৬৪ জেলায় যা দেখেছি–৩৪

৩ এপ্রিল (ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ)

সকালের শুরুতেই একটি নদীর পার হতে হলো সেতুর মাধ্যমে, নদীর নাম কুমার। পথে এক হোটেলে নাস্তা করে এক সময় ভাঙ্গা পৌঁছালাম। জায়গার নাম ভাঙ্গা হলেও রাস্তা একদমই ভাঙ্গা না। বলা যায় অন্যান্য অনেক জায়গার তুলনায় এই রাস্তা বেশ ভাল।
ভাঙ্গা একটি চার রাস্তার মোড়। একটি রাস্তা ফরিপুরের যেটি থেকে আমি এসেছি। একটি রাস্তা চলে গেছে যশোর, গোপালগঞ্জ, খুলনার দিকে। একটি চলে গেছে বরিশাল আরেকটি ঢাকার পথে। আমি গোপালগঞ্জের রাস্তা ধরলাম। এই রাস্তাটি অনেক সুন্দর আর বড়। চাইলে ছোটখাট বিমানও নামতে পারবে, কোথাও কোন ভাঙ্গাচুড়া নেই। একটাই সমস্যা রাস্তার দুইপাশে গাছ নেই, এই সমস্যাটা অবশ্য সাইক্লিস্টদের জন্য।
ভাঙ্গা, মকসুদপুর, ভাটিয়াপাড়া পর্যন্ত চালাতে খুবই কষ্ট হল। পথে নামার পরে এত কষ্ট মনে হয় আর কোনদিন হয় নাই। এর মূল কারণ আমি যেদিকে যাচ্ছিলেন তার উল্টা দিক থেকে প্রচুর বাতাস হচ্ছিল। অনেক কষ্ট হচ্ছিল সেই কারণে। ভাটিয়াপাড়ার পরে বাতাস থেকে নিস্তার পেলাম। এর মধ্যে রোদও অনেক কমে গেল। এখানকার ছোট ছোট বাজারগুলার নামও অনেক সুন্দর। ঘোনাপাড়া বাজার, তিলছড়া, গোপালপুর, চন্দ্রদীঘলীয়া বাজার।
ভাটিয়াপাড়া থেকে গোপালগঞ্জের পথে একটু জোরেই সাইকেল চালাচ্ছিলাম। বাতাসের কারণে অনেক ধীরগতি ছিল সেটা পুষিয়ে নেয়ার জন্য। পথে লোকজনও বেশি ছিল, আমি যখন মানুষদের অতিক্রম করতাম তার পর পরই লোকজন আমার পেছনের দিকে তাকাতো। আমি প্রথমে বুঝতে পারি নাই কেন লোকজন এমন করছে। তেমন পাত্তাও দিলাম না এই ধরণের ঘটনায়। আমার ইচ্ছা একটু জোরে চালিয়ে গোপালগঞ্জ পৌঁছে যাওয়া।
গোপালগঞ্জ শহরে ঢুকার আগে সেতুর মাধ্যমে একটি নদী পার হতে হলে নদীর নাম মধুমতি, সেতুর নাম হরিদাসপুর। সেতুটি পার হওয়ার পর পরই একটা বড় বিদ্যুতের পাওয়ার প্ল্যান্ট দেখলাম। সেখানে থামলাম পথের দিশার জন্য। বিদ্যুৎ অফিস থেকেই একজন বের হয়েছিলেন, তিনিও অন্য সবার মতো উকিঝুকি দিয়ে আমার পেছনের রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিলেন। নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলেন, আপনার পেছনে কেউ নাই?
আমি তো অবাক! আমার পেছনে কে থাকবে? তাঁকে গোপালগঞ্জ শহরের কথা জিজ্ঞেস করাতে তিনি পথ দেখিয়ে দিলেন। পাশাপাশি জানালেন কিছুদিন আগে এসএ গেমস হয়েছিল। ভাঙ্গা থেকে গোপালগঞ্জ, এই রাস্তাটিকে সাইকেল প্রতিযোগিতার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল তাই তিনি ভেবেছিলেন আমি বুঝি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছি। এবং এখানে বুঝি নতুন কোন প্রতিযোগিতা হচ্ছে।
আমার কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল কেন এতক্ষণ লোকজন বার বার আমার পেছনের দিকে তাকাচ্ছিল। মানুষদের তাকানোর আরো কারণ ছিল আমার সাইকেল। প্রতিযোগিতার জন্য আমার মত রোড বাইকই ব্যবহার হয়। তাই লোকজনের সন্দেহরও অবকাশ ছিল না।
গোপালগঞ্জ শহরের দিকে রওনা দিলাম। কালিগঙ্গা নদীর একটা শাখাকে কেন্দ্র করেই গোপালগঞ্জ শহর। প্রথম দেখাতে আমার প্রথমে লেক মনে হয়েছে। কিন্তু আসলে এটা খাল অথবা শাখা নদী বলা যায়। এর উপরে কিছুক্ষণ পরপরই ছোট ছোট সেতু। এর মধ্যে দুয়েকটি সেতুর গঠন ঢাকার চন্দ্রিমা উদ্যান অথবা জিয়া উদ্যান যে নামেই ডাকিনা কেন সেই সেতুর মত। একদম হুবহু হুবহু এক রকম। মনে হচ্ছিল ঐটার কপি করা হয়েছে।
ঐ সেতুর কাছাকাছি একটা কমদামী হোটেল পেয়ে গেলাম। এতদিন কোরেশী ভাই অনেক জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু এই দিকে অর্থাৎ দক্ষিণের দিকে কোরেশী ভাইয়ের পরিচিত কম। তাই আমার নতুন থাকার দায়িত্ব যোগাড় করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আবু বক্কর ভাইকে। আবু বক্কর ভাই এই দিকে কাউকে খুঁজে পান নাই। তাই আজ হোটেলে থাকতে হচ্ছে। খালের পাড়ে হওয়ায় আমার জন্য সুবিধা হলো, বিকালটা ভাল কাটবে।
রুমে ঢুকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকালে বের হলাম। আমি খালের যে পাড়ে হোটেলে উঠেছি তার ঠিক উল্টাপাশেই স্টেডিয়াম। বিকালের দিকে অনেকেই সেখানে সময় কাটাতে এসেছে। অনেকে বসে আড্ডা দিচ্ছে, কেউ কেউ গিটার নিয়ে বসে গান গাচ্ছে। খালের পাড়ে এক চটপটির দোকানের টুলে বসে গানওয়ালাদের গান শুনলাম পাশাপাশি চটপটি খেলাম।
আমার হোটেলের পাশে একটি খাবারের হোটেল পেলাম সাইনবোর্ডে লেখা হিন্দু হোটেল। এতদিন অনেক মুসলিম হোটেলে খেয়েছি, হিন্দু হোটেল নাম দেখে ঢুকে পড়লাম রাতের খাবারের জন্য। দুইজন বয়স্ক পুরুষ-মহিলা হোটেলটি চালান। মহিলা এসেই বললেন এটা কিন্তু নিরামিষ হোটেল কোন মাংস পাওয়া যাবে না।
আমার অবশ্য সবজি খেতে আপত্তি নাই। এতদিন প্রায় প্রতিদিনই বলা যায় মাছ-মাংস ছিল। একবেলা সবজি খাওয়া কোন ব্যপার না। আর হিন্দু ধর্মালম্বীদের সবজি রান্নার স্টাইলের কারণে একটু অন্যরকম স্বাদ থাকে। যা আমার ভালই লাগে। ভিন্ন স্বাদের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে আসলাম ঘুমানোর জন্য। ঘুম থেকে উঠে দেখবো এক নতুন সকাল।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.