১
ঈদের দ্বিতীয় দিন…
সদরঘাট থেকে রওনার জন্য খেয়েদেয়ে প্রস্তুত আমি আর Md Shariful Islam …
আগে গুটিকতকবার লঞ্চে যাতায়াত যা করেছি…
তার সবটাই অন্যের উপর ভরসা করে…
টিকেট-কেবিন সব ঠিক যেয়ে শুধু উঠে পরা…
এবারের চিত্র অবশ্য ভিন্ন…
ঘুঁড়ে ঘুঁড়ে আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি পটুয়াখালীর লঞ্চ…
বেঁছে বেঁছে বড়সড় একটা লঞ্চে উঠে বসলাম…
সুন্দরবন-১১ মাস্টারের রুমে আমাদের ব্যবস্থা হলো…
তিল ধারণের জায়গা নেই লঞ্চে…
তবে মাস্টারের পাশে শুয়ে শুয়ে যাত্রাপথ দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে…
সেটাতে আমরা রোমাঞ্চিত…
অলসভাবে ছুটিটা কাটিয়ে দেবো…
এই ভেবে যাত্রা শুরু হলো…
শুরু হলো গল্পের শুরুর ধাপ…
২
আমরা যখন গুছিয়ে বসতে শুরু করেছি…
তখন ডেকের যাত্রীরা একঘুম দিয়ে আড়মোড়া ভাঙছে…
সম্ভবত তারা সকাল থেকেই লঞ্চের জায়গা দখল করে পরিবার…
পরিজন নিয়ে বিছানা-বালিশ-কাঁথা দিয়ে আরাম করে ঘুমিয়ে ছিল…
এখন ছাড়ে তখন ছাড়ে করতে করতে অবশ্য সোয়া ছয়টায় লঞ্চ ভেঁপু বাজিয়ে…
সদরঘাটকে পেছনে ফেলে রওনা দিলো পটুয়াখালীর জলে…
আমাদের প্রথম গন্তব্য ফতুল্লা নৌ-বন্দর…
টুপ করেই যেন সন্ধ্যা নেমে এলো…
ঝিরি ঝিরি হওয়ায় চলছে লঞ্চ…
লঞ্চের মাস্টার ফারুক ও ওমর ভাইয়ের সাথে পরিচয় হলো…
কবির ভাই আমাদের জন্য চায়ের ব্যবস্থা করলো…
তার আগেই ফারুক ভাই সাবধান করে দিলো…
লঞ্চে অপরিচিত-সদ্যপরিচিত-অল্পপরিচিত কারো কাছ থেকেই…
কিচ্ছুটি খাওয়া যাবে না… তা সে যত বিগলিত ব্যবহারই করুক না কেনো…
কিভাবে কিভাবে যাত্রীরা প্রতারিত হয় সর্বশান্ত হন তার গুটি কতক বর্ণনাও দিলেন…
লঞ্চ চলছে… চুইয়ে চুইয়ে সন্ধ্যা নামছে… যাত্রীরা আলো আধারিতে…
সঙ্গে নিয়ে আসা রাতের খাবার খাওয়ার আয়োজন শুরু করলো…
আমরা নতুন আবিস্কার করলাম ডেকের প্রায় সকলেই টিফিন-ক্যারিয়ার-হাড়ি-পাতিলে করে ভাত-ডাল-তরকারি এনেছে…
এই প্রথম আবিস্কার করলাম এই রুটের যাত্রীরা কত বুদ্ধিমান…
তারা সকলেই ভাতে পানি দিয়ে এনেছে… পানি ভাত দিয়ে ঈদের মাংস দিয়ে খাচ্ছে…
গরমে ভাত যাতে নষ্ট না হয়ে যায় সম্ভবত সে কারণে ভাতে পানি দিয়ে এনেছে…
এই মহাসত্য আবিস্কার করে আমি আর শরীফ দুজনেই…
আমেরিকা আবিস্কারের স্বাদ নিয়ে কাঁচের জানালা দিয়ে…
তাদের স্বপরিবারে খাওয়ার দৃশ্য অবলকোন করতে লাগলাম…
পরম মমতা নিয়ে মা তার সন্তান-স্বামীকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে…
চোখে জল আসার মতো দৃশ্য…
মাস্টার ওমর ভাই বললো ছোট্ট করে দুটি হর্ণ মেরে দে…
আমরা ফতুল্লা এসে গেছি…
ঘাটে প্রচুর যাত্রী অপেক্ষা করছে…
আরো দূরে যাবে বলে…
৩
চাঁদের আলোয় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের সুন্দরবন-১১..কে…
আমাদের সামনের ডেকের অধিকাংশ যাত্রী গভীর ঘুমে…
দু’একজন গুটিশুটি মেরে গল্প চালিয়ে যাচ্ছে…
অবশ্য স্মার্টফোনের যুগে গল্প আর কতটা চলে…
সবাই এত্তোক্ষণ ব্যাস্ত ছিল ফোন নিয়ে….
মাস্টারের বকুনি খেয়ে আপাতত ডেকের মোবাইল বন্ধ…
লঞ্চ এত্তক্ষণে বরিশালের জলে ঢুকে পরেছে…
ও বলতে ভুলে গিয়েছিলাম…
রাত নয়টার সময়ই আইর মাছ সহযোগে লঞ্চের ক্যান্টিনে রাতের খাবার পর্বটা সেরে নিয়েছি আমরা… রান্না খারাপ না…
এখন বেশ আয়েশ করে বসে আমরা চাঁদ দেখছি… চাঁদের আলো দেখিছি…
চাঁদের আলোতে জল দেখছি… মনে হচ্ছে আমরাই চালিয়ে নিয়ে চলছি এই চলমান ভূখণ্ডকে…
করিডরে শুয়ে থাকা চাচামিঞা খুক খুক করে কাশছে…
দূরে কোথায় দুই নারী বসে উচ্চস্বরে তাদের পারিবারিক আলোচনা করছে…
আমি অবশ্য নিচু গলায় একবার ছাদে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলেছিলাম…
শরীফ অবশ্য কিছুতেই এই মুগ্ধতা ছেড়ে উঠতে রাজি নয়…
লঞ্চ চলছে… চলছে আমাদের গল্প… মাস্টারদের এক দল গেছে ঘুমাতে…
তারা রাত ২ টায় ফিরবে… এখন ওমর ভাইয়ের নেত্রীত্বে লঞ্চ চলছে…
ওমর ভাই আমাদের মানুষের সততা ও ধর্ম নিয়ে ব্যাপুক জ্ঞান দিলেন…
তিনি মূর্খ হয়েও কেমন করে ভালো অংকের টাকা উপার্যন করছেন…
আর তার বড় শ্যালক শিক্ষিত হয়েও দুবাইতে যেয়ে দেড়শ ভেড়া চড়াচ্ছে সে গল্প শোনালেন… শ্যালক ঈদের দিনও ছুঁটি পায়নি… ভেড়ার গু-মুত পরিস্কার করেছে…
সে গল্পটা বলার সময় তার মুখ খুশিতে চকচক করে উঠলো…
নিজে দুবাই যেতে না পারার গল্পটা ঠিক আড়াল করতে পারলেন না ওমর ভাই…
লঞ্চের জিপিএসে পিপ শব্দ হতেই ওমর ভাই পাল্লা শুরু করলেন লঞ্চ রুপালী’র সাথে…
যথারীতি সরে আসলেন ডান পাশে… ঢুকে পরলেন খাড়িতে…
ডুবা চরে ঘঁষা খেয়ে ব্যাপক শব্দ করে লঞ্চ ঢুলে উঠলো…
ঘুমন্ত যাত্রীরা হকচকিয়ে উঠে বসলো…
কোনো এক কেবিন থেকে এক বিশালদেহী ভদ্রলোক আমাদের রুমের দরজা ঠেলে…
মাস্টারকে শাসিয়ে গেলেন এভাবে যেনো না চালায়… মাস্টার ও সাগরেদ মহাবিরক্তিতে গজ গজ করতে লাগলো… কারণ রুপালী আমাদের ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে বহুদূর…আমরা জানালার কাঁচ তুলে দিয়েছি… বাতাস বাড়ছে… নিরবতা বাড়ছে… সার্চ লাইটের আলোতে দূরের গাছপালা দেখা যাচ্ছে… দেখা যাচ্ছে না সেখানে কারা থাকে… কি করে… জানা হলো না তাদের গল্পগুলো… কারণ আমাদের এগিয়ে যেতে হবে… সামনে আমাদের জন্য আরো গল্প অপেক্ষা করছে বলে…
.
কুয়াকাটা ভ্রমণ বৃত্তান্ত (২)–মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ