২৫ মার্চ (চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী)
চাপাই থেকে সকালে যখন রওনা দেই তখন ঘড়িতে আটটা। প্রথমে যে থানাটা পড়লো নাম গোদাগাড়ি। গোদাগাড়ি পার হওয়ার পর একটি বিডিআর ক্যাম্প পেলাম। বিডিআরের সদস্যরা আমাকে থামালো। তাদের কাছে আমার ছোটখাট একটা সাক্ষাৎকার দিতে হলো। সবকিছু শুনে, শুভ কামনা জানিয়ে বিদায় দিলেন।
কিছুদূর সামনে এগুনোর পরেই তিনজন স্কাউট সদস্য পেলাম। তাঁরা একটি স্কুলে পড়ে। একশ মাইল হাঁটতে বেড়িয়েছেন। জিজ্ঞেস করাতে বুঝিয়ে দিলেন। তাঁদের একটা সার্টিফিকেট আর ব্যাচের জন্য একশ মাইল হাঁটতে হয়। হাঁটার মধ্যে কাগজেকলমে একটি রিপোর্টও করতে হয়। রিপোর্টি জমা দিলে স্কাউট কর্তৃপক্ষ তাঁদের একটি ব্যাচ আর সার্টিফিকেট দিবে। এভাবে অনেকগুলা ব্যাচ বাড়তে বাড়তে তাঁরা ধাপে ধাপে উপরের দিকে উঠতে থাকে। তিন জনে আবার গায়ের সঙ্গে তিনটি ব্যানারের মতো ঝুলিয়ে রেখেছেন। তিন ব্যানারে তিন রকম স্লোগান। সমাজ সেবায় রোভার। সন্ত্রাস ও দুর্নীতি মুক্ত করতে রোভার। আরেকটিতে লেখা, দেশ উন্নয়নে রোভার।
তাঁদের সাথে কথা বলতে পেরে বেশ ভাল লাগলো। ওরা আমার ছবি তুললো আমিও উনাদের ছবি তুললাম। তারপর যাঁর যাঁর পথে রওনা দিলাম। হালকা আগানোর পরে উঁচুনিচু রাস্তা শুরু হলো। নামার সময় বেশ আরাম লাগে কিন্তু উঠতে গেলেই অনেক কষ্ট হয়। আর এখানকার গরমটা অত্যাধিক এবং অন্যরকম। অন্যরকম বলতে অনেক গরম লাগে কিন্তু কিন্তু কোন ঘাম হয় না। বুঝতে পারছিলাম কেন রাজশাহীতে এত আম হয়। এই আবহার কারণেই মনে হয় রাজশাহীর আম অন্য রকম।
একটা উঁচু রাস্তায় উঠার পর কিছুক্ষণ থামলাম পানি খাওয়ার জন্য। এমন সময় পাশেই দুইজন মটর সাইকেল আরোহী থামলেন। সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনে কি সাইকেল ভ্রমণে বের হয়েছেন?’ আমি বেশ অবাক হলাম। সাধারণত কেউ এভাবে জিজ্ঞেস করেন না। সবাই নানা রকম উদ্ভট প্রশ্ন করেন। আমি তাঁর কথাতে ‘হ্যাঁ’ উত্তর দিলাম। তিনিই কথা বলা শুরু করলেন।
তিনি অনেক দূর থেকেই বুঝতে পেরেছেন আমি সাইকেল ভ্রমণে বের হয়েছি। বিশেষ করে আমার আমার পেনিয়ার দেখে তাঁর এই ধারণা হয়েছে। তিনি গল্পে ঝুড়ি খুলে বসলেন, পাশে একটি চায়ের দোকান ছিল সেখানেই আমরা বসলাম। আমারও বিশ্রাম নিতে ইচ্ছা করছিল গরমের কারণে। তিনি জানালেন অনেকদিন আগে কোন বিদেশি চাপাই এসেছিলেন সাইকেল ভ্রমণে। সে তাঁবু নিয়ে বাগানে থাকার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তিনি ঐ বিদেশিকে বাগানে থাকতে দেন নাই নিজের বাসায় নিয়ে রেখেছেন। ঐ সাইক্লিস্টকে দেখেই আমার ব্যাপারে তার সন্দেহ হয়েছিল যে আমিও সাইকেল ভ্রমণে বের হয়েছি কিনা।
দুইজনের মধ্যে কথা হচ্ছিল বেশি যিনি মটর সাইকেল চালাচ্ছিলেন তাঁর সঙ্গে। কথায় কথায় জানতে পারলাম তিনি ঢাকাতেই ছিলেন এক সময়। তিনি নাখাল পাড়াতে থাকতেন, আমার কাছে যখন শুনলেন আমার জন্ম নাখাল পাড়াতেই তখন গল্প আরো জমে উঠলো। নাখাল পাড়ায় কে কোন জায়গায় থাকতাম তা জেনে নিলাম। দুই জনেই পশ্চিম নাখাল পাড়াতেই থাকতাম। তিনি প্রেম নগরে আর আমি এগার নাম্বার গলিতে। নানারকম কথাবার্তা স্মৃতিচারণ শেষে আমি আমার পথে রওনা দিলাম।
দুপুরের দিকেই রাজশাহী পৌঁছে গেলাম। শহরে ঢুকার আগে ফোন দিলাম রতন নামে একজনকে। রতন ভাইদের বাসাতেই আজ রাতের থাকার ব্যবস্থা। রতন ভাইয়ের বড় ভাই কোরেশী ভাইয়ের বন্ধু। উনারা সম্ভবত এক সঙ্গেই পড়ালেখা করেছেন। রতন ভাই আমাকে বলে দিলেন কাওকে জিজ্ঞেস করে আমি যেন নগর ভবনের সামনে অপেক্ষা করি। তিনি এসে আমাকে নিয়ে যাবেন।
কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরেই রতন ভাই হাজির। অবশ্য আসতে কিছুক্ষণ দেরিই করলো বলা চলে। অবশ্য আমার অপেক্ষা করতে তেমন সমস্যা হয় নাই। নগর ভবনের উল্টা পাশে একটি মোবাইলের দোকান ছিল। তিনি আমাকে ভিতরে ডেকে নিয়ে গেলেন। বললেন ভাই বাইরে অনেক গরম আপনে ভিতরে বসেই অপেক্ষা করেন। আমাদের কথাবার্তার মাঝেই রতন ভাই এসে উপস্থিত।
উনার দেরি করে আসার কারণটা বুঝতে পারলাম। তিনি বাজার থেকে মুরগি কিনে এনেছেন। আমার জন্যই আলাদা বাজার এটা বুঝতে আমার সমস্যা হলো না। পরিচয়পর্বের সময় জানতে পারলাম আমরা সমবয়সী। তাই রতন সরাসরি বলে দিল সে ভাই ডাকতে পারবে না আর আপনিও বলতে পারবে না। আমাকে নাম ধরে ডাকবে আর আমিও যেন তাকে নাম ধরে ডাকি আর তুমি করে বলি। বেশ মজা লাগতো তাঁর এই প্রস্তাবে।
রতনও একটি সাইকেল নিয়ে এসেছিল। আমরা দুইজনে সাইকেল উদের বাসার উদ্দেশে রওনা দিলাম। রওনা দেয়ার আগে মোবাইল দোকানদারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলাম। রতনের বাসায় পৌঁছাতে আমাদের মিনিট দশেকের মত লাগলো। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম।
তারপর রতনকে নিয়ে বের হলাম একটি কম্পিউটারের দোকানের খোঁজে। আমার ক্যামেরার মেমোরিকার্ড ভরে গেছে ছবি তুলতে তুলতে বেশি জায়গা নেই, সিডি করতে হবে। রতনের বাসার পাশেই একটি দোকান পেলাম সেখানে ঢুকে দুইটি সিডি করে নিলাম। দোকানটি রতরেন পরিচিত ছিল তাই শুধু সিডির টাকাটাই নিল। আবার বাসায় ফিরলাম, জিনিশপত্র রেখে দুইজনে বের হলাম গোসল করার জন্য। রতনই জিজ্ঞেস করেছিল কোথায় গোসাল করবো বাসার কলে নাকি পুকুরে? আমি পুকুরই বেছে নিলাম। দুইজনে গোসল করে বাসায় ফিরে খাওয়াদাওয়া করে নিলাম।
বিকালের দিকে রতনের সঙ্গে বের হলাম শহর দেখতে। যেহেতু দুইজনেরই সাইকেল আছে তাই আর কোন সমস্যাই রইল না। দুইজনের সাইকেল না থাকলে হয়তো পায়ে হেঁটে অথবা রিক্সায় ঘুরতে হতো। আমরা প্রথমেই গেলাম নিউমার্কেটে। এই একটা আজব বিষয় মোটামুটি বেশিরভাগ জেলাতেই নিউমার্কেট নামে একটা মার্কেট থাকে। আমার আগের ধারণা ছিল নিউমার্কেট শুধু দুইটা একটা ঢাকায় আরেকটা কলকাতায়। কিন্তু ভ্রমণে বের হয়ে আমার অনেক ধারণা ভ্রান্ত মনে হচ্ছিল।
রাজশাহী শহরটা অন্যান্য শহরের চাইতে একটু পরিষ্কারই মনে হচ্ছিল। বিশেষ করে সবুজ চোখে পড়ার মত। সব রাস্তাতেই মনে হয় গাছ ছিল। নিউমার্কেটে আমরা হালকা নাস্তা করলাম। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য পদ্মার পার। নাস্তা করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। শহরে একটি মশাল মিছিল দেখলাম। মিছিলটি যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে বের করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
পদ্মার পারে পৌঁছে দেখি অনেক লোকজন। বিকাল এবং বিকালের পরে শহরের অনেক লোকজন এখানে ঘুরতে আসে। দুইজনে মিলে রাত পর্যন্ত বসে বসে গল্প করলাম। আস্তে আস্তে লোকজন কমতে শুরু করলো। ফেরার পথে আরেকটি মিছিল চোখে পড়লো। ছোট্ট মিছিলটি বাসন্তি পূজার, নেচে গেয়ে আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেল। মিছিল যাওয়ার পর আমরা বাসার পথ ধরলাম।
রতন এখন ঢাকায় থাকে। কাওরান বাজারে। চাকরী করছে।
দেখা করতে হবে একদিন।