কেন সাইকেল কিনেছিলাম

হঠাৎ করে মনে আসলো আমি কেন সাইকেল কিনেছিলাম। কারণটা একদমই জীবনের প্রয়োজনে। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এলিফ্যান্ট রোডে এক অফিসে জয়েন করেছি। দুই তিন মাসে কাজ বুঝার পর দেখা গেল আমার অনেক কাজ অফিসের বাইরে ঘুরে ঘুরে করতে হয়। এর মধ্যে প্রতি মাসে দুই/তিন বার ঢাকা শহরের সব পত্রিকা অফিস আর টিভি চ্যানেলে যেতে হয় প্রেস রিলিজ দেয়ার জন্য। অফিস থেকে ভাড়া হিসাবে দেয়া হত ১৫০ টাকা।

তখন তিনটা চারটা জোনে পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলগুলা ছিল। মতিঝিল, কাওরান বাজার, লাভ রোড (সাত রাস্তার দিকে) আর গুলশানের দিকে। সব অফিসগুলাতে প্রেস রিলিজ দিতে মোটামুটি এক বেলা লেগে যেত। টাকা বাঁচানোর জন্য আমি বেশির ভাগ জায়গায় হেঁটেই যেতাম। এতে আমার প্রায় ১০০ টাকা বেঁচে যেত। কিন্তু সমস্যা হত সময় নিয়ে। আর ক্লান্তির বিষয় তো ছিলই। ১০০ টাকা বাঁচানোর একটা কারণও ছিল। আমার বেতন ছিল তখন ১৮০০ টাকা। তাই ভাড়া থেকে টাকা বাঁচাতে পারলে অতিরিক্ত কিছু টাকা আসতো। অন্তত নিজের হাত খরচের টাকাটা উঠে আসতো।

মাথার মধ্যে বুদ্ধি আসলো যদি সাইকেল কিনি তাহলে অনেক কিছুর সমাধান হয়ে যায়। অনেকগুলা টাকা বাঁচানো যায়, পাশাপাশি সময়ও বাঁচে। অফিসে বলার সঙ্গে সঙ্গেই না করে দিল। ঢাকা শহরের রাস্তা অনেক বিপদজনক হাবিজাবি অনেককিছু। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম অফিসের কথা শুনবো না। খোঁজ লাগালাম পুরানা একটা সাইকেল কোথায় পাওয়া যায়। আমার পরিচিত এলাকা বলতে নাখালপাড়া। সেখানেই এক ছোট ভাইয়ের মাধ্যমে একটা সাইকেল পেলাম, দাম ১২০০ টাকা। বেতনের বড় একটা অংশ দিয়ে সাইকেলটা কিনে ফেললাম। ২৪ চাকার সাইজের সাইকেলটির নাম ছিল সানশাই। লাল রঙ্গের সেই সাইকেলটি খুবই প্রিয় হয়ে গেল।

প্রথমে বেশ কিছুদিন ভালই গেল। ভালই টাকা এবং সময় বাঁচাতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর সাইকেল নিয়ে বের হলে অফিস থেকে আর ভাড়া দেয় না। সাইকেল তো আছেই, তাই আলাদা করে টাকা দেয় না। এতে কিছুটা খারাপ লাগলো। চিন্তা করলাম সময় বাঁচানোর দরকার নাই, আমি তো সময় দিয়েই বেতন নেই। আলাদা করে সময় বাঁচিয়ে লাভ কি। অফিসের কাজে সাইকেল চালানো বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু প্রতিদিন রাতে অফিস শেষে ঠিকই সাইকেল নিয়ে ঘুরতে বের হয়ে যেতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতাম। যেদিন রান্না করতাম না সেদিন দুপুরে সাইকেল চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে চলে যেতাম ভাত খেতে।

একদিন আজিজ মার্কেটে ‘নিত্য উপহার’ থেকে একটা টি-শার্ট কিনে নিয়ে আসলাম। টি-শার্টে লেখা ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া’। এই লাইনটা আমার মনের মধ্যে নতুন একটা প্রশ্ন জাগাইল। আসলেই তো বাংলাদেশটা তো দেখা হলো না। আজিজ থেকে এলিফ্যান্ট রোড ফিরতে ফিরতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। সাইকেলে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ঘুরবো। সেই ঘটনা ২০০৭ সালের।

নতুন করে চিন্তা ভাবনা আসলো যদি আরেকটু ভাল সাইকেল পাওয়া যেত তাহলে ভাল হত। এক বড় ভাই রাসেল ভাই আমার কথা শুনার পর বললেন, ‘আমার বাসায় একটা সাইকেল আছে দেখ যদি লাগে নিয়ে যাও আমি চালাই না।’ উনার বাসায় গিয়ে দেখি একটি রোড বাইক। অনেকদিন পড়ে ছিল ঠিকঠাক করতে হবে। উনিই বললেন তোমার বর্তমান সাইকেলটি বিক্রি করে দাও। সেই টাকা দিয়ে এটা ঠিকঠাক করে ফেল। উনাকে বলেছিলাম আমি তো এমনি এমনি আপনার সাইকেল নিতে পারবো না। কিছু টাকা তো নিতেই হবে। উনি সেই রাস্তাও বের করে দিলেন। উনার বাসায় দুই থেকে আড়াই হাজার বই ছিল সেই বইগুলার একটা তালিকা তৈরি করে দিলাম কম্পিউটারে। আড়াই হাজার বইয়ের তালিকার বিনিময়ে একটি স্বপ্নের রোড বাইক পেয়ে গেলাম। আর আমার পুরানা বারশ টাকায় কেনা সানশাই সাইকেলটা বিক্রি করে দিলাম এক হাজার টাকায়।

আমার নতুন রোড বাইকটার নাম ‘গোল্ডেন বাইক’। মেড ইন তাইয়াওয়ান। ২০০৮ সালের মার্চের শেষের দিকে বেরিয়ে পড়লাম, ‘তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ’। বাকিটা ইতিহাস…

[প্রচ্ছদ ছবি: রবিউল হাসান খান মনা]

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.