কক্সবাজার

২০০৭ সালের ঘটনা। মাথার মধ্যে ভূত চাপলো কক্সবাজার যাব, সমুদ্র দেখতে হবে। এর আগে কখনো সমুদ্র দেখা হয় নাই। সমুদ্র দেখার বাসনা স্কুল জীবনেই তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে তিন গোয়েন্দা পড়ার পর। কিশোর পাশা আর রকি বিচে যেন সব সময় চোখে ভাসতো। এরপরে আবার ছিল হুমায়ূন আহমেদের লেখায় সমুদ্র দেখার বর্ণনা। আর এলাকার অনেক বন্ধুই, স্কুল জীবনে সমুদ্র দেখে ফিরে এসে অনেক গল্প করতো।

যে কথা সেই কাজ। এই ধরনের নতুন কোন চিন্তা আসলেই বন্ধু বাবুকে বলতাম। এবারও ব্যতিক্রম হয় নাই। বাবুকে বলাতে সেও রাজি। এমন এক অবস্থা যাকে বলি সেই বলে যাবে। একজন দুইজন করে আমরা এগার/বারজনের মতো হয়ে গেলাম। একটা তারিখও ঠিক করে ফেললাম। তারিখ অনুযায়ী স্যারের কাছ থেকে ছুটিও নিয়ে নিলাম। কিন্তু সমস্যা হইল অন্য জায়গায়। যতই যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসতে থাকলো লোকজন ততই কমতে থাকলো। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল আমি আর বাবু ছাড়া কেউ নাই। এমন এক অবস্থা হইল বাবুর বন্ধুরা যাবে না বলে সেও যাবে না। এমন কি ওর বাসা থেকেও নাকি ঝামেলা শুরু করে দিয়েছিল। যাওয়া নিয়েই সংশয় দেখা দিল। আরেক ঝামেলা হইল দুই দিন বৃষ্টি। বৃষ্টির ভয়েই নাকি অনেকে যেতে চাচ্ছে না।

যেদিন যাওয়ার তারিখ ঠিক করেছিলাম তার তিনচারদিন আগে কমলাপুর চলে গেলাম। উদ্দেশ্য টিকেক কাটবো। কেউ না যাক আমি একাই যাব, সিদ্ধান্তে অনড়। কমলাপুর গিয়ে শেষবার একটা ফোন দিলাম বাবুকে, ‘আমি টিকেট কাটতে আসছি, তুই গেলে বল? না গেলে শুধু আমার জন্য টিকেট কাটবো।’ বাবুও কিছু চিন্তা না করে বলে দিল, ‘টিকেট কেটে ফেল।’ তখন শোভন, চেয়ার, সুলভ এইসব কিছু বুঝি না। কিসের টিকেট কেটেছিলাম মনে নাই তবে টিকেট ছিল ৮০ টাকা।

আমার তখন ব্যাগ ছিল না, ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে ধার করে একটা ব্যাগে জামা-কাপড় নিয়ে রওনা দিলাম। দুই জনে যথা সময়ে স্টেশনে উপস্থিত হলাম। ট্রেনে উঠে দেখি আমাদের সিটে দুইজন বসে আছে। দুইজনকে তুলে দিয়ে আমরা দুইজন আরাম করে বসলাম। সিট একদম সিএনজির সিটের মতো। আমাদের সিট নিয়ে অত ভাবনা নাই। দুইজনেই বেশ উত্তেজিত। এত দূরে এর আগে খুব একটা যাওয়া হয় নাই একা একা। তাই উত্তেজনটাও অন্য রকম, তারপর আবার যাচ্ছি কক্সবাজার। গল্প করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে কয়েকবারই ঘুম থেকে উঠে গিয়েছিলাম, প্রতিবারই বাইরে তাকিয়ে দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার। এক সময় খুব ভোরে চট্টগ্রাম স্টেশনে নামলাম।

নেমেই প্রথমে ফেরার টিকেট কেটে নিলাম, এবার আর আগের মতো ভুল করলাম না। সোজা সিএনজির সিট বাদ দিয়ে আরামদায়ক চেয়ার নিলাম। স্টেশন থেকে বের হয়েই রাস্তার উল্টাপাশে দেখলাম অনেকগুলা বাস কাউন্টার। সাইবোর্ডে লেখা ঢাকা > চট্টগ্রাম > কক্সবাজার। আমরা ধরেই নিলাম এখান থেকেই কক্সবাজারের বাস ছাড়ে। আমরা কাউন্টারে কক্সবাজারের বাসের কথা জিজ্ঞেস করলাম কখন আসবে? কাউন্টারওয়ালা বুঝিয়ে দিলেন এখান থেকে কক্সবাজারের বাস পাওয়া যাবে না। আমাদের যেতে হবে নতুন ব্রিজ সেখানে কক্সবাজারের বাস পাওয়া যাবে।

আমরা একটা রিক্সা নিয়ে রওনা দিলাম নতুন ব্রিজের উদ্দেশে। নতুন ব্রিজের কাছে গিয়ে দেখি অনেক বাস। সবাই টানাটানি করছে। প্রত্যেকটা বাস কাউন্টারে ঘুরলাম, টিকেটের দাম যাচাই করার জন্য। কারণ আমাদের দুইজনের বাজেটই ছিল সীমিত। সবগুলাতে ঘুরে দেখি একই রকম ভাড়া। পছন্দ মতো একটা বাসে দুইজনে উঠে বসলাম। সামনের দিকেই সিট পেলাম। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বাস ছাড়লো।

বাস ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দুইজনে আশেপাশে সমুদ্র খোঁজা শুরু করলাম। কিন্তু কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমরা ভেবেছিলাম বাসে উঠেই সমুদ্র দেখতে পারবো। কিন্তু কিসের কি! কোথাও কিছু নাই। এক সময় দুজনেই ক্লান্ত হয়ে গেলাম। একেতো সারারাত কিছু খাই নাই। তারপর এই বাসের সিটের সামনে জায়গা অনেক কম। বসে উঠার সময় চিপস কিনেছিলাম সেগুলাই ভরসা। রাতের ক্লান্তির কারণে দুই জনেই ঘুমিয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে উঠতাম কিন্তু আশেপাশে কিছুই দেখতে না পেয়ে বারবার হতাশ হচ্ছিলাম। পথে দুয়েক জায়গায় জ্যামেও পড়েছিলাম।

দুপুরের দিকে কক্সবাজারের কাছাকাছি পৌঁছালাম। পথের মাইলস্টোন দেখেই বুঝতে পারলাম কক্সবাজার আর বেশি দূরে নাই। তাও প্রায় ২৫/৩০ কিলোমিটার। দুইজনে আবার ঘুমিয়ে গেলাম। এক সময় ঘুম থেকে উঠে দেখি আমরা একটা পাহাড়ি রাস্তার মতো রাস্তায় উপরের দিকে উঠছি। উঠা শেষ হওয়ার পর যখন রাস্তা ডাউনের দিকে গেল তখন যে দৃশ্য দেখলাম তা হয়তো সারাজীবন ভুলবো না। দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ভুলে গেলাম। অবাক চোখে সামনে তাকিয়ে আছি। আল্লাহ এটা কি বানাইল!

সামনে বিশাল সমুদ্র। যে দিকে তাকাই সমুদ্র, বামে সমুদ্র, ডানেও সমুদ্র। এমন কি মনে হচ্ছে দূরে আকাশের সঙ্গেও সমুদ্র মিশে একাকার হয়ে আছে। তার উপর দুপুরের রোদের আলোতে সমুদ্র চকচক করছে। ইচ্ছা করছিল এখনই সমুদ্রে লাফ দেই…

এখন আর ঐ দৃশ্য দেখা যায়না। এখন ঐ রাস্তার উপরে উঠলে বিশাল বিশাল ছাদ ওয়ালা হোটেল দেখা যায়। আকাশ চুম্বী হোটেলের মাঝে মাঝে হয়তো একটু সমুদ্র দেখা যায়। কিন্তু প্রথমবারের সেই দৃশ্য আর নেই…

১৩ বৈশাখ ১৪২৪

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.