২৪ মার্চ (নওগাঁ থেকে চাপাইনবাবগঞ্জ)
আমি সাধারণত বড় কোন হোটেলে নাস্তা করতাম না। রাস্তার পাশে ছোট দোকানে ঢুকতাম নাস্তা করার জন্য। ছোট দোকানে ঢুকার দুইতিনটা কারণ আছে। একে এইসব দোকানের খাওয়াদাওয়ার খরচ কম। দ্বিতীয়ত বেশিরভাগ ছোট দোকানের লোকজন অনেক যত্ন নিয়ে খাওয়ায়। আর তৃতীয়ত শ্রমিকশ্রেনির অনেক লোকজন পাওয়া যায়। যাঁদেরকে সবসময় ব্যক্তিগতভাবে আপন মনে হয়।
এমন একটি দোকান থেকে খাওয়াদাওয়া করে বের হয়েছি। এমন সময় একটি ঘটনা ঘটলো যাঁর জন্য আমি একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। সাইকেল চালাচ্ছি পেছন থেকে এক রিক্সাওয়ালা ডাকছেন, ‘ভাই একটু দাঁড়ান, ভাই একটু দাঁড়ান।’
আমি পিছনে তাকিয়ে দাঁড়ালাম। রিক্সা কাছে আসার পরে রিক্সায় বসে থাকা এক মহিলা আরোহী আমার সঙ্গে কথা বলা শুরু করলেন। সঙ্গে তাঁর ছোট একটি বাচ্চাও বসা।
‘ভাই কিছু মনে কইরেন না। আপনে কি করেন?’
‘বর্তমানে তো আমি কিছু করি না, সাইকেল নিয়ে ভ্রমণে বের হয়েছি বাংলাদেশ দেখার জন্য। তবে আগে একটা চাকরী করতাম। ঐটা ছেড়ে দিয়েছি।’
‘ও আচ্ছা। আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। আমার এই ছেলে আপনাকে দেখিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল আপনে কি করেন? আমি দুষ্টামি করে বলেছিলাম সাপের খেলা দেখান। এখন সে কান্না করছে যে সে সাপের খেলা দেখবে। এখন আপনে যদি ওর সঙ্গে একটু কথা বলেন তাহলে ভাল হয়।’
আমি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘সাপ তো ঘুমিয়ে আছে যখন ঘুম থেকে উঠবে তখন তোমাকে সাপ এবং খেলা দুইটাই দেখাবো।’ আমার পকেটে সবসময় চকলেট থাকতো ছেলেটিকে দুইটি চকলেট দেয়াতে শান্ত হল। মহিলা আমার কাছে অনেক দুঃখ প্রকাশ করলেন এই রকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য। কথায় কথায় জানতে পারলাম মহিলা একটি প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করেন।

উনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার পথে নামলাম। বলিহারপুর সেতু পার হওয়ার পর একটি বাজার পেলাম নাম সতীহাট। আর যে নদীটি পার হয়েছিলাম সেই নদীর নাম আত্রাই। নদীতে একদমই পানি ছিল না, পুরাই মরুভূমি। সেতু পার হওয়ার পরেই পাশ দিয়ে একটি রাস্তা চলে গেছে মান্দা-নিয়ামত পুরের দিকে। গাইবান্ধায় থাকার সময় মমিন ভাই এই রাস্তার হদিশ দিয়েছিলেন। মমিন ভাইয়ের বাড়ি নিয়ামতপুর, উনি অবশ্য গাইবান্ধা থাকতেই বলে দিয়েছিলেন আমি চাইলে নিয়ামতপুর থাকতে পারি। কিন্তু আমার থাকার ইচ্ছা নেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চাপাইনবাবগঞ্জ চলে যেতে চাই।
কিছুদূর এগুনোর পরেই দেখি একটি ট্রাক খাদের পাশে উল্টে আছে। লোকজন সেটাকে তোলার চেষ্টা করছেন। সেই মানুষের জ্যাম পার হওয়ার পরেই আরেকটা নদী পেলাম, লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম নদীর নাম শিব। আত্রাই নদীরই একটি শাখা শিব। আমার রাস্তাটাও একদম শিব নদীর পাশ দিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত গিয়েছে।
সাইকেল চালাতে চালাতে আরেকজন সঙ্গী পেয়ে গেলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম তিনি ব্যবসা করেন। বাজারে একটা সিডি-ভিসিডির দোকান আছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি দেশ দেখতে বের হয়েছি কেন। এই কেনর উত্তর দেয়া কঠিন। নানা রকম প্রশ্নের মধ্যে তিনি আজব একটা প্রশ্ন করলেন। ‘ভাই আপনে কি হিট খাইছেন?’ আমি তাঁর প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললাম। কেন জানি অনেক হাসি পেল তাঁর কথায়। হাসি থামিয়ে বললাম, ‘না।’ আমি আবার পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘ভাই আপনে হিট খাইলেন কেমনে?’
আমার প্রশ্ন শুনে তিনি আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, ‘আমি কিভাবে বুঝলাম তিনি হিট খাইছেন।’ আমি হেসে দিয়ে বললাম, ‘ধারণা করেছি।’ তিনি বেশ দুখি মুখ নিয়ে তার গল্প বলে গেলেন সংক্ষেপে। তিনি এইচএসসি পাশ করার পর আর পড়ালেখা করেন নাই। কলেজে থাকতেই এক স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে পছন্দ করতেন। কলেজে থাকা অবস্থাতেই এই সিডিভিসিডির দোকানটি করেছিলেন। তিনি ভিসিডির দোকান করেন তাই মেয়ের পরিবার থেকে রাজি হলো না।
তিনি দোকানটি ছেড়েও দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে অন্যত্র। তিনি অবশ্য এখন অন্য কাজ খুঁজছেন পেলেই এই কাজ ছেড়ে দিবেন। ভিসিডির দোকান গ্রামের অনেকেই ভাল চোখে দেখেন না। তাঁর দুঃখের গল্প শুনাতে শুনাতে তিনি তাঁর গন্তব্যে চলে এসেছেন। আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলেন। বিদায় নেওয়া প্রায় প্রত্যেকটি মানুষই একটা কথা বলতেন। ‘ভাই অনেক কথা বলেছি ভুলত্রুতি ক্ষমা করবেন।
গাবতলী নামক একটা জায়গা পার হওয়ার পর আশেপাশে দৃশ্য পাল্টাতে শুরু করল। অনেকদূর পর্যন্ত রাস্তার দুইপাশে তালগাছ। তালগাছের শেষ হওয়ার পরেই শুরু হইল বাঁশঝাড়। রাস্তার দুইপাশে এই রকম দৃশ্য দেখা বিরল। গাংগোর নামক জায়গায় কিছুক্ষণের জন্য যাত্রা বিরতি করলাম।
এক দোকানে ঢুকলাম খাওয়ার জন্য, তখন প্রায় দুপুর। দোকানে অন্য দুইজন লোক গল্প করছিলেন। আমাকে দেখে জায়গা ছেড়ে দিলেন। জানতে পারলাম তাঁরা চাকরী করেন একটি কোম্পানির রিপ্রেজেন্টিভ হিসেবে। এই দোকানে এসেছেন মাল দেয়ার জন্য। আমার কথায় তারা বেশ এক্সাইটেড হয়ে গেলেন। আমি জুস আর কেক খেলাম কিন্তু তাঁরা আমাকে বিল দিতে দিলেন না। পাশাপাশি দোকানের মালিকও আমার জন্য ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি আনলেন। এই ধরণের আতিথেয়তা প্রতি নিয়তই পাচ্ছিলাম। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার রওনা দিলাম আমার পথে।
আমার পরবর্তী গন্তব্য নাচোল। তারপর চাপাই। পথে নামার সঙ্গে সঙ্গেই আরেকজন সাইক্লিস্ট পেয়ে গেলাম। তাঁর এক হাত নেই। এক হাতেই সাকেল চালাচ্ছিলেন। আরেক হাত কনুই থেকে নাই। তিনিও চাপাই যাবেন তবে তাঁর অনেক তাড়া। অনেক দ্রুত চালাচ্ছিলেন, আমি তাঁর সঙ্গে চালিয়ে পেরে উঠছিলাম না।
তিনি বাজার থেকে আধা কেজি শশা কিনেছিলেন সেখান থেকে আমাকে একটা দিলেন। আমার কাছে খেজুর ছিল কেক ছিল সেখান থেকে আমিও তার সঙ্গে খাবারের সঙ্গী হলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম এখানে তাঁর আমের বাগান আছে। চাপাই যাচ্ছেন বিষ আনতে। আমি অবাক হয়ে জানতে চাচ্ছিলাম বিষ কেন? তিনি আমাকে বুঝিয়ে বললেন, আমের বাগানে অনেক পোকা হয়। যা গাছের জন্য ক্ষতিকর, বিষ দিলে পোকা আক্রমণ করতে পারে না তাই বিষের প্রয়োজন হয়। তিনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত বেগে চলে গেলেন। কারণ সন্ধ্যার মধ্যে তাঁর আবার ফিরতে হবে।
নাচোল পার হয়ে এক সময় চাপাইনবাবগঞ্জ পৌঁছালাম। পৌঁছেই ফোন দিলাম কোরেশী ভাইয়ের পরিচিত একজনকে। তিনি আমাকে বলে দিলেন কিভাবে যেতে হবে। ভাইয়ারা একটি বাড়িতে ম্যাস করে থাকেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বের হলাম শহর দেখতে। চাপাই শহরটা বেশ ছিমছাম, দেখতে ভালই লাগলো। বেশ কিছু আম বাগানো চোখে পড়লো।
জেলা প্রশাসকের বাস ভবনের সামনেও বিশাল এক আম বাগান। আম বাগানের মাঝকান দিয়ে আঁকাবাকা সুন্দর পথ চলে গেছে। একটি হোটেলে হালকা নাস্তা করে নিলাম। সন্ধ্যায় রাস্তার এক মোড়ে গম্ভিরা গান শোনারও সৌভাগ্য হলো। গম্ভিরা এই এলাকারই সঙ্গীত। গম্ভিরা গানের সঙ্গে অনেক রকম ম্যাসেজও দেয়া হয়। এখানকার গানেও ম্যাসেজ ছিল। এই দিনের গানের বিষয় ছিল যক্ষ্মা। নানা নাতীর গল্পের মধ্যে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যক্ষ্মা কেন হয় এবং এর প্রতিকারে কি কি করতে হবে।