আমাদের নাখালপাড়ায় লুকাসের মোড়ে একটা পাঠাগার ছিল। তখনকার নাম ছিল ‘শহীদ শহিদুল্লাহ কায়সার স্মৃতি পাঠাগার’। পাঠাগারটি এখনো টিকে আছে। বর্তমান নাম ‘শহীদ বুদ্ধিবীজী স্মৃতি পাঠাগার’। তখন পাঠাগারটি ছিল দোতলায় একটি কাজী অফিসের পাশে। আমরা পাঠাগারে ক্রিটেক খেলতাম, অনেকদিন পর পর মুভিও দেখতাম।
আমাদের ছোটদের জন্য চার্লি চ্যাপ্লিনের মুভি আনা হতো। পাঠাগারটি পরিচালনা করতো সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। ছাত্র ফ্রন্টের বড় ভাইয়ারা মুভি শেষে বুঝানোর চেষ্টা করতেন, চার্লি চ্যাপ্লিন শুধু হাসির মুভি না, এখানে অনেক ম্যাসেজ আছে। আমাদের ঐ বয়সে সবই মাথার উপর দিয়ে চলে যেত। কিন্তু ভাইয়াদের কথা অনেক ভাল লাগতো, অনেক সুন্দর করে কথা বলতেন। ঐ সুন্দর করে কথা বলার চেষ্টা আমরাও করতাম। আরেক বিষয় খুব ভাল লাগতো। উনারা আমাদের অনেক আদর করতেন।
উনারা যে আদর করতেন এটা ছিল আমাদের আকর্ষণীয় বিষয়। একটু ব্যাখ্যা করলেই বুঝা যাবে। এলাকার বড় ভাইয়ারা সারাদিন কাজ করাতেন, দোকান থেকে সিগেরেট এনে দেয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় অনেক কাজ করে দিতে হত। কিন্তু পাঠাগারের ভাইয়ারা ছিল একদম অন্য রকম। বেশির ভাইয়ারাই তুমি করে বলতেন। এটা ছিল আমাদের জন্য অনেক বড় সম্মানের।
পাঠাগারে আরেকটা মজার বিষয় ঘটতো প্রায়ই। পাশের কাজী অফিস থেকে মাঝে মাঝে মিষ্টি দিয়ে যেতো। বিশেষ করে অফিসে যেসব বিয়ে হত তখন লোকজন কম থাকতো। কিন্তু মিষ্টি থাকতো বেশি, সেইসব মিষ্টির ভাগ আমরাও মাঝে মাঝে পেতাম।
পাঠাগার থেকে প্রতি পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে যেত। ঐবারও পহেলা বৈশাখে ঘুরতে যাবে। আমাদেরকেও নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান হলো। আমাদের প্রস্তাব দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা অনেকেই রাজি হয়ে গেলাম। অনেকে বাসার অনুমতির কারণে যেতে পারলো না। যথারীতি আমরা দুই ভাইও জানি বাসা থেকে অনুমতি চাইলে পাওয়া যাবে না। দুই ভাই সিদ্ধান্ত নিলাম বাসায় কিছু জানাবো না। যেই কথা সেই কাজ।
পরদিন খুব ভোরে পাঠাগারের সামনে হাজির। ভাইয়াদের আর বলি নাই আমরা যে বাসা থেকে না বলে এসেছি। কারণ বললে আমাদের নিবে না। তখন কে কে ছিল মনে নাই। তবে হাসান ভাই, চিশতী ভাইরা ছিলেন এটা মুটামুটি নিশ্চিত, শওকত ভাইও থাকতে পারেন। পাঠাগার থেকে আমরা ভাগ ভাগ করে রিক্সায় উঠলাম। রিক্সায় প্রথমে ফার্মগেট সেখান থেকে বাসে শাহবাগ। আশেপাশের কোন কিছুই দেখার সুযোগ নাই। কারণ আমি তখন দারুন এক অস্বস্থির মধ্যে আছি। আমরা দুই ভাই-ই হাফ প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে আমার টি-শার্টটা আবার নিচের দিকে ফুটা। সেই ফুটা ঢাকার জন্য বড় বোন একটা তালি দিয়েছেলেন। সেই তালি দেয়া টি-শার্ট নিয়ে আমি প্রচণ্ড লজ্জায় ছিলাম। টি-শার্টের রং এক রকম আর তালি দেয়া কাপড়ের রং অন্য রকম। বুদ্ধি করে টি-শার্ট ইন করে পরলাম। যাতে তালি দেয়া জিনিশটা আড়ালে থাকে।
যথারীতি শাহবাগ নামার পর আমরা চারুকলার (তখন চারুকলা কি চিনি না) সামনে গেলাম। সেখানে গিয়ে বাসার কথা একদম ভুলে গেলাম। সবাই কত আনন্দ করতেছে। যেদিকেই তাকাই সব কিছু রঙ্গিন। অনেক রকম মুখোশ পরা লোকজন হাঁটতেছে। হাতিঘোরা বানানো অনেক কিছু। তুমুল শব্দ চারিদিকে, বাঁশি, ঢোল অনেক কিছু। যেন একটা স্বপ্নের রাজ্য। এর মধ্যে দুই ভাই দুইজনের হাত ধরে রেখেছি, যাতে হারিয়ে না যাই। আর চারিদিকে বড় ভাইরাও আছে আমরা যাতে দলছুট না হয়ে যাই। নাখাল পাড়া থেকে রওনা দেয়ার সময়ই বলে দিয়েছিলেন কোন এক বড় ভাই যদি হারিয়ে যাই তাহলে যেন মধুর ক্যান্টিনের কথা বলি। সেখানে গেলে কাউকে না কাউকে পাবই।
সবার সঙ্গে মিছিলে ঘুরে মধুর ক্যান্টিনে গিয়ে আমরা বসলাম। এই মিছিলটা ছিল মঙ্গল শোভা যাত্রার, তা এখন বুঝতে পারি তখন জানতাম না। মধুর ক্যান্টিনে যাওয়ার পরিচিত অনেক ভাইয়া আপুরা যাঁরা হোস্টেলে থাকতেন তারা একে একে হাজির হতে থাকলেন আর আমাদের মাখন দেয়া রুটি খাওয়াতে লাগলেন। মাখন দিয়ে পাউরুটি সেদিনই প্রথম খাই। এর আগে টিভিতে অনেক দেখেছি কিন্তু এই জিনিশ খেতে যে এত মজা হবে বুঝি নাই। আর টিভিতে দেখে এই খাওয়াটাকে আভিত্যের খাবার মনে হয়েছিল। এর মধ্যে একবার নাঈম ভাই এসে খাওয়ান, খাওয়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল ঝুম্পা দি হাজির উনিও ঐ একই জিনিশ অর্ডার দেন। সকালে এসে মনে হয় তখন সবাই এই জিনিশই খেতেন দুই স্লাইডের মাঝখানে মাখন দেয়া রুটি আর চা।
খাওয়া দাওয়ার পর আবার মিছিল। মিছিলে নানা রকম স্লোগান বেশিরভাগই ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জিতেছে, সামনে আমরা বিশ্বকাপ খেলবো। সবার অনেক আনন্দ। দুপুরে কি দিয়ে খেয়েছিলাম মনে নাই। তবে বিকালে দুই তিনটা ট্রাকে করে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরা এলাকা ঘুরেছেন মানুষদের অভিনন্দনের জবাব দিয়েছেন। দূর থেকে আকরাম খান, রফিক, পাইলট, শান্ত অনেক খেলোয়াড়দের দেখার আনন্দ ছিল অন্য রকম। এক সময় সন্ধ্যা হয়ে গেল। এখন বাসায় ফেরার কথা। ততক্ষণে দুই ভাইয়ের মনে হলো, আজ বাসায় গেলে মাইর একটাও মাটিতে পড়বে না।
ছোট ভাইয়ের চিন্তা নাই, কারণ ও আমার সঙ্গে এসেছে। যা ঝড় যাবে আমার উপর দিয়েই যাবে। তার উপর পহেলা বৈশাখে টুকুর জন্মদিন। একঝাক দুশ্চিন্তা নিয়ে নাখাল পাড়ায় ফিরলাম। বাসায় ঢুকে দেখি থমথমে পরিস্থিতি। আশেপাশে আমাদের খোঁজাখুঁজির বাকি রাখে নাই। বাসায় সব সময় আমাদের শাসনের কাজটা মা-ই করতেন। বাবা কোনদিন গায়ে হাত দেন নাই। সব সময় প্রচণ্ড ঠাণ্ডা মাথায় থাকতেন। কখনো বাবাকে ঐভাবে রাগতেও দেখি নাই।
ঐ দিনও রাগ করলেন না। তিনি একটি চেয়ারে বসে ছিলেন, আমাকে সামনে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কার সঙ্গে গিয়েছিলেন?’ তখন পাঠাগারের বড় ভাইদের তেমন কাউকেই বাসায় চেনে না। একমাত্র চেনে নাঈম ভাইকে। নাঈম ভাই ছিল আমাদের বড় ভাইয়ের বন্ধু। বড় ভাই অবশ্য তখন বেঁচে ছিলেন না। এসএসসি পরিক্ষার পর মারা যান। নাঈম ভাই আর আমার বড় ভাই এক সঙ্গে পড়তেন। তাই একটা ইমশনের জায়গা ছিল। সেই ইমশনের কারণেই মনে হয় সেবার বেঁচে গেলাম।
বাবা আমাকে পাশে বসিয়ে বললেন, ‘তুমি যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাবা, কোন সমস্যা নাই। শুধু বাসায় বলে যাবা, এখানে যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হবে অথবা কখন ফিরবা বলে যাবা…’
ছবি: শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগারের সৌজন্যে