকটি আমার কাছ দিয়ে যাচ্ছিল এবং আমাকে দেখিয়ে বলছিল আজ এই গাধাটা বেঁচে গেল এবং আর একটা লাথি আমার পিঠে লাগিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল। আমি কান পেতে শুনছিলাম লোকটি বলছিল শয়তান হিন্দুটা গেল কোথায়? একে পাওয়া মাত্র হত্যা করতে হবে।