৬৪ জেলায় যা দেখেছি-৭

৭ মার্চ (মৌলভীবাজার থেকে সিলেট)

সকালে উঠেই সবকিছু গুছিয়ে রুমেই জিনিশপত্র রেখে রওনা দিলাম জেলা প্রশাসকের অফিসে। সরাসরি দেখা করলাম এনডিসি সাহেবের কাছে, তিনি সবকিছু শুনে ডাইরীতে শুভ কামনা লিখে দিলেন সঙ্গে সীলও দিয়ে দিলেন। গতকালকের ঘটনা তিনি মনে হলো পুরোপুরি ভুলে গেলেন। আমি অবশ্য একবার মনে করিয়ে দিলাম আমিই গতকাল আপনাকে ফোন করেছিলাম। কিন্তু তিনি সে বিষয়ে কোন উত্তর দিলেন না। এমন একটা ভাব করলেন যে তিনি আমার কথা শুনেননি। সরকারী লোকজন কিছুটা নির্লজ্জ হয় জানতাম, কিন্তু এতোটা নির্লজ্জ হবে ভাবিনি।

30463_1452956773805_8034338_nতার সহকারীকে চা দিতে বললেন, হয়তো গতকালের ঘটনার কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যই চা দিতে বললেন। আমি সাধারণত চা পান করি না। তবে এইবার আমি না করলাম না, চায়ের দেশে এসে যদি চা না খেলাম তাহলে কেমন দেখায়?

যাই হোক কথা হলো মৌলভীবাজার জেলা সম্পর্কে। তার কাছ থেকে তথ্য পেলাম এখানকার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রবাসে থাকে এবং বেশির ভাগই লন্ডনে। বেশিরভাগ ছেলেপেলেরা লন্ডনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে, পড়াশোনাও তেমন একটা করে না।

জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে বের হয়ে রওনা দিলাম সিলেটের দিকে। সিলেট যাওয়ার জন্য ম্যাপে দুইটি রাস্তা পেলাম একটি হাইওয়ে রোড আরেকটি ভেতর দিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ থানা হয়ে। গতরাতে সার্কিট হাউজের কেয়ারটেকারের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিলাম ফেঞ্চুগঞ্জ দিয়ে গেলে রাস্তা সামান্য কম হবে, পাশাপাশি গাড়ির চাপও অনেক কম। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ফেঞ্চুগঞ্জের রাস্তা দিয়েই যাব।

পথে পড়লো সোহাব আলী বাজার, কটাল পুর বাজার রাস্তার পাশে কয়েকটি স্কুলেরও দেখা পেলাম। একটি প্রাইমারি স্কুলে চোখ আটকে গেল, স্কুলের সামনে ছোট একটা জায়গা অনেকটা বাড়ির উঠানের মতো তবে সবুজ ঘাসের। সেই জায়গাটা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পরিষ্কার করছে সঙ্গে এক স্যার এইসব তদারকি করছেন। আমি সাইকেল থেকে নেমে একটি ছবি তুললাম, আমাকে ছবি তুলতে দেখে স্যার আমাকে ডাকলেন। কাছে যাওয়াতে পরিষ্কার সিলোটি ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি সাংবাদিক?’ (তার কথা বুঝতে আমার সামান্য সমস্যা হলো, তবে বুঝতে পারলাম) আমি হেসে উত্তর দিলাম, ‘না।’ সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার করলাম আমার উদ্দেশ্য। আমার কথা শুনে বেশ খুশি হলেন এবং ছেলেমেয়েদের সবাইকে বললেন, উনি একজন মহান মানুষ, সাইকেল নিয়ে বাংলাদেশ দেখতে বের হয়েছে সবাই উনাকে সালাম দাও। এতগুলো ছেলেমেয়ে চিৎকার করে আমাকে বললো, আসসালামু আলাইকুম। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম! তারপরেও তাদের সালামের উত্তর দিলাম।

স্যারের কাছ থেকে জানতে পারলাম এটা তাদের সারীরীক শিক্ষা ক্লাশ সপ্তাহে একদিন স্কুল পরিষ্কার করান ছেলেমেয়েদের দিয়ে। এবং বাড়িতেও যেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে সেই বিষয়ে উপদেশ দেন। এই ধরনের কার্যক্রম দেখে অনেক ভালো লাগলো। ঢাকা শহরের কোন স্কুলে এখন এই ধরনের কার্যক্রম হয় কিনা কে জানে? এক সময় আমাদের স্কুলে স্কাউটদের কাজ ছিলো সপ্তাহে একদিন স্কুল পরিষ্কার করা। আমরা যারা স্কাউট করতাম না তাদের এই ধরনের কোন কাজ করতে হয়নি। করতে হলে ভাল হতো, সবাই একটা ভাল শিক্ষা পেত।

রাস্তার দুইধারে মাঠ আর ধানক্ষেত, অনেকটা হাওর এলাকার মতো। নূরপুর নামে একটি জায়গায় অদ্ভূত সুন্দর একটি মসজিদ দেখলাম নাম দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী জামে মসজিদ। মসজিদের বাইরে এবং ভিতরে দুই দিকেই টালর্স করা। চকচক করছে মসজিদটি, পরিষ্কার বোঝা যায় দেলোয়ার হোসেন চৌধুরীর ছেলে অথবা নাতী বেশ ভালই খরচ করে এই মসজিদটি তৈরি করেছেন। এমনও হতে পারে দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী সাহেব নিজেই নিজের নামে এই মসজিদটি তৈরি করেছেন।

দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী জামে মসজিদ
দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী জামে মসজিদ

এইসব চিন্তা করতে করতে সামনের দিকে এগুতে থাকলাম। পাশ দিয়ে একটি গাড়ি চলে গেল, গাড়িতে বিকট শব্দে গান চলছে। সেই গাড়ির পেছনে আরো একটি, তার পেছনে আরো একটি। আমি থেমে গেলাম পেছনে তাকিয়ে দেখি হিন্দি ছবির ভিলেনদের যেমন গাড়ির বহর যায় ঠিক তেমন গাড়ি বহর আসছে। সঙ্গে বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেলও আছে। তবে এটি হিন্দি ছবির কোন ভিলেনের গ্র“প না, এটি আসলে একটি বিয়ের বর যাত্রী। প্রতিটি গাড়িতে দুইজন বা তিনজন করে লোকজন বসা। কিছু গাড়িতে আবার মাত্র একজনও আছে। বিয়ের বরযাত্রীতে এত বড় গাড়ির বহর থাকতে পারে আমার ধারণা ছিলো না।

34100_1462399289862_4347613_nএকসময় ফেঞ্চুগঞ্জে পৌঁছে গেলাম। ফেঞ্চুগঞ্জ শহর হাতের ডান দিকে ফেলে সামনে এগিয়ে গেলাম একটি বড় ব্রীজ পার হওয়ার পরেই সাইনবোর্ডে লেখা দেখলাম বিদায় ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা। অর্থাৎ এই ব্রিজকে কেন্দ্র করে ফেঞ্চুগঞ্চ সীমানা নির্ধারন করা হয়েছে। ব্রীজ পার হওয়ার কিছুদূর পরেই হাতের বাম দিকে রেললাইন দেখতে পেলাম কিছুক্ষণ পর সেই রেললাইন দিয়ে একটি ট্রেনও চলে গেলো। রেঙ্গা হাজীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় নামে একটি স্কুল পার হওয়ার পরই পড়লো মোগলা বাজার রেল স্টেশন।

DSC00285সিলেট শহরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তিনটার মতো বেজে গেল। শহরে ঢুকেই সোজা চলে গেলাম জেলা প্রশাসকের অফিসে, ডিসি সাহেবকে পেলাম না। জানতে পারলাম উনি ঢাকায় আছেন। এনডিসি সাহেবকে খোজ করলাম তাকেও পেলাম না, উনিও অফিসে নেই। কোথায় গেছে কেউ বলতে পারেন না, কখন আসবেন তাও কেউ বলতে পারেন না, আজকে আসবেন কিনা তাও বোঝা গেল না। বাধ্য হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম তাঁর জন্য, প্রায় ৫: ৩০ মিনিট পর্যন্ত বসে থাকলাম এনডিসি সাহেবের আসায়, কিন্তু এই মহান ব্যক্তির আর দেখা পেলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম হোটেলেই উঠে যাব। শুরু হলো নতুন মিশন হোটেল খোঁজার পালা।

হযরত শাহজালাল এর মাজার থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটি হোটেল পছন্দ হলো। হোটেলের ম্যানেজার যে ভাড়া চাইলো তা আমার বাজেটের মধ্যেই ছিল। ঝামেলা দেখা দিলো আমার সাইকেল নিয়ে, আমি চাই সাইকেল রুমে রাখতে কিন্তু ম্যানেজার রুমে রাখতে দিবে না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় রাখবো?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘আপনার যেখানে ইচ্ছা রাখেন, রুমের মধ্যে রাখতে দেব না।’ আমি তো সাইকেল বাইরেখে রুমে থাকতে পারবো না, আর সাইকেল বাইরে রেখে আমি ঘুমাতেও পারবো না।

বাধ্য হয়ে নতুন আরেকটি হোটেল খোঁজা শুরু করলাম। এক রিক্সা ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই কম খরচে কোথায় হোটেল পাওয়া যাবে?’ রিক্সা ওয়ালা বলে দিলেন, ‘ভাই আপনি মাজারের কাছে চলে যান, সেখানে দামি কম দামী সব রকমের হোটেল পাবেন।’ রওনা দিলাম মাজারের দিকে। মাজার থেকে অল্প দূরেই একটি হোটেল পেলাম নাম, ‘ছোলেজা বোর্ডিং আবাসিক’; এই ধরনের অদ্ভূত নাম এই প্রথম দেখলাম, আবাসিক হোটেলটি দ্বিতীয় তলায়। বাইরে থেকে দেখেই বুঝতে পারলাম এই হোটেলটি মোটামুটি সস্তা হবে।

নিচে সাইকেলটিকে তালা মেরে উপরে উঠলাম, উঠেই একজনকে রিসিপশনে বসে থাকতে দেখলাম। তাকে বললাম, আজকের রাতটা থাকতে চাই এই হোটেলে। উনি আমাকে দেখে বললেন, আগে রুম দেখেন। আমি উত্তরে বললাম, ‘রুম পরে দেখবো’। আগে বলেন, ‘রুম পছন্দ হলে রুমে সাইকেল রাখতে দিবেন কিনা?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘ভাই আপনি কি ফেরিওয়ালা?’ আমি তো অবাক! তাকে বললাম, ‘আমাকে দেখে কি ফেরিওয়ালা মনে হয়?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘না, সেই কারণেই তো জিজ্ঞেস করছি। রুম পছন্দ করার আগেই বললেন সাইকেল রাখতে দিতে হবে। সাধারণত কেউ তো সাইকেল নিয়ে আসে না। যারা সাইকেল নিয়ে আসে তারা সাধারণত মালামাল ফেরি করে।’

আমি হেসে বললাম, ‘না ভাই আমি ফেরিওয়ালা না। আমি সাইকেল নিয়ে দেশ দেখতে বের হয়েছি।’ তিনি এই কথা শুনে বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে গেলেন, ‘বলেন কি? আপনি রুম দেখেন আগে, রুমে যা ইচ্ছা তাই রাখতে পারবেন।’ একটি ছোট ছেলেকে ডেকে চাবি দিয়ে বললেন রুম দেখাতে। আমার এক রাত নিয়ে কথা, সাইকেল রাখতে দিতে রাজি হয়েছে। রুম যে রকমই হোক, আমি রাজি। তারপরেও রুম দেখে তাঁকে বললাম আমি রাজি।

ভাড়া কতো? তিনি বললেন সবার কাছ থেকে ১৫০ টাকা নেই তবে আপনার কাছ ১২০ টাকা নেব কারণ আপনি দেশ দেখতে বের হইছেন। তিনি সেই ছেলেটিকে বললেন নিচে থেকে আমার সাইকেলটি নিয়ে আসতে। আমি চাচ্ছিলাম নিজেই নিজের সাইকেলটি উপরে তুলবো কিন্তু হোটেলের মালিক কিছুতেই রাজি হলেন না। বললেন আপনি অনেক কষ্ট করে এসেছেন আপনি রুমে গিয়ে বিশ্রাম নেন, কোন কিছু দরকার হলে আমাকে বলবেন, আমি এখানেই থাকি। তাঁর আচরণে আমি মুগ্ধ, আগের হোটেলের লোক যে ব্যবহার করলেন তার সঙ্গে এই হোটেলের লোকের ব্যবহারের পার্থক্য আকাশ আর পাতাল, মাঝখানে অনেক ফাঁকা। কথায় কথায় জানতে পারলাম এটা তাঁর নিজের হোটেল।

জিনিশপত্র রেখে শহর দেখার জন্য বের হওয়া প্রতিদিনের মতো। প্রথমেই গেলাম শাহজালালের মাজারে। মাজারে লোকজনের অভাব নেই, সারা দেশ থেকেই লোকজন আসে বোঝা গেল। মাজারের আশে-পাশে অনেক হোটেল, কম দামী থেকে শুরু কলে অনেক বেশি দামী হোটেলও চোখে পড়লো।

মাজারে ঢুকতে গেলেই কিছু লোকজন লাল হলুদ সুতা গলায় অথবা হাতে বেধে দেন, বেধে দিয়েই হাদিয়া দাবি করেন। লোকজনও এই সুতা নিয়ে ৫০/১০০ টাকা দিচ্ছে। এই কয়েকজন লোকগুলোর ভালই ব্যবসা হয় বোঝা গেল। এ ছাড়াও মাজারকে ঘিরে রমরমা ব্যবসা চলছে, খাবার-দাবার, কাপর, জায়নামায, তজবি সবই আছে আশে-পাশে। মাজার নিয়ে যে ব্যবসা হয় তা লালসালু বই পড়ে আর মুভি দেখে আগেই জানা ছিল। তবে এই ভ্রমণে এসে তা সরাসরি উপলব্ধি করতে পারলাম।

অনেককেই দেখলাম বাস ভাড়া করে এসেছেন। বাসের ছাদে বড় বড় পাতিল। মাঝারের কাছেই বিশাল মাঠ সেখানে রান্না হচ্ছে, পাসে খাওয়া-দাওয়া। সবজায়গায় পিকনিক পিকনিক ভাব।

মাজারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে জিনিশটা ছিলো আমার জন্য সেটা হলো জালালী কবুতর। এই কবুতরের কথা অনেক শুনেছি, অনেক গানেও পেয়েছি। আজকে সরাসরি দেখলামও। এই কবুতরকে সবাই খাবার দেয়, কবুতরও একটা দুইটা না ঝাঁকে ঝাঁকে।

৬৪ জেলায় যা দেখেছি-৬

Comments

comments

Comments

  1. অনেক ভালো লাগলো শরীফ, অপেক্ষায় থাকলাম পরের পর্বের।

  2. Rakib Bappi

    সাবলীল লেখনী খুব ভালো লাগলো চালিয়ে যান। 🙂

  3. Abdul Kawsar Tushar

    সুন্দর, লেখা চালিয়ে যান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.