আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে আমার প্রিয় চলচ্চিত্র কি? কোন কিছু চিন্তা না করেই এক কথায় বলবো ‘বাইসাইকেল থিবস’। এই চলচ্চিত্র নিয়া আলোচনা করার যোগ্যতা আমার নাই। এই চলচ্চিত্র নিয়া আলোচনা করার জন্য এই লেখা লিখছিও না। আমি শুধু প্রিয় সিনেমা হওয়ার ইতিহাসটা বলি।
‘কাকে’ এসে প্রথমে যে কোর্সটা পাই সেই কোর্সটা ছিল দর্শনের উপর। বছরটা ২০০৫ এর শেষের দিকে অথবা ২০০৬ এর শুরুর দিকে। সলিমুল্লাহ স্যার প্রতি শুক্রবার এই কোর্সটি করাতেন, কোর্সটির নাম ছিল ‘মনোবিশ্লেষণের কারখানা’। প্রতি শুক্রবারের এই কোর্সটিতে সবসময়ই জমজমাট ছিল। ৪০ জনের সিট পুরাপুরি ভর্তি ছিল। অনেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও স্যারের লেকচার শুনতেন।
এই কোর্স চলা অবস্থাতেই এক সঙ্গে দুইটা কর্মশালার আয়োজন করা হয়। একটা ‘এশিয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা’ অর্থাৎ ‘কাকে’র চিত্রনাট্য রচনা কর্মশালা। আরেক ‘বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটি’র চলচ্চিত্র নির্মাণ কর্মশালা। ঐ কর্মশালাগুলাও সদস্যতে পরিপূর্ণ ছিল। সপ্তাহে তিন দিন ক্লাশ হতো প্রতিটা কর্মশালায়। ক্লাশগুলা দুই ভাগে ভাগ করা হতো। এক ভাগে কোন শিক্ষক এসে লেকচার দিতেন আরেক ভাগে একটা করে মুভি দেখানো হতো। কখনো লেকচার আগে হতো, কখনো মুভি আগে দেখনো হতো। পুরটাই নির্ভর করতো শিক্ষকদের উপর, শিক্ষকরা আগে আসলে মুভি পরে দেখানো হতো আবার উনারা পরে আসলে সিনেমা আগে দেখিয়ে দেয়া হতো।
দুইটি কর্মশালার শিক্ষকরাই ছিলেন নিজ নিজ জায়গা থেকে স্বনামে পরিচিত। কয়েকজনের নাম বললেই বিষয়টা বুঝা যাবে। মোর্শেদুল ইসলাম, মানজারে হাসিন মুরাদ, অমিতাভ রেজা, মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীসহ অনেকেই। নাখালপাড়ায় বাসা হওয়ার কারণে সরওয়ার ভাইকে নেশাগ্রস্ত হিসেবে চিনলেও কাকে এসে নতুনভাবে চিনেছিলাম। তিনি যে এক সময় নেশাগ্রস্ত ছিলেন সেটা বিভিন্ন ইন্টাভিওতেও বলে থাকেন।
আমার কাজ ছিল ক্লাশ শুরু হওয়ার আগে চেয়ারটেবিল ঠিক করা, প্রজেক্টর ঠিক করে রাখা। যে সিনেমাটা দেখানো হবে সেটা আগে থেকেই ঠিক করে রাখা। মাঝে মাঝে মুভিটা চালিয়ে দেখেও নিতাম। এ ছাড়াও বোর্ড-মার্কার সবই ঠিক করে রাখতে হতো আগে থেকে। তারপর মাঝখানে বিরতীতে সবাইকে চা-নাস্তা খাওয়ানো।
বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী যেটা করতো প্রথমে যদি শিক্ষকদের লেকচার থাকতো চা-নাস্তা খেয়ে চলে যেত। সিনেমা তেমন দেখতো না। অনেকেরই নাকি যে সিনেমাগুলি দেখানো হবে সেগুলা দেখাই ছিল। যাঁদের দেখা ছিল না তারা দেখতো। কিন্তু আগে সিনেমা দেখানো হলে তাদের কিছু করার ছিল না। বাধ্য হয়েই দেখতো হতো। দ্বিতীয় অংশে সিনেমা দেখানো হলে অর্ধেক ফাঁকা হয়ে যেত। তখন আমিও পেছনের দিকে বসে বসে সিনেমা দেখতাম। কিন্তু আমার কাছে বিরক্ত লাগতো যা বলার না।
এই রকম একদিন শিক্ষক লেকচার দিয়ে চলে গেছেন। বিরতীর পরে আমি সিনেমা ছেড়ে দিয়ে চলে আসলাম। কি মনে করে অনেক্ষণ পরে আবার ঢুকলাম অডিটরিয়ামে। সেখানে এক দৃশ্যতে দেখছিলাম, এক লোক সাইকেল চালিয়ে যান তারপর পোস্টার লাগান। পোস্টার লাগানোর সময় পেছন থেকে এক সময় সাইকেলটা চুরি হয়ে যায়। এই কাহিনী দেখতে দেখতে এতই মগ্ন ছিলাম যে পাশের রুম থেকে শওকত ভাই ডাকছিলেন আমি শুনতেই পাচ্ছিলাম না। দুইতিনবার ডাকার পর আমি শুনতে পেলাম।
পাশের রুমে গিয়ে শওকত ভাইয়ের একটা ঝাড়ি খেতে হল। শওকত ভাই আর কচি ভাই চা খাবেন তাই আমার ডাক পড়েছে। শওকত ভাইয়ের কথা তোমার সিনেমা দেখার কি দরকার? কাজের সময় এইসব সিনেমা দেখার দরকার নাই। পাশে বসা কচি ভাই অবশ্য প্রতিবাদ করলেন। কচি ভাইয়ের কথা দেখুক না, সমস্যা নাই।
আমার একটু মন খারাপ হলো। উনাদের চা এনে দিয়ে আর অডিটরিয়ামে ঢুকি নাই। কিন্তু আমার মনের মধ্যে খচ খচ করতে থাকলো সিনেমায় তারপরে কি হবে? উনারা কি সাইকেলটি খুঁজে পাবে?
এই চিন্তায় ঠিক মতো ঘুমও আসলো না। কাহিনীর চিন্তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পিচ্চিটার অভিনয়। এত ভাল অভিনয় এর আগে দেখেছি বলে মনে হচ্ছিল না। এখনো মনে হয় ঐ অভিনয়ের তুলনা আর হয় না। খুতখুতানি দূর করার জন্য রাতের সাড়ে বারটার দিকে ডিভিডি বের করে প্রজেক্টর চালু করে বসে গেলাম। প্রথম থেকে একা একা মুগ্ধ হয়ে সিনেমা দেখলাম। পুরা সিনেমাটাই অসাধারণ লাগলো।
কাকে যেসব সিনেমাগুলি ছিল মোটামুটি সবই বিরক্ত লাগতো আগে। কিন্তু ‘বাইসাইকেল থিবস’ দেখার পর আমার ধারণা অনেকটা পাল্টে গেল। বুঝতে পারলাম এখানে হয়তো এই রকম অনেক সিনেমাই পাওয়া যায়। শুরু হলো আমার একা একা সিনেমা দেখা। যখন অফিসে কেউ থাকতো না রাতে, প্রায়ই প্রজেক্টর ছেড়ে একা একা সিনেমা দেখতাম। সঙ্গে থাকতো ৫/৭ টা ডিভিডি অথবা সিডি। যেই সিনেমা কিছুক্ষণ দেখার পর ভাল লাগতো না সেটা দেখতাম না। যেগুলা ভাল লাগতো সেগুলা দেখতাম।
‘বাইসাইকেল থিবস’ আমি কতবার দেখেছি তার হিসাব নাই। কতজনকে যে দেখিয়েছি তারও হিসাব করা কঠিন। তবে কেউ যদি আমাকে সিনেমার কথা বলে প্রথমেই বলি ‘বাইসাইকেল থিবসে’র কথা। আমি নিশ্চিত আগামী একশ বছরেও এই সিনেমার আবেদন এতটুকু কমবে না। আমার মতো হয়তো অনেকেই মুগ্ধ হয়ে এই সিনেমা দেখবে। আর চিন্তা করবে এত অল্প বয়সে এনজো স্তালোয়া এত ভাল অভিনয় কিভাবে করলো?
১৫ বৈশাখ ১৪২৪