২৬ মার্চ (রাজশাহী থেকে নাটোর হয়ে সিরাজগঞ্জ)
ভ্রমণে যে কয়েকটা পরিবারের সঙ্গে ছিলাম বেশিরভাগ সময়ই দেখা গেছে পরিবারের সবার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে বিদায় নেয়ার সময়। এমনিতে প্রথমে যাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় তার সঙ্গেই সারাদিন থাকা হয়। কোন প্রয়োজনে তাকেই বলতে হয়। এখানে ব্যতিক্রম হলো না, রতনের বাবা-মা সবার সঙ্গে পরিচয় এবং বিদায় একসঙ্গেই হইল। সবাই যেটা বলেন ঠিক মত আদরযত্ন করতে পারলেন না। আমার অনেক কষ্ট হয়েছে এই ধরনের কথাও বাদ থাকলো না। তবে আমি কোন পরিবারের সঙ্গেই খুব একটা খারাপ ছিলাম না। বরং তাঁদের এই রকম একটা অপরিচিত মানুষকে আপন করে নেয়াকে প্রতি নিয়ত অবাক হচ্ছিলাম এবং উপভোগ করছিলাম।

রতন আমাকে মূল রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। নাটোরের রাস্তা কোন দিকে সেটা দেখিয়ে দিল। আমাকে রাস্তা দেখিয়ে সে চলে গেল তাঁর টিওশনিতে।
আমি নাটোরের পথে রওনা দিলাম। প্রথমেই পেলাম রাজ রাজশাহী প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বানেশ্বর নামক একটা জায়গা ক্রস করার সময় পরিচয় হলো এক ছেলের সঙ্গে। আমি যখন তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলাম আমার কথার পরপরই সে চিৎকার করে বলে উঠতো আল্লাহু আকবার। অথবা কোন কথার শেষে আলহামদুল্লিাহ। প্রথমবার যখন আল্লাহু আকবার বলে চিৎকার দিল তখন আমার সাইকেলের ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলার অবস্থা। কারণ সে এতটাই আচমকা চিৎকার করে আল্লাহু আকবার বলছিল যার জন্য আমি আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম না। অবশ্য পরবর্তীতে আর সমস্যা হয় নাই। সে কথাবার্তার মাঝখানে জানালো সে একজন শিবির কর্মী। কোন একটি পদেও আছেন। বিদায় নেয়ার সময় নাম্বারও দিলেন যেন পথে কোন সমস্যা হলে উনাকে ফোন দেই। আর উনার কোন চাচা আছে শিবিরের বড় নেতা নাম বললেই হবে, ফোনও দিতে হবে না।
উনার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর হাপ ছেড়ে বাঁচলাম। তবে এই ধরনের অভিজ্ঞতাটা খারাপ লাগছিল না। এই ধরণের ঘটনা না ঘটলে ভ্রমণটা হয়তো একদমই পানসে হয়ে যেত। পুঠিয়া পার হওয়ার পর নাটোরের পথে এক ভ্যানচালকের সঙ্গে কথা হলো। তাঁর সঙ্গে পুরাপুরি নাটোর পর্যন্ত আসলাম। তিনি থাকাতে কথা বলতে বলতে যে কখন চলে আসছি বুঝতেই পারলাম না। রাজশাহী থেকে নাটোরের দূরত্ব ৪৫ কিলোমিটারের মতো।
নাটোর শহরে ঢুকার মুখেই চোখে পড়লো একটি আড়ৎ। চামড়ার আড়ৎ, এখানে চামড়া বেচাকেনা হয়। ঢাকার বাইরে এইরকম একটা আড়ৎ থাকতে পারে তা আমার ধারণাতেও ছিল না। থাকলে হয়তো কয়েকজন বেচাবিক্রি করবে কিন্তু এমন বড় আড়ৎ হবে তা ধারণার বাইরে ছিল। চামড়ার আড়ৎ পার হওয়ার পরেই রেল স্টেশন চোখে পড়লো। যদিও স্টেশনের ভিতরে ঢুকলাম না।
কিছুক্ষণ সামনে এগুতেই একটি চার রাস্তার মোড়। সেখানে আসেপাশের কয়েকটা দোকান থেকে বেশকিছু লোকজন বের হল খাওয়াদাওয়া করে। সবাই বের হল খাবারের দোকান থেকে তাই পরিষ্কার বোঝা গেল সবাই খাওয়াদাওয়া করেই বরে হয়েছেন। বের হয়েই একজন চিৎকার করে বলতে থাকলো ‘ব্যানার কই, ব্যানার কই।’ একজন হন্তদন্ত হয়ে ব্যানার নিয়ে হাজির। সামনে ব্যানার নিয়ে বিশ-পঁচিশ জনের একটি মিছিল বের হল। ব্যানারে লেখা ‘স্বাধীনতা শোভাযাত্রা।’ আর আয়োজন করেছে ‘সমকাল’। তাঁরা সবাই মাত্র পাঁচ মিনিট হাঁটলেন। দুই ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুললেন, তারপর শোভাযাত্রা শেষ। সব কিছুই আমার চোখের সামনেই ঘটলো।
পরের দিন নিশ্চয়ই পত্রিকায় নিউজ আসবে। ২৬ মার্চ উপলক্ষ্যে ‘সমকালে’র আয়োজনে বিশাল শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রাটি শহরের বিভিন্ন সড়র প্রদক্ষিণ করেছে। সারা বাংলাদেশের অনেকেই হয়তো এই খবরটি পড়বেন। কিন্তু আসল খবর হয়তো কেউ জানবেও না, এরা আসলে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করেন নাই। মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য রাস্তায় নেমেছিলেন। ছবি তুলেছেন খাওয়াদাওয়া করেছেন তারপর মনের আনন্দে বাসায় চলে গেছেন। পত্রিকা কি না করতে পারে…
এই কাণ্ড দেখার পর আমি খাবারের দোকান খুঁজতেছিলাম। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয় নাই। কিন্তু ৪৫ কিলোমিটার চালানো হয়ে গেছে। একটি খাবারের দোকান দেখে ঢুকে পড়লাম। খাবারের সাইনবোর্ডে লেখা ছিল, এখানে নাটোরের ঐতিহ্যবাহী কাঁচাগোল্লা পাওয়া যায়। কাঁচাগোল্লার লোভেই এই দোকানে ঢুকলাম। ডিম, পরাটা আর কাঁচাগোল্লা দিয়ে সকালের নাস্তা করলাম। দোকানের নামটাও একটু অদ্ভুত ‘ডেলিশাস’।
নাস্তা শেষে রওনা দিলাম সিরাজগঞ্জের উদ্দেশে। বনপাড়া মোড়ে এসে আবার থামলাম কিছুক্ষণের জন্য। একটি রাস্তা চলে গেছে সিরাজগঞ্জ আরেকটি পাবনা। আমি আগামীকাল পাবনা শহরে যাব তবে এই রাস্তাতে না, অন্য রাস্তায়। বনপাড়া থেকে হাটিকুমরুলের দূরত্ব পঞ্চাশ কিলোমিটার। তারপর হাটিকুমরুল থেকে সিরাজগঞ্জ যেতে হবে।
হাটিকুমরুলের পথে রওনা দিলাম। এখানের এই রাস্তা অন্য রকম। বাস-ট্রাকের জন্য একটা রাস্তা। সেটা উঁচুতে আর পাশ দিয়ে নিচের দিকে একটা রাস্তা সেটা শুধু রিক্সা, ভ্যান আর সাইকেলের জন্য। এই পর্যন্ত যতগুলা রাস্তা দেখেছি এই রাস্তাটি সাইকেলের জন্য নিরাপদ মনে হল। কিছুদূর আসার পর আবিষ্কার করলাম এই রাস্তায় টোল দিতে হয়। বাংলাদেশের আর কোন রাস্তার জন্য টোল দিতে হয় কিনা আমার জানা নাই। তবে সাইকেলের জন্য টোল দিতে হল না। মনে হচ্ছিল দেশের সব রাস্তা যদি এই রকম থাকতো তাহলে সাইক্লিস্টদের জন্য অনেক ভাল হত। আমি রাস্তাটার প্রেমে পড়ে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম আগামীকালও এই রাস্তা দিয়ে পাবনা যাব দূরত্ব একটু বেশি হলেও।
রাস্তার দুই পাশেই যতদূর যায় ক্ষেত। বিভিন্ন রকম চাষাবাদ করেন লোকজন। এইরকম একটা জায়গায় দেখি রসুনের চাষ হয়েছে। কিছু লোকজন ক্ষেত থেকে রসুন তুলে টেম্পুটে উঠাচ্ছেন। পাশাপাশি একদল কৃষক দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। আমাকে ছবি তুলতে দেখে দূর থেকেই ডাক দিলেন।
‘সাংবাদিক ভাই এদিকে আসেন দুইটা ভাত খাইয়া যান।’
‘আমি তো সাংবাদিক না, এমনিতে ঘুরতে আসছি।’
‘তাতে কি, খান আমাদের সঙ্গে এক প্লেট ভাত।’ অন্য একজন বলে উঠলেন।
‘নাহ আরেকদিন খামুনে।’
‘গরিব মানুষ তাই আমাদের সঙ্গে খাবেন না।’
এর পরে আর কোন কথা চলে না। আমিও তাঁদের সঙ্গে বসে গেলাম। বিশাল বলের মধ্যে ভাত। আমাকে একজন প্লেট এগিয়ে দিলেন। প্রথমে অনেক ভাত দিলেন। আমি ভাত কিছুটা কমিয়ে নিলাম। ডাল, শুটকি ভর্তা, আর শবজি। আমিও ক্ষুধার্থ ছিলাম আর তাঁদের এই সরলতা আমাকে মুগ্ধ করলো।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার রওনা দিলাম। পড়ন্ত বিকেলে হাটিকুমরুল উপস্থিত হলাম। উত্তরবঙ্গের অনেক গাড়ি এসে এখানে জড়ো হয়। এখান থেকেই সব গাড়ি একসঙ্গে ঢাকার পথে রওনা দেয় যমুনা সেতু পার হয়ে। আর ঢাকা থেকে যে গাড়িগুলা আসে এখানে এসে বিভিন্ন জেলার পথে আলাদা হয়ে যায়।
সিরাজগঞ্জ শহরে এসে উঠলাম বাবু ভাইয়ের এক বোনের বাসায়। বাবু ভাইয়ের কথা আগেও উল্লেখ করেছি তিনি টাঙ্গাইলেও আমার থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। তখনই বলে রেখেছিলেন আমি যেন সিরাজগঞ্জ আসলে উনার বোনের বাসাতেই উঠি। উনাদের বাসাটা সিরাজগঞ্জ বিএ কলেজের উল্টাপাশে। আপাই বলে দিয়েছিলেন লোকজনদের বললেই হবে বিএ কলেজের কথা। সেখানে দুই ভাগিনা-ভাগনির সঙ্গে পরিচয় হলো। দুইজনকেই আমার বেশ পছন্দ হলো। আরো পছন্দ হলো দুইজনের নাম, সচেতন এবং সাহসী। সচেতন নার্সারীতে পড়ে আর সাহসী চতুর্থ শ্রেণিতে। দুইজন আমাকে ভালই সঙ্গ দিল।