তালা শাহ্ (মোহাম্মদ মাঈনুদ্দিন)

ছবি: ফয়সাল মোহাম্মদ শান
ছবি: ফয়সাল মোহাম্মদ শান

অনেকদিন আগে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রতি সপ্তাহে নাসির আলী মামুনের একটি লেখা বের হতো। নাম ছিল সম্ভবত ‘ঘর নাই’; তখন বয়স ছিল অল্প, কিন্তু আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। ‘ঘর নাই’ শিরোনামে লেখাটি মূলত গৃহহীন মানুষদের নেয়া কিছু সাক্ষা‍ৎকার। কেন জানি ‘ঘর নাই’ নামটি খুব টানতো, তাই আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। সব সংখ্যাগুলো যে পড়েছি সেই দাবি করি না। প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ঘর নাই’ শিরোনামের সবগুলো সাক্ষাৎকার নিয়ে নিয়ে ২০১১-এর বইমেলায় প্রকাশিত হয় ‘চাড়ালনামা’ নামে একটি গ্রন্থ। বইটির সঙ্গে আরো যুক্ত হয়েছিলো কবি সাখাওয়াত টিপুর ‘বিধান ও অভিধান’। বইটি প্রকাশ করে আগামী প্রকাশনী।

সম্ভবত বইটি প্রকাশ নিয়ে সামান্য জটিলতা সৃষ্টি হয়। জটিলতা সৃষ্টির কারণ বিভাগ। অর্থাৎ বইটি কোন বিভাগে ফেলবেন এই নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে ঝামেলা কাটিয়ে বইটি প্রকাশিত হয়। ‘চাড়ালনামা’ বইটি রাসেল ভাইয়ের কাছ থেকে ধার নিয়ে পড়েছিলাম। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, এই ধরনের সাক্ষাৎকার আমিও তো নিতে পারি। গত ৫/৬ বছর ধরে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরেবেড়াচ্ছি। কখনো সাইকেল নিয়ে, কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো নৌকায়, কখনো গাড়িতে। ‘চাড়ালনামা’ পড়তে পড়তেই আমার এই সাক্ষাৎতকার নেয়ার ধারণাটা আসে। তবে আমার সাক্ষাৎকার নেয়ার ধরন শুধু গৃহহীন মানুষ হবে না, হবে সমাজের সকল মানুষের সাক্ষাৎকার।

অল্প কিছুদিন আগে, মাত্র ২ ঘণ্টার সিদ্ধান্তে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম সিতাকুণ্ডের ‘খৈয়াছড়া’ ঝরনা দেখার জন্য। কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলাম। ঈদের সময়, প্রচণ্ড ভিড়, সিট পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। দরজার পাসেই এক লোকের ট্রাঙ্কের উপর বসার সুযোগ হলো। সঙ্গী নোমান ভাই, এয়ারপোর্ট থেকে উঠবে শান। ট্রেন আসলো দেরিতে, ছাড়লোও দেরিতে। এয়ারপোর্ট স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে দেয়ার পর পরই আমাদের পাশে অদ্ভূত দর্শনের এক লোক পাশে এসে বসলেন। হালকা পাতলা শরীরের অধিকারী, মাথায় লম্বা চুল। গলায় ঝোলানো গামছা, নীচের দিকে খণ্ড লাল রঙ্গের কাপড় লুঙ্গীর মতো পড়ে আছেন। গলায় অনেকগুলো তালা ঝুলানো। তিনি অনেক্ষণ ঝিমালেন, ঝিমানির পর আলাপ শুরু করলাম নাম জিজ্ঞেস করে।

ছবি: ফয়সাল মোহাম্মদ শান

শরীফ: ওস্তাদ নাম কি?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন।

শরীফ: আপনার বয়স কতো হইবো?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: ৩৪।

শরীফ: আপনার ব্যাগে কি?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: আছে কিছু জিনিশপত্র।

শরীফ: কই যাইবেন?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: কেল্লায় যামু।

শরীফ: কেল্লা? এইডা আবার কি?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: কেল্লার মাজারে যামু।

শরীফ: ও, আচ্ছা। আপনে নামবেন কই?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: আখাওরা।

শরীফ: এই লাইনে কত দিন?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: সাত বছর।

শরীফ: কিছু পাইছেন?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: অহনো ফাইনাই (পাইনাই), বার বছর অইলে দেখুন যাইবো।

শরীফ: মানে আপনের আরো পাঁচ বছর সাধনা করুন লাগবো?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: হুমম।

শরীফ: আপনার পীরের নাম কি?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন:      …………. খন্দকার শাহ্ (পুরো নামটা মনে নেই)।

শরীফ: আপনারে পাওয়া যায় কই?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: সিলেট, শাহজালালের মাজারে।

শরীফ: শাহ-পরাণের মাজারে যান না?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: যাই।

শরীফ: আর কোন্ কোন্ মাজারে যান?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: সব মাজারতই যাই, শাহ-জালালের মাজারে বেশি থাহি (থাকি)।

শরীফ: তাইলে তো, বাংলাদেশের সব মাজারেই গেছেন?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: হ, সব মাজারেই গেছি, তয় অক্করে সব না।

শরীফ: মানে নামি-দামি সব মাজারেই গেছেন?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: হুমম।

শরীফ: কুষ্টিয়ায় গেছেন? লালনের আখড়ায়?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: না, হেনো গেছিনা।

শরীফ: বাড়িতে যান না?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: মাঝে মধ্যে যাই।

শরীফ: বাড়ি কই?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: সিলেটই।

শরীফ: বাড়িতে কে কে আছে?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: বাইরা আছে।

শরীফ: মা, বাবা নাই?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: নাহ্। মা-বাপ নাই। ইডার লাই¹াই কম যাই। বাইরারে টেহা দিতারলে বালা (ভালো), না দিতারলে খারাফ। মা থাকতে খুজ-খবর নিতো। মা-বাপ নাই তো দুনিয়া আন্ধার। কেউ কোন খোঁজ নেয় না। মা পথ চাইয়া থাকতো, খাইছি কিনা? ইতা লইয়া চিন্তা করতো।

[কথা বলতে বলতে একসময় ট্রেন টঙ্গী জংশনে এসে থামলো অন্য আরেকটি ট্রেনকে ক্রসিং দেয়ার জন্য। অনেকে নেমে রেললাইনে হাঁটাহাটি করছিলেন, আমরাও নামলাম। মাঈনুদ্দিন সাহেব এক দোকান থেকে পান-সিগেরেট কিনলেন, তাঁর লাল কাপড় দিয়ে বানানো লুঙ্গির নিচ থেকে একটা হাফ প্যান্টের পকেট থেকে টাকা বের করে দিলেন। আমরা খাওয়ার জন্য বুট কিনেছিলাম, সেটা দিতে চাইলে তিনি নিলেন এবং আমাদের সঙ্গে বুটও খেলেন]

শরীফ: লালনের আখড়ায় যান নাই কেন?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: এমনোই।

ছবি: ফয়সাল মোহাম্মদ শান
ছবি: ফয়সাল মোহাম্মদ শান

শরীফ: লালনরে চিনেন তো?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: হ, চিনি।

শরীফ: লালনের গান শুনছেন?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: হুনছি।

শরীফ: কেমন লাগে?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: তিনি ফুরান (পুরান) মানুষ। তেনার গান বালা লাগে।

শরীফ: লালন কোন ধর্ম করতেন, জানেন?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: বুজি নাই, কি কইছেন?

শরীফ: মানে উনি কোন ধর্ম করতেন? হিন্দু না মুসলমান?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: আমি ইতা জানি না, তয় তিনা পুরান মানুষ, তাঁর গান বালা লাগে।

শরীফ: আপনে নামায পড়েন?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: মাঝে মইধ্যে পড়ি।

শরীফ: নামায নিয়া আপনার মন্তব্য কি? নামায পড়া উচিত?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: হুমম, উচিত।

শরীফ: এইবার আপনার গলার তালা সম্বন্ধে জিজ্ঞাস করি, গলায় তালা কেন?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: পিরের হুকুম।

শরীফ: কয়টা তালা আছে?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: ৫২৩ টা।

শরীফ: এতো তালা কে দিছে?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: ভক্তেরা দিছে।

শরীফ: মানে কি? তালা দিয়া মানত করে?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: হ, আপনে দরতেন পারছেন।

শরীফ: আমি যদি আরেকটা দেই? ৫২৪ টা হবে?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: হ (হাসি দিয়া)।

শরীফ: চাবি কই?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: চাবি তাঁরার হাতে। একটা চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া, জনম ধইরা চলতে আছে। মন আমার দেহ ঘড়ি, সন্ধান করি কোন মিস্ত্রি বানাইয়াছে।

শরীফ: এইটা তো আব্দুর রহমান বইয়াতির গান, উনি তো কয়কেদিন আগে মারা গেছেন, জানেন তো? এই গানের সঙ্গে তালার সম্পর্ক কি?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: হুমম জানি। জিনিশ একই, আল্লাহ চাবি মাইরা ছাইড়া দিছে। কইয়া দিছে যার যার চাবি খুইজা লও।

শরীফ: আপনে পাইছেন?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: নাহ্, বার বছর যাক। দেখেন সব কিছুর মধ্যেই কিন্তু আছে, এই যে আপনেরা দেশ দেখতে বাইরে বের হইছেন, আমি আফনাগো কথা হুইনাই বুজজি। আফনেরা মনে করছেন আমি কিচ্ছু বুজি না? আমি সব বুজি। আপনেরা সংবাদিক, আমি বুঝছি। আফনেরা যে দেশ দেখতে বাইরে আইছেন, এইডারও কিন্তু আছে।

শরীফ: আরে না, আমরা সাংবাদিক না। আমরা এমনিতেই ঘুরতে বের হইছে। এইটা ঠিক দেশ দেখতে বের হইছে। তবে সাংবাদিক না। ঘুরাফেরার পর ইন্টারনেটে কিছু লিখি আরকি।

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: ঐ একই। এই যে আপনের মাথায় লাম্বা চুল এইডার পেছনে একটা কিন্তু আছে।

শরীফ: আরে নাহ্। চুল নিয়া কোন কারণ নাই।

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: আছে, আছে। আফনে কইতে না। আমি জানি।

শরীফ: আপনি চুল রাখেন কত দিন ধইরা?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: অনেকদিন, মাঝখানে একবার কাইট্টা লাইছিলাম, আম্মা খেতে পাডাইছিলেন, জোকে দরছিলো, সমস্যা অইছে। তাই চুল কাইট্টা লাইছি। চুল আরো বড় আছিলো।

শরীফ: আপনে কি ঠিক মতো গোসল করেন? নাকি সাত বছর ধরে গোসল ছাড়া?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: মাঝে-মইধ্যে করি।

ছবি: ফয়সাল মোহাম্মদ শান
ছবি: ফয়সাল মোহাম্মদ শান

শরীফ: আপনার কি কেউ ছবি তুলছে? (এই প্রশ্নটা শান করতে বলেছিলো)

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: হুমম, আমার ছবি ইন্টারনেটে আছে।

শরীফ: কি নামে পাওয়া যাবে ইন্টারনেটে?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: তালা শাহ্।

শরীফ: কে তুলছিলো আপনার ছবি?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: সিলেটের সংবাদিকরা।

[কথা বলতে বলতে এক সময় আখাওড়া চলে আসলো]

শরীফ: আপনে তো এখন নাইমা যাইবেন?

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: হ, অনেক কতা কইছি ভুল-ত্র“টি মাফ কইরা দিয়েন, আপনার লগে কতা কইয়া বালা লাগজে।

শরীফ: সিলেটে আসলে আপনার সঙ্গে দেখা করবো।

মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন: কোন সমস্যা নাই, শাহ-জালাল মাজারে আইয়েন, আমি হেনই থাকি।

Comments

comments

Comments

  1. zahirul Islam

    এরকম জীবন যাপনের মানুষদের সাথে কথা বলার/ মেশার আমার নিজেরও অল্পবিস্তর অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে ভাল লাগলো। অন্যরকম। আশাকরি লেখক আরো বিস্তারিত তথ্য নিয়েছেন। যেমন: তালা বা অন্য কিছু দিয়ে নানান দিয়ে ‘ভেক’ তত্ত্ব,”পিরের হুকুম” মানে কর্ম এবং আরো টুকিটাকি। আশাকরছি পরবর্তিতে লেখক তা জানার সুযোগ করে দিবেন। এরকম আরো নানান অভিজ্ঞতার কথা শোনার আশারাখি। ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.