
এই সাইকেল দিয়ে তেতুলিয়া টেকনাফ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ৬৪ জেলা এই সাইকেল দিয়ে ভ্রমণ করেছিলাম।
প্রায় ৫/৬ বছর আগের ঘটনা। তখন কাজ করি এ্যালিফেন্ট রোডের এক অফিসে। অফিস থেকে প্রায়ই বিভিন্ন যায়গায় পাঠানো হয় কাজের জন্য। রাস্তার জ্যামের কারণে প্রায়ই সময় নষ্ট হয়, সময়মতো কাজ করতে পারি না এবং কথা দিয়ে কথাও রাখতে পারি না। ঠিক করলাম একটা সাইকেল কিনবো, বেতনের টাকা জমিয়ে ১১শ টাকায় পুরনো একটা সাইকেল কিনে ফেললাম। বিশ চাকার সাইজের একটা ছোট সাইকেল, ফ্রেম সাইজ সম্ভবত ১৬, তখন ফ্রেম সাইজ কি জানতাম না। সেই সাইকেল নিয়ে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়াই, কাজ না থাকলে রাতে বের হই। বেশির ভাগ সময়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঘুরতে যাই। সাইকেল চালাতে চালাতে একদিন মাথায় আসলো অন্য রকম একটা কিছু করতে হবে। সেটা কি ভাবতে ভাবতে মাথায় চলে এলো টেকনাফ তেতুলিয়া সাইকেল ভ্রমণের কথা। খোঁজা শুরু করলাম এর আগে কে কে এই ভ্রমণ করেছে? কাউকেই পাচ্ছিলাম না, তখন তেমন কাউকে চিনিও না।
হঠাৎ একদিন মনা ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। মনা আমাদের অফিসে এসেছিলেন সম্ভবত ফটোগ্রাফি কোর্স করার জন্য। তিনি আমার সাইকেল দেখে নিজে থেকেই বললেন আপনার সাইকেল দেখে অনেক পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। আমি ৯৮ সালে সাইকেল নিয়ে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া ভ্রমণ করেছিলাম। আমি তো শুনে অবাক! বলেন কি? আমি তো আপনাকেই খুঁজতেছি এতদিন ধরে। আমিও তো এই ভ্রমণ করতে চাই তবে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া না, উল্টা করতে চাই তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ। আপনার কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য লাগবে। তিনি খুশি হয়েই বললেন, ‘কোন সমস্যা নাই যখন যাবেন যাওয়ার আগে আমাকে বইলেন, আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো।’ (পরবর্তীতে তিনিও আমার সঙ্গী হয়েছিলেন তেতুলিয়া টেকনাফ ভ্রমণে) অনেক কথার মধ্যে তিনি বললেন, ‘আপনার সাইকেলের চেসিস নাম্বার জানেন?’ আমি তো বুঝি না চেসিস নাম্বার কি। তিনি বুঝিয়ে বললেন, ‘সাইকেলের ফ্রেমের নিচে একটা নাস্বার খোদাই করা থাকে এই নাম্বারগুলোকে চেসিস নাম্বার বলে। এই নাম্বারগুলো প্রত্যেক সাইকেলেই থাকে। তিনি আমাকে দেখিয়েও দিলেন, তাঁর কাছ থেকে নতুন একটা জিনিশ শিখলাম। মনা ভাইয়ের কাছ থেকে পরবর্তীতে তেতুলিয়া টেকনাফ ট্যুরে অনেক প্রয়োজনীয় কিছু শিখেছিলাম বিশেষ করে রাস্তায় চালাতে হলে কি কি দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এক অর্থে মনা ভাই আমার সাইক্লিংয়ের গুরু বলা চলে। তাঁর কাছ থেকে সাইক্লিং বিষয়ে যা শিখেছি তা সারাজীবন কাজে লাগবে।
তেতুলিয়া টেকনাফ ভ্রমণের চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরতে থাকলাম। যার সঙ্গেই কথা হয় তাকেই বলি, তেতুলিয়া টেকনাফ ট্যুরে বের হবো, কয়েকদিন পরে। একদিন অফিসের বড় ভাই, রাসেল ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর বাসাবোর বাসা থেকে রিক্সায় করে অফিসে ফিরছি। আমি রাসেল ভাইয়ের কাছে কম্পিউটারে কাজ শিখি আর রাসেল ভাইয়ের কিছু কিছু কাজ কম্পিউটারে করে দেই। কথায় কথায় বললাম, রাসেল ভাই আমি তো সাইকেল ভ্রমণে বের হবো তাই ঠিক করছি আমার সাইকেলটা বিক্রি করে দিয়ে একটা ভাল সাইকেল কিনবো। তিনি আমার কথা শুনে বললেন, ‘আমার বাসায় বারান্দায় একটা সাইকেল পরে আছে, প্রায় ৫/৬ বছরের আগের তুমি দেখো যদি পছন্দ হয় নিয়ে যাও।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম কতো টাকা দিতে হবে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘কোন টাকা দিতে হবে না।’ আমি বললাম, আমি তো এমনি এমনি নেব না। তিনি বাধ্য হয়ে বললেন তাহলে একটা কাজ করো, ‘তুমি আমার বাসায় যে বইগুলো দেখছো সব বই কম্পিউটারে লিস্ট করে দাও, বিনিময়ে সাইকেল নিয়ে যাও। আর সাইকেলটা মনে ঠিকঠাক করাতে কিছু টাকা লাগতে পারে, তুমি তোমার পুরনো সাইকেলটা বিক্রি করে আমার সাইকেলটা ঠিক করে ফেলো।’ আমি রাজি হয়ে গেলাম। রাসেল ভাইয়ের বইয়ের সংখ্যা ছিলো প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজারের মতো। সাইকেল ঠিক করতে গিয়ে দেখা গেল শুধু টিউব দুইটা পাল্টালেই হবে আর কোন সমস্যা নাই। মিস্ত্রি যখন সাইকেল ঠিক করছিল তখন কি মনে করে যেন ফ্রেমের চেসিস নাম্বারটা মোবাইলে সেভ করে রাখলাম। নাম্বারটি ছিল এমন, JC 86142100। সাইকেল ঠিক করার পরে মহা-আনন্দে রেসিং সাইকেল চালাই।
আমার প্রতি সপ্তাহে একদিন ছুটি সেই ছুটিটা রাসেল ভাইয়ের বাসায় কাটাই বই লিস্ট করার কাজে। প্রতি সপ্তাহে সাইকেল নিয়ে চলে যাই তার বাসায়, কাজ করে আবার সাইকেল নিয়ে ফিরে আসি। একদিন সকালে তাঁর বাসায় গেলাম, নিচে সাইকেল তালা দিয়ে উপরে গিয়ে সারাদিন কাজ করলাম। দুপুরে খাওয়া শেষ করে নিচে নেমে দেখি সাইকেল নাই। উপরে গিয়ে রাসেল ভাইকে বললাম। আসে-পাশে অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম কিন্তু সাইকেল আর পেলাম না। মন খারাপ করে আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে করতে হাঁটতে হাঁটতে অফিসের দিকে রওনা দিলাম। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না, কয়েকদিন পর ভ্রমণে বের হবো, অথচ এই সময়ে সাইকেলটা চুরি হয়ে গেল! কমলাপুর দিয়ে মতিঝিলের কাছাকাছি এসেছি হঠাৎ দেখি এক ছেলে আমার সাইকেলটা চালাচ্ছে। প্রথমে ভাবলাম একই রকম সাইকেল কিন্তু ছেলেটি যখন আমার সামনে দিয়ে চলে গেলো তখন বুঝলাম এটা আমারই সাইকেল। প্রথমে ছেলেটির পিছু নিলাম কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। কিছুদূর যাওয়ার পর ছেলেটি একটি টিনসেট বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল, আমি ফোন করলাম রাসেল ভাইকে তিনি আমাকে অপেক্ষা করতে বলে তার এক বন্ধুকে নিয়ে রওনা দিলেন। কিছুক্ষণ পর ছেলেটি সাইকেল নিয়ে বের হলো, মহা-আনন্দে সাইকেল নিয়ে আমার পাশ দিয়ে চলে গেল। আমি আবার পিছু নিলাম, এবার সে রওনা দিলো মধুমিতা হলের দিকে। হলের কাছে দুই পুলিশ দেখে সাহস পেলাম দৌঁড়ে গিয়ে ছেলেটিকে ধরে ফেললাম। পুলিশ পাশ দিয়েই যাচ্ছিলো, তাঁদের ডেকে বললাম এটা আমার সাইকেল দুপুরের আগে চুরি হয়েছে। তাঁরা সব কথা শুনে থানায় ফোন করলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই মতিঝিল থানা থেকে গাড়ি নিয়ে এক অফিসার হাজির। অফিসার প্রথমে ঐ ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন সাইকেলটা কার? ছেলেটি উত্তরে বললে তার নিজের। অফিসার গাড়ি থেকে লাঠি বের করে এক ডোজ দিলেন, এক ডোজ দেয়ার পর ছেলেটি স্বীকার করলো সাইকেলটি ওর মামার। অফিসার ছেলের কাছ থেকে মামার ফোন নাম্বার নিয়ে ফোন করলেন কিন্তু ফোন বন্ধ পেলেন। অফিসার এবার আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার এটা যে আপনার সাইকেল প্রমাণ কি?’ আমি তো প্রথমে থতমত খেয়ে গেলাম এই প্রশ্ন শুনে, এই প্রশ্নের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। হঠাৎ করে মনে পড়লো চেসিস নাম্বারের কথা, আমি মোবাইল বের করে বললাম আমার কাছে সাইকেলের চেসিস নাম্বার আছে। তাঁকে প্রথমে চেসিস নাম্বার কি তা বোঝাতে হলো। এইবার অফিসার থতমত খেয়ে গেলেন তিনি কল্পনাও করতে পারেননি আমি এই ধরনের একটি প্রমাণ দেব। এরই মধ্যে রাসেল ভাই ও তার বন্ধু রানা ভাইও হাজির।
অফিসার বললেন, ‘আপনাদের থানায় যেতে হবে, অফিসিয়াল কিছু কাজ আছে। সেগুলো সেরে তারপর আপনারা ছাড়া পাবেন। অফিসে যাওয়ার পর আমার এবং রাসেল ভাইয়ের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার রাখলেন। মোবাইলে ফোন দিয়ে নিশ্চিত হলেন এটা আসলেই আমাদের নাম্বার কিনা। তারপর অফিসের আইডি কার্ডের ফটোকপিও রাখলেন। সবকিছু রেখে বললেন, ‘ভাই আর বইলেন না এর আগে একবার এই রকম সাইকেল চুরির ঘটনা একজন আইসা সাইকেল নিয়া গেল। কিছুক্ষণ পর আরেকজন এসে হাজির বলে কি এই সাইকেলের মালিক আমি। আমরা বিপদে পড়ছিলাম তাই আপনাদের নাম, ঠিকানাসহ আইডি কার্ডও রাখলাম। এর পরে কেউ যদি এসে সাইকেলের মালিক হিসেবে দাবি করে তা হলে আপনাদের খবর দেব।’ বুকের ভেতর থেকে বিশাল এক পাথর নেমে গেল, যাক এইবার তেঁতুলিয়া টেকনাফ ভ্রমণে আর কোন বাঁধা রইলো না। এই হলো আমার সাইকেলের প্রথম চুরির ঘটনা।
তেঁতুলিয়া টেকনাফ ভ্রমণ করে ঢাকায় ফিরেছি বেশিদিন হয়নি। একদিন অফিস থেকে নাখালপাড়ায় রওনা হয়েছি ছোট ভাইয়ের সঙ্গে জরুরি একটা কাজ করার জন্য। নাখালপাড়ার এগার নাম্বার গলিতে ছোট ভাইয়ের বাসা, বাসায় গিয়ে শুধু সাইকেলটি তালা দিয়ে ওর রুমে ঢুকলাম। কাজ শেষ করে বের হয়ে দেখি সাইকেল নেই। নিজের এলাকা থেকে সাইকেল চুরি হওয়া খুবই কষ্টের একটা ব্যপার। ছোট ভাইকে বাসা ডেকে থেকে বের করলাম, মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ। এলাকার আসে-পাশে যারা ছিলো সবাইকে ফোন করে বলে দিলাম এলাকা থেকে আমার সাইকেল চুরি হইছে কিছুক্ষণ আগে, সবাই যেন চোখ রাখে। বাসার আসে-পাশের আরো কিছু ছোট ভাই ও বন্ধুরা বের হয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করা হলো। প্রায় ১০/১৫ মিনিট পর এক ৫/৬ বছরের ছেলে এসে খবর দিলো ৬/৭ টি পরের বাড়িতে সে আমার সাইকেল দেখেছে দ্বিতীয় তলায়। সেখানে গিয়ে দেখি সত্যি সত্যি আমার সাইকেলটি, তালা দেওয়া অবস্থায়ই আছে। চোর ধরার চেষ্টায় অনেক্ষণ সাইকেলটি আর ধরলাম আসে-পাশে উৎ পেতে বসে ছিলাম প্রায় ২ ঘণ্টা পরে কাউকে সাইকেলটি ধরতে না দেখে সাইকেল নিয়ে ফিরে আসলাম। সাইকেলটি হারিয়েছিলো ২৫০ নম্বর বাড়ি থেকে আর পেয়েছিলাম ২৫৬/এ নম্বর বাড়ি থেকে।

ছবি: ইন্টারনেট
আজকে সাড়ে ৮ টার দিকে ট্রাভেলার্স অব বাংলাদেশ এর অফিস অর্থাৎ ছবির হাটের ইমনের চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তখন হঠাৎ রাব্বি ভাইয়ের মোবাইলে ফোন দিপু ভাইয়ের। তাঁর সাইকেলটি চুরি গেছে সিসি অর্থাৎ ক্যাফেসাইক্লিস্ট থেকে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এই সাইকেলটি আমি তিনদিন চালিয়েছিলাম টিওবির টেকনাফ কক্সবাজার সাইকেল ট্যুরে। রাতে বাসায় ফেরার পর একই ঘটনার জন্য ফেসবুকে ফুয়াদ ভাইয়ের পোস্ট দেখে এই লেখাটি লিখলাম। এই ঘটনাটি যেমন দিপু ভাইয়ের জন্য দুঃখজনক ঠিক তেমনি ক্যাফেসাইক্লিস্ট এর জন্য দুঃখজনক।
আমাদের সাইকেল সিকিউরিটির বিষয়ে সবার উচিত আরো অনেক বেশি সতর্ক হওয়া।
বি:দ্র: দিপু ভাইয়ের এই সাইকেলটিও ১৫/১৬ ঘণ্টা পরে পাওয়া গিয়েছিল।
আমার বাড়ি নাটোর, সেই যে গেলা আর আসলা না। চলে আস বেড়াতে।
চলে আসবো একদিন
খুব সুন্দর লেখা শরীফ ভাই। দীপু ভাইয়ের সাইকেল টা পাওয়া গিয়েছে গতকাল্কেই। চুরি হওয়ার ১৬-১৭ঘন্টা পড়েই 🙂 এখানে (https://www.facebook.com/groups/bdcyclists/permalink/595827200430069/) ডিটেইল্স কিছু পাবেন। পারলে পোস্টে একটা আপ্ডেট দিয়েন। ধন্যবাদ।
🙂
like বাটন দিয়ে দিলাম। পাঠকদের শেয়ার করতে সুবিধা হবে।
আপনি ভাগ্যবান। সাইকেল খুজে পেয়েছিলেন। আমার সাইকেলটা আমি আর খুজে পাইনি 🙁