আজকের আমেরিকা (২১) –শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

শ্রীরামনাথ বিশ্বাস
শ্রীরামনাথ বিশ্বাস

কাফি খেয়ে, কাপটি ফেরত দিয়ে, নিগ্রো প্রথা মতে হেঁটে রুমে গিয়ে হাত পা ছেড়ে বিছানাতে শুয়ে পড়লাম। পদাঘাতের অবমাননা, প্রাণের ভয়, এসব নানা চিন্তা মনকে অস্থির করে তুলেছিল। আমরা বলি জীবন তুচ্ছ, কিন্তু আমার কাছে আজ মনে হতে লাগল জীবন অমূল্য সম্পদ। প্রতিহিংসা কার উপরে আদায় করব? কেন আমাকে হত্যা করা হবে? এসব চিন্তা একটার পর একটা এসে আমাকে চিন্তিত করে ফেলছিল। ইচ্ছা হয়েছিল বার থেকে ওয়াইন এনে খেয়ে গভীর নিদ্রায় নিদ্রিহত হই। কিন্তু ভয় হল পাছে কেউ এসে গুলী করে। নানা চিন্তায় রাত কাটতে লাগল। সকাল হল। আমি হাতমুখ ধুয়ে বাড়িওয়ালীর ঘরে গেলাম। বাড়িওয়ালী আমার গম্ভীর মুখ দেখেই বুঝলেন আমার কিছু বিপদ হয়েছে। আমাকে তিনি সকল কথা খুলে বলতে বললেন। আমিও যা ঘটেছিল তা তাকে বললাম। তিনি আমার কথা শুনে একটু চিন্তা করেই টেলিফোন হাতে নিয়ে জনৈক হিন্দুকে ডাকলেন এবং জবাবও পেলেন। তাদের মাঝে যা কথা হয়েছিল তা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তাদের কথার অবিকল নকল দেয়া গেল।

“আপনি কোথা হতে কথা বলছেন?”

“এখন আমার কোন নম্বর দিব না।”

“তবে বিশ্বাসঘাতকটা আপনার ওখানেই থাকে?”

“বিশ্বাসঘাতক বলবেন না, লোকটি ভূপর্যটক, তার প্রমাণ দিতে সক্ষম হব। তাঁর সংগে সাইকেল আছে, সংবাদপত্রের কাটিং আছে. তিনখানা পাসপোর্ট আছে, যদি আদেশ করেন তবে এসব নিয়ে আমি আসতে পারি।”

“আপনার কি মনে হয় লোকটা ঠিক ঠিকই নির্দোষ?”

“যদি নির্দোষ না হত তবে আমি এরূপ কথা কখনও বলতাম না।”

“আপনি সাইকেল ছাড়া আর সব দলিল নিয়ে আসবেন।”

“তাই হবে।”

আমি আর ঘর হতে বের হলাম না, বাড়িওয়ালী আমার কাগজপত্র নিয়ে গন্তব্য স্থানে গেলেন এবং আমার কাগজ দেখালেন। আমার কাগজপত্র দেখার পরই বোধহয় তাদের সন্দেহ দূর হয় এবং তৎক্ষণাৎ আমাকে ফোনে ডাকা হয়। ফোনে যে সকল কথা হয়েছিল তারও অবিকল নকল দিলাম।

“ক্ষমা করবেন মহাশয়, আমরা ভেবেছিলাম আপনি ইমিগ্রেসন বিভাগে কাজ করেন। সাইকেল নিয়ে বের হন না কেন?”

“স্যানফ্রানসিসকো ভয়ানক উঁচু নীচু শহর, এখানে পায়ে হাঁটতেই পছন্দ করি।”

“আপনি আজ বিকালে সাইকেলে মারকেট স্ট্রীটে বেড়াবেন আমরা দেখব আপনি ভিড়ের মাঝে কেমন সাইকেল চালাতে পারেন। আর একটা কথা, আপনি টমাস্ কুক্ ব্যাংকে এবং মারকেট স্ট্রীটের শেষ সীমার বইএর দোকানে রোজ যান কেন?”

“টমাস কুক ব্যাংকে আমি টাকা রেখেছি। রোজ যে টাকা দরকার হয় তাই নিয়ে আসি, আর মারকেট স্ট্রীটের শেষ ভাগে ফেরি বোটের কাছে যে দোকানে আমি যাই তথায় বৈদেশিক দৈনিক সংবাদপত্র পাওয়া যায়, তথায় গিয়ে বৈদেশিক দৈনিক সংবাদপত্র পাঠ করি।”

“তাই বুঝি?”

“হাঁ।”

“নমস্কার।”

বাড়িওয়ালী ঘরে এসে আমার রুমে আসলেন এবং হাঁপাতে লাগলেন। একটু শান্ত হয়ে তিনি আমাকে বললেন, “কাল আপনার প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। আপনি নিগ্রোদের চালচলন এবং কথা বলার কায়দা বেশ শিখেছেন বলেই রক্ষা পেয়েছেন। যাক আজ বিকালেই আপনি সাইকেলে মারকেট স্ট্রীটে যান এবং বেশ করে বেড়িয়ে আসুন। এদের এখনও সন্দেহ রয়েছে। কয়েকদিন পূর্বে একজন লোক আপনাকে একটা দলিল দেখিয়েছিল এবং বলেছিল আপনি আপনার জানামত একজন উকিলের বাড়িতে তাকে নিয়ে যেতে, আপনি তাতে রাজি হননি, এতেই তাদের সন্দেহের কারণ আরও বেড়ে যায়। এখন আপনি নিরানব্বই পারসেণ্ট নিরাপদ। বিকালে যদি সাইকেলে করে মারকেট স্ট্রীটে বেড়িয়ে আসতে পারেন তবে আর ভয় নাই।

আমেরিকার রাজপথে কেউ সাইকেল ব্যবহার করে না। অ্যাকসিডেন্ট হবার বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। অ্যাকসিডেণ্ট হবে এই ভয়ে আমি সাইকেল উঠিয়ে রাখিনি, আমার সাইকেল চালাতে কষ্ট হত তাই সাইকেল উঠিয়ে রেখেছিলাম।

বিকাল বেলা থার্ড স্ট্রীট থেকে বের হয়ে হাওয়ার্ড স্ট্রীট দিয়ে মারকেট স্ট্রীটে পৌছে অনেকক্ষণ বেড়ালাম। বেড়াবার সময় দু’একজন হিন্দু আমার সামনে এসে পড়েছিল এবং এমনি ভাবে দাঁড়িয়েছিল যাতে আমাকে সাইকেল থামাতে হয় কিন্তু সাইকেল চালাতে আমি বেশ পারদর্শী হয়েছিলাম। কখনও বেল বাজাতাম না। ধীরে সাইকেল চালিয়ে আমি লোকের পেছন চলতে সক্ষম হতাম। হিন্দুরা বুঝেছিল আমি প্রকৃতই একজন বাইসাইকেলী ভূপর্যটক। পরদিন আবার ফোনে কথা হয়েছিল। আশ্বাস পেয়েছিলাম আমি এখন মুক্ত। কেউ আমাকে আর হত্যা করতে চেষ্টা করবে না। যদিও আমি মুক্ত হয়েছিলাম কিন্তু সেই পদাঘাতের কথা এখনও মনে আছে। তারপর মনে আছে সামান্য অর্থের বিনিময়ে ভারতবাসী বিদেশে গিয়েও সাজানো সোনার সংসারে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে। আরও দুঃখ হয় আমাদের নিকৃষ্ট মানসিক বৃত্তি দেখে, এর বেশি এখানে ভারতবাসীর সম্বন্ধে বলার কিছুই নাই।

জ্যারনেলিষ্ট শব্দের অর্থ আমাদের দেশে “সংবাদপত্রসেবী” বলেই স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও জ্যারনেলিষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা আমাদের মত করে না। মজুরী শব্দের অর্থ ভাল করে অবগত হলেই এসব বাজে শব্দের ব্যবহার হতে রক্ষা পাওয়া যায়। আমি এখন জ্যারনেলিষ্ট শব্দই এখানে ব্যবহার করব। “সংবাদপত্রসেবী” শব্দ ব্যবহার করার সময় এ পৃথিবীতে কখন আসবে তা জানি না। যখন লোক ঠিক ঠিক ভাবে সংবাদ পত্রের সেবা করবে তখন “কর্তা ইচ্ছা কর্ম” হবে না। সাহিত্যিক মজুরগণ তখন স্বাধীনভাবে আপন আপন মনের কথা বলতে সক্ষম হবে। আমাদের দেশে হালে পূজিবাদ গঠন হতে আরম্ভ হয়েছে। পূজিবাদীরা সাহিত্যিক মজুর প্রচুরভাবে খাটাতেও আরম্ভ করেছে। আমাদের দেশে এমন কোন সাহিত্যিক মজুর নাই যিনি পূজিবাদীর কাছে তার মজুরী বিক্রয় করার সময় ইচ্ছামত কলম চালাতে সক্ষম হন। তাকে পূঁবিজাদীর মনমত চলতে হয়! আমেরিকা পুরাতন পূঁজিবাদী, ইংলণ্ড তারচেয়েও পুরাতন, অতএব তারা ভাল করেই জানত এবং এখনও ভাল করেই জানে কিকরে সাহিত্যিক মজুরদের খাটাতে হয়।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.