স্বাধীনতা

425298_3396682005721_1835215139_n

শাহীনবাগে এক বন্ধুর বড় ভাইয়ের ‘মুভি প্যালেস’ নামে একটা দোকানে কাজ করি, সঙ্গে আমার বন্ধুটিও কাজ করে। দোকানে সিডি/ডিভিডি ভাড়া দেয়া হয় সঙ্গে মোবাইল ফোনের কার্ড বিক্রি ও ফোনে কথা বলা। আমার কাজ হল সিডি/ডিভিডি ভাড়া নিতে আসলে লিখে রাখা, দোকানে মোবাইল কার্ড বিক্রি করা ও কেউ ফোন করতে আসলে হিশাব রাখা টাকা রাখা ইত্যাদি ইত্যাদি।

কাজ শেষ করে বিরতীতে দুপুরে খাওয়ার জন্য বাসায় এসেছি। হঠাৎ করে দরজায় কড়া নারার শব্দ, দরজা খুলি দেখি তিনজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। ঢুকেই আমার চৌদ্দগুষ্টির বৃত্তান্ত নিল। সবকিছু শুনে কোন কথা না বলেই আমাকে টেনে বের করে পুলিশের গাড়িতে তুলে ফেলল। পাসের কোন বাসায় চুরি হয়েছে সেটার খোঁজ-খবর নিতে এসেছে তারা। আমি আর ছোট ভাই ফ্ল্যাটের একটা রুম নিয়ে ভাড়া থাকি, ফ্ল্যাটে আরো দুটি রুম আছে রুমে কেউ নেই সবাই যার যার কাজে। ছোট ভাই চাঁদপুরে বেড়াতে গেছে। কাউকে জানাবো সেই অবস্থাও নেই।

গাড়িতে উঠতে উঠতে দেখা রোজির সঙ্গে। রোজি দোকানে মাঝে মাঝে ফোন করতে আসত আর ভাইয়া ভাইয়া বলে ডাকত। কি করবো কিছুই বুঝতে পারতেছিলাম না। এক দিকে লজ্জা অন্য দিকে ভয় অদ্ভূত এক পরিস্থিতি। কোন রকমে রোজিকে বললাম তুই এমদাদকে একটু খবর দে। এমদাদ আমার মোটামুটি কাছের বন্ধু আমি যে দোকানে কাজ করি ওটা ওর বড় ভাইয়ের। আমাকে তুলে নিয়ে গেল সরাসরি তেজগাঁ থানায়।

নতুন এক পৃথিবী। কোনকিছু না বলে সরাসরি লকাপে। ঢুকে ছোট্ট একটা ধাক্কার মত খেলাম। ভেতরে আমরা প্রায় ২৫/৩০ জন হব। এক কোনায় লোকজন হিসু করে। পাশে থাকা একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম তিনটার মত বাজে। পেছন থেকে একজন বলে উঠল শরীফ না? তাকিয়ে দেখি এলাকার এক বড় ভাই জুম্মন ভাই। আমরা একসময় একসঙ্গে সিয়ার মাঝারে, শাহীনবাগের মাঠে ক্রিকেট খেলতাম। বেশিরভাগ সময় আমরা প্রতিপক্ষ ছিলাম কারণ জুম্মন ভাই খেলত টর্নেডো নামে এক ক্লাবে আর আমি খেলতাম টাইগার ক্রিকেট ক্লাবে। জুম্মন ভাইকে দেখে কিছুটা ভাল লাগল। যাক অন্তত একজন তো পরিচিত মানুষ পাওয়া গেল। জুম্মন ভাইয়ের কাছে মোবাইল ছিল। তাঁর কাছ থেকে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। কিন্তু লাইন পাচ্ছিলাম না। এদিকে মোবাইল ফোন লুকিয়ে কল করার চেষ্টা করতে হয়। দেখলেই নাকি মোবাইল নিয়ে যায়।

বিকাল পাঁচটার দিকে এমদাদের বড় ভাই হাজির এমদাদসহ। ভাইয়া কথা বলে চেষ্টা করেছেন আমাকে কিভাবে ছাড়ানো যায়। কথা-বার্তা বলে ফিরে এসে জানালেন অনেক টাকা চায়। এত টাকা দেয়ার মত অবস্থা নাই তখন। ভাইয়া এসে জিজ্ঞেস করল টাকা আছে কিনা? আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে কোন টাকা আনা যাবে কিনা? এদিকে আমি ভিতরে আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা আনবো কিভাবে? একমাত্র উপায় ছোট ভাই। তবু বললাম ভাই আপনে চেষ্টা করেন, টাকা কোন সমস্যা না। আমি বের হলেই ব্যাবস্থা করে ফেলতে পারব। ভাইয়ার কাছেও মনে হয় টাকা ছিল না। ছোট ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা ছাড়া উপায় নাই। এদিকে এমদাদ ছোট ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে ও আসলে একটা উপায় হবে। এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

এদিকে সময় কাটে না, এক একটা মিনিট যেন এক একটা দিন। ভেতরে নানারকম পিকুলিয়ার ঘটনা, কোত্থেকে এক বাউলরে ধরে আনছে সে লালনের গান গাইতেছে। ঐ অবস্থায় গান কি আর কারও ভাল লাগে! এক গুন্ডা টাইপের ছেলে আইসা বাউলরে দুইটা থাপ্পর দিল। থাপ্পর দিয়া বলে, ‘শালা বাউল গান বন্ধ কর’। থাপ্পর খাইয়া গান বন্ধ করে দিল। সেই ছেলে এক কোনায় চলে গেল। তার সঙ্গে আবার দেখলাম দুইটা চামচাও জুটাইয়া ফেলছে। সে আবার তার জায়গায় যাইয়া নিজেই গান ধরল বাউল ধরল না ধরল জেমসের ‘জেল থেকে বলছি’ গান।

আমি চুপ-চাপ এক কোনায় বসে পরলাম। সন্ধ্যা সাতটার দিকে ছোট ভাই আসল সঙ্গে এমদাদ। এসে আমাকে কিছু খাবার দিয়ে গেল। ঐ অবস্থায় খাওয়া অনেক কঠিন। ছোট ভাইকে আমি বলে দিলাম কার কাছে গেলে টাকা পাওয়া যাবে। আর সম্ভব হলে কয়েকজনকে দিয়া ফোন দেয়ার জন্য। ছোট ভাই চলে গেল টাকা ম্যানেজ করার জন্য আর আমাকে বের করার চেষ্টা করার জন্য। সেই গুন্ডা টাইপের ছেলেটা হঠাৎ করে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। বলল, ‘বসো’। বসলাম, সে আমার সব কথা শুনলো। শুনে বলল, ‘কোন চিন্তা কইর না, তুমি আমার পাসে বসো। কেউ কিছু বললে আমাকে দেখাইয়া দিবা। আমি বোমাবাজির মামলায় আসছি, মামলা চলতেছে আমারে ৩ দিনের রিমান্ডে আনছে।’

আটটার দিকে জুম্মন ভাই ছাড়া পেয়ে চলে গেল। নিজেকে অনেক অসহায় লাগছিল। মনে হচ্ছিল আমাকে জোর করে এক বাক্সতে ঢুকাইয়া রাখা হইছে। বেশি খারাপ লাগতেছিল কারণ আমি কিছু করি নাই শুধু শুধু নিয়া আসছে। রাত নয়টার দিকে রোজি রোজির আম্মাকে নিয়া হাজির। আমি মোটামুটি অবাক হয়ে গেলাম! এই মেয়েটা পাগল নাকি একটা মেয়ে মানুষ হয়ে নিজের মাকে নিয়া থানায় হাজির হইছে। অথচ আমাদের পরিচয় হইছে দোকানে। আমাকের বড় ভাইয়ের মত দেখত, এই পর্যন্তই। কিন্তু এইটুকুর জন্য মাকে নিয়া থানায় চলে আসাটা অবাক করার মতই ব্যাপার। দুনিয়াটা কেমন জানি অদ্ভূত মনে হইতেছিল। আমাকে অনেক বেশি লজ্জায় ফেলে দিল। পরে জানতে পারছিলাম, এখানে আমরা শুধু দুই ভাই থাকি আমাদের আর কেউ থাকে না তাই তাঁরা এসেছে যদি কিছু করতে পারে। রোজির আম্মা ওসির সঙ্গে কথা বলে আমাকে বলে গেল চিন্তা না করতে ওসি বলছে ছেড়ে দিবে।

এর মধ্যে কোত্থেকে পুলিশ এক হিরনচি ধইরা আনল। সে ভেতরে ঢুইকাই পায়খানা করে দিল। পুলিশ আইসা কিছুক্ষণ পিটাইল, তারপর ওরে দিয়ে ওর পায়খানা পরিস্কার করাইল। রাত নয়টার দিকে সবার জন্য খাবার আসল, বালতি ভরা ডাল, সব্জি, মাছ আর ভাত। বেশিরভাগ লোকজনই কিছু খাইল না। অল্প কয়েকজন খাইল। বেশি খাইল হিরঞ্চিটা। খাওয়ার পরে নাম লেখার জন্য একজন আসল। আইসা সবার নাম লিখল। হিরঞ্চি নাম জিজ্ঞাস করার পর হিরনচি উত্তর দিল ‘পৃথিবী’। এই টেনশনের মধ্যেও সবাই হো হো করে হেসে দিল। পুলিশ হিরঞ্চিরে উদ্দেশ্য করে বলল, হারামজাদা ফাইজলামি করস? নাম কি বল? হিরনচি এইবার বলল বাংলাদেশ। আবার সবাই হেসে উঠল। পুলিশ বিরক্ত হয়ে নাম লিখল দ্বীপ।

সবাই বলাবলি করতে শুরু করল আজকে আর ছাড়া পাওয়ার উপায় নাই। সবার নাম লিখে ফেলছে। কালকে সকালে সবাইকে কোর্টে চালান করে দিবে। জামিন না পেলে সেখান থেকে জেলখানায়। রাত ১২ টার দিকে ছোট ভাই ফিরে আসলো। এলাকায় গিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি পরিচিত নেতাদের দিয়া ফোন করাইছে। এলাকার এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু টাকাও নিয়া আসছে। ওসির সঙ্গে অনেক কথাবার্তা বলে অনুরোধ করে তিন হাজার টাকার বিনিময়ে আমাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা হল।

আমাকে লকাপ থেকে বের করে সেই ওসির সামনে হাজির করা হল। আমার নাম ঠিকানা লেখার পর স্বাক্ষর করতে বলল একটা কাগজে। আমি করলাম। সাক্ষার শেষে ওসির নেমপ্লেট দেখে বললাম আপনার নাম ‘শফিক’ তাই না? ওসি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হুমম, কেন?’ আমি বললাম আমার নাম, ‘শরীফ’। আপনার পুরা নাম মো: শরীফুল ইসলাম। আপনার পুরা নাম কি মো: শফিকুল ইসলাম?

ছোট ভাই আমাকে আর ওসির সামনে থাকতে দেয় নাই। আমাকে টেনে বের করে নিয়ে আসল। লকাপ থেকে বের হওয়ার সময় একজন একটা কাগজ দিয়ে বলেছিল যদি পারেন আমার বাসায় একটা খবর দেয়ার ব্যবস্থা কইরেন। থানা থেকে বের হয়ে ফোন ওই ছেলের বাসায় খবর দিলাম। তারপর ছোট ভাই এমদাদরা মিলে হেঁটে হেঁটে বাসার দিকে রওনা দিলাম।

কথা বলতে বলতে ছোট ভাইয়ের কাছে জানতে পারলাম কার কার কাছে টাকার জন্য গিয়েছিল। কে কে ফিরিয়ে দিয়েছিল। এর মধ্যে বলতেছিল জানো, ‘মৌকে ফোন দিছিলাম তারপর ওর কাছে গেছি, অনেক মন খারাপ ছিল বেশি টাকা দিতে পারে নাই তাই। তারপরও একটা খামে কিছু টাকা দিয়েছে। ঐ টাকাটা দিতে এত লজ্জা পাচ্ছিল যে পরে আমার নিজেরই খারাপ লাগছে।’ টাকার সংখ্যা কত ছিল সেটা এখানে উল্লেখ করা অমূলক। কিন্তু সেই লজ্জায় যে কি পরিমাণ ভালবাসা ছিল তা ভাবতেই অন্য রকম লাগে। আর ঐ সময় সে মাত্র দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী এর বেশি ভালবাসা ছাড়া আর কি-ই বা দিতে পারতো?

ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম রাত দুইটা বাজে। অর্থাৎ পুরোপুরি বার ঘণ্টার মত ভেতরে ছিলাম। এই বার ঘণ্টা বার মাসের চাইতেও বেশি মনে হইছিল। বের হওয়ার পর বুঝতে পারলাম স্বাধীনতা কি জিনিস। নিজেকে পাখির মত মুক্ত মনে হচ্ছিল। ভেতরে না গেলে কোনদিন বুঝতে পারতাম না এই স্বাধীনতার মানে কি? যারা গেছেন শুধু তারাই এটার মানে বুঝতে পারবেন।

১৬ ভাদ্র ১৪২১

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.