ছোটবেলায় আম্মার সঙ্গে বাড়ি থেকে যখন বাসে করে ঢাকায় আসতাম অথবা বাড়ি যেতাম তখন প্রায়ই ড্রাইভারের পাসে আম্মার কোলে বসতে হইত। তখন রাস্তায় মাইলস্টোন দেখতাম। দেখতে খুব মজা লাগতো। ঢাকা কত কিলোমিটার বাকি দেখা যেত অথবা নরসিংদী কত কিলোমিটার এইগুলা দেখতে খুব মজা লাগতো। তারপর আবার ড্রাইভারের সামনে ঘড়ির মতো মিটারের কাটাটা দেখতেও মজা লাগতো, কত কিলোমিটার স্পিডে চলতেছে দেখা যেত।
নাখালপাড়া থেকে যখন জীবনের প্রথম একা একা সাইকেল নিয়ে এয়ারপোর্ট গিয়েছিলাম তখনও এমন কয়েকটা মাইলস্টোন দেখেছিলাম। সেটা দেখে বুঝতে পারতাম আর কত কিলোমিটার বাকি।
অনেকদিন পরে যখন তেঁতুলিয়া টেকনাফ সাইক্লিং করলাম তখন মাথার মধ্যে প্রথম আসলো সাইকেলে স্পিড মিটার থাকলে কত ভাল হইত। মনা ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার পর জানতে পেরেছিলাম সাইকেলেরও মিটার আছে। বংশালে নাকি পাওয়া যায়।
ভ্রমণ শেষে ফিরে এসে সত্যি সত্যি বংশালে গেলাম মিটার খুঁজতে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে মিটার পেয়েছিলাম। সেটা ছিল একটা এনালগ মিটার। এই মিটারটা শুধুমাত্র ২৭ চাকা রোড বাইকের জন্য। মিটার কিনেছিলাম ঠিকই কিন্তু লাগানো হয় নাই। ঐখানে লাগানোর লোক ছিল না। প্যাকেটসহ একদিন পরে জিগাতলায় গিয়েছিলাম আল-আমিন ভাইয়ের কাছে। তিনি মিটারটি লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা সম্ভবত ২০০৮ কি ২০০৯ সালের ঘটনা হবে।
এর পরে অনেকদিন একটা ডিজিটাল মিটার খুঁজেছিলাম। কিন্তু পাওয়া যায় নাই। ৬৪ জেলা এই এনালগ মিটার দিয়েই ভ্রমণ শেষ করেছিলাম। এই মিটারের সঙ্গে মাইলস্টোনের কিলোমিটার মিলিয়ে দেখেছিলাম একদম হুবহু সঠিক রিডিং দিত।
এক সময় সেইফে কাজ করতে ঢুকলাম। সেখানে সাইক্লিং নিয়ে মশিউর ভাইয়ের সঙ্গে কয়েকটা প্ল্যান ছিল। নতুন নতুন রুট বের করা পাশাপাশি সেই রুট নিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রাম করা। সেটার কারণে আমরা ডিজিটাল মিটার খুঁজতেছিলাম। ততদিনে আবিষ্কার করলাম এইগুলাকে আসলে বাইক কম্পিউটার বলে। আমি আর মশিউর ভাই বংশালে তন্ন তন্ন করে খুঁজে অতি নিম্নমানের একটা বাইক কম্পিউটার খুঁজে পেলাম। চাইনিজ সেই বাইক কম্পিউটারের নাম বলা যেতে পারে জিংজু।
এর মধ্যে মশিউর ভাই দেশের বাইরে থেকে কিভাবে একটা ভাল বাইক কম্পিউটার আনানো যায় সে ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছিল। এক সময় সফলও হলেন। বাইরে থেকে দুইটা বাইক কম্পিউটার আনানো হইল। একটা পুরাপুরি আমি একা ব্যবহার করতাম। আরেকটা কখনো নূর ভাই অথবা কখনো শাওন ভাই ব্যবহার করতেন। বিশেষ করে আমরা যখন নতুন নতুন রুট খোঁজার জন্য বিভিন্ন জায়গায় রেকি করতে যেতাম। আমার বাইক কম্পিউটারটা ছিল ক্যাটআই। নূর ভাইদেরটার নাম মনে নাই। তবে উনাদেরটার ফাংসন অনেক বেশি ছিল আর ডিসপ্লেও অনেক বড় ছিল।
পরবর্তীতে বিডি সাইক্লিস্টের উত্থানের পরে এখন দেশেই নানা রকম বাইক কম্পিউটার পাওয়া যায়। আর দেশের বাইরে থেকেও চাইলে সহজে আনানো যায়।
এখন আবার বাইক কম্পিউটারের পাশাপাশি নানা রকম টেকলোজিও বের হয়ে গেছে। বাইক কম্পিউটার না হলেও চলে। মোবাইলের মাধ্যমেই বিভিন্ন অ্যাপস এন্ডুমন্ডু, স্ট্রাভাসহ নানা ভাবে কাজ করা যায়। সেখানে ম্যাপ দেখা যায়। অনেকে স্মার্ট ওয়াচের মাধ্যমেও দেখি কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। আবার অনেককে জিপিএসের মাধ্যমেও কাজ চালিয়ে নিতে দেখেছি।
ডিজিটাল বাইক কম্পিউটারে কিছু সমস্যা ছিল যা এনালগে ছিল না। যেমন ডিজিটাল যখন ব্যবহার করতাম তখন দেখতাম মাঝে মাঝে চুম্বুকের সঙ্গে সেনসরের যোগাযোগ না হলে রিডিং মিস করতো। এনালগে সেটা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম ছিল। আবার এনালগে দেখা যেত মাউন্টেন বাইকে ব্যবহার করা যেত না ঐটা শুধু তৈরি করা হয়েছিল ২৭ চাকার সাইকেলের জন্য। তারপরে আবার ৯৯৯ কিলোমিটার পরে আবার শূন্য থেকে শুরু হইত।
এতে অবশ্য আমার খুব একটা সমস্যা হত না। কারণ ৬৪ জেলা ভ্রমণে আমি প্রতিদিন রাতে লিখে রাখতাম কত কিলোমিটার চালিয়েছি। এনালগে আরেকটা সমস্যা ছিল কোন বাজারে সাইকেল থামালে লোকজন এসে মিটারের চাবি ঘুরাতো তখন রিটিং ঘুরে যেত। এটারও আমি একটা বুদ্ধি বের করেছিলাম। কোথায় থামলেই মিটারের উপরে হ্যালমেটটা রেখে দিতাম যাতে কেউ ঝামেলা না করতে পারে। অথবা কতকিলোমিটার চালিয়েছি সেটা মনে রাখার চেষ্টা করতাম। বাইক কম্পিউটারের এই ধরনের সমস্যা হতো। মনিটর অফ করে দিলেই ঝামেলা শেষ।
ডিজিটাল মিটার বা বাইক কম্পিউটারের অনেক সুযোগ সুবিধা থাকলেও প্রথমবার যে এনালগ মিটার ব্যবহার করেছি সেটার অনুভূতিটা সত্যিই অন্য রকম ছিল।
৬ আষাঢ় ১৪২৬