আমি সাইকেল চালানো শিখেছি সাইকেল ভাড়া করে। তখনকার সময় নিজস্ব একটা সাইকেল থাকা মানে বিশাল ব্যাপার। আর আমাদের মতো স্কুল পড়ুয়া ছেলেদের প্রধান বাসনাই ছিল নিজস্ব একটা সাইকেলের। সেই বাসনা এখন পাল্টে হয়তো স্মার্ট ফোনে চলে আসছে।
আমার বাসায় বেশ কিছুদিন একটা সাইকেল ছিল। তবে সেই সাইকেলটা আমার ছিল না। মারুফ নামে এক বন্ধুর ছিল। মারুফ ছিল আমার ছোট ভাইয়ের বন্ধু। কিন্তু স্কুলে এক বছর গ্যাপ দেয়ার কারণে দেখা গেছে মারুফও বন্ধু হয়ে গিয়েছিল।
পশ্চিম নাখালপাড়ায় সব মিলিয়ে ৪/৫ টা স্বর্ণের দোকান ছিল। এর মধ্যে একটা ছিল মারুফদের। মারুফের বাবার পুরা নামটা কেন জানি এখন একদমই মনে করতে পারছি না। কিছুদিন আগেও মনে ছিল। নামটা মনে পড়লে হয়তো যুক্ত করে দিব। কিন্তু মারুফের বাবার নামের আগে ‘শের’ ছিল। এই শের নিয়ে মারুফের বেশ অহংকার, কিন্তু আমরা ক্ষেপাতাম সব সময়।
আমরা নাখালপাড়ার ছেলেরা বেশিরভাগই ‘নাখালপাড়া হোসেন আলী’ স্কুলে পড়তাম। এর মধ্যে কিছু ছেলেপেলে একটু ভিন্ন ছিল। মারুফ ছিল সেই কাতারে। মারুফ পড়তো ফার্মগেটে সরকারী বিজ্ঞানে। আর ওর বাবার আর্থিক অবস্থা যেহেতু ভাল ছিল তাই ওর চলাফেরাও পোষাকও ছিল উন্নত।
মারুফ নিয়মিত ভিডিও গেম খেলতো। ওর ক্রিকেট ব্যাট থেকে অনেক কিছুই ছিল। তবে সাইকেল ছিল না। ভিডিও গেম খেলার জন্য সে মাঝে মাঝে টুকটাক বাবার পকেট থেকে টাকাও চুরি করতো। এই কাজটা আমিও মাঝে মধ্যে করতাম। এই ছোটখাট চুরির কাজটা সম্ভবত মাঝেমাঝে করতো এমন ছেলে খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল না।
এর মধ্যে মারুফ একবার বড় ধনের চুরি করার প্ল্যান করে ফেললো। ওর বাবা প্রতিদিন সকালে গোসল করতে যেত। সেই সময়টাই মারুফ বেছে নিল। সিন্দুক থেকে অনেকগুলা টাকা সরিয়ে ফেললো। পরবর্তীতে টাকা গুনে দেখা গেছে সেই টাকার পরিমাণ কম না। প্রায় দশ হাজারের মতো, এখন আর মনে নাই ঠিক কত টাকা ছিল। তবে দশ হাজারের চাইতে কিছু কম এটা মনে আছে।
ঐ টাকা সে কোথায় যেন লুকিয়ে রেখেছিল। একদিন ভিডিও গেম খেলতে খেলতে আমার কাছে ফাঁস করে দিল ঘটনাটা। প্রতিদিন ভিডিও গেম খেলেও টাকা শেষ করতে পারতেছিল না। আমাকে জানাইল গুলিস্তান যাবে। আমি যদি আগ্রহী হই তো তার সঙ্গে যেতে পারি। আমার কোন খরচ দিতে হবে না। সবই মারুফ দিবে।
চোখ বন্ধ করেই রাজি হয়ে গেলাম। গুলিস্তান গিয়ে মারুফ একটা টিভি গেমের সেট কিনল। সেটের সঙ্গে দুইটা ক্যাসেট ফ্রি দিয়েছিল। আমরা আরো ৭/৮ টা ক্যাসেট আলাদা কিনলাম। প্রতিটা ক্যাসেটের দাম ছিল সম্ভব ১৫০ টাকা। আমাকে মারুফ একটা লেজার লাইট উপহার দিয়েছিল। এইগুলা ছিল সবই ঘুষ। এই গেমের সেটটা দুয়েকদিন আমার বাসায় থাকবে। সেটার জন্য ঘুষ। অবশ্য এতে আমার লাভই হয়েছিল আমিও গেম খেলতে পেরেছিলাম।
এর পরে সে একটা সাইকেল খোঁজা শুরু করলো। আমাকে জানাইল কেউ যদি পুরনো সাইকেল বিক্রি তাকে যেন জানাই। আরজত পাড়ায় এক বড় ভাই রিংকু ভাই একটা সাইকেল বিক্রির জন্য লোক খুঁজতেছিল। মারুফকে জানানোর পরে সেই সাইকেলটা কিনে নিল। দাম চেয়েছিল ১৮০০ টাকা কিন্তু আমার পরিচিত ছিল বলে শেষ পর্যন্ত ১৫০০ টাকায় সাইকেলটা কেনা হয়েছিল। সাইকেলটা রিংকু ভাই তাঁর কোন এক মামার কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন। আমরা তখন স্কুলে পড়ি আর রিংকু ভাই সম্ভবত ইন্টারে পড়তেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অনেক লম্বা প্রায় সারে পাঁচ ফুটের কাছাকাছি তাই সাইকেলটা ছোট হয়েছিল।
যাই হৌক সেই সাইকেলও আমার বাসায় রাখার দায়িত্ব পড়লো। সাইকেলটা ছিল গিয়ারওয়ালা সাইকেল ঐটাই ছিল সম্ভবত আমার প্রথম গিয়ারওয়ালা সাইকেল চালানো। গিয়ার বিষয়টা আমাদের খুবই ভেজালের মনে হইল, তাই দোকানে গিয়ে গিয়ার খুলে ফেলে দিয়ে সিঙ্গেল স্পিড বানিয়ে নিয়েছিলাম।
আমাদের বাসাটা ছিল খুবই ছোট একটা বাসা। মাঝখানে পার্টিসিন দেয়া দরজা ছাড়া দুই রুমের ছোট একটা বাসা। একদম ছোট রুমে বড় ভাই থাকত আর একটু বড় যেমটা ছিল সে রুমে বাবা-মা আর আমরা তিন ভাইবোন থাকতাম। এখানে সাইকেল রাখাটা ছিল খুবই সমস্যাজনক তারপরে আবার আরেকজনের সাইকেল। তবুও আম্মাকে অনেক বুঝিয়েসুজিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
সাইকেলটা মারুফের থাকলেই কি হবে? ও ঠিকমতো চালাতে পারতো না। স্কুল, স্যারের বাসায় পড়তে যাওয়া, তারপরে আবার বাসায় এসে স্যার পড়িয়ে যেত। সময় ছিল খুবই কম। কিন্তু আমার ছিল অফুরন্ত সময়। আমি কোন স্যারের কাছে পড়তাম না, বাসায়ও স্যার আসার বিষয় ছিল না। তাই বেশিরভাগ সময় আমিই সাইকেলটা চালাতাম।
আমি বাসায় বলতাম মারুফের সাইকেল ওর বাসায় জায়গায় নাই তাই আমার এখানে রাখে। আর মাঝে মাঝে মারুফ সাইকেল নিয়ে যেত ওর বাসায় রাখার জন্য। তখন ওর বাসায় বলতো এটা আমার সাইকেল। যেহেতু আরেকজনের সাইকেল তাই ওর বাসায় বেশি দিন রাখতো না। দেখা গেছে সাতদিনে ওর বাসায় দুইদিন আমার বাসায় পাঁচদিন রাখতো।
আমি সেই সাইকেল নিয়ে প্রতিদিন ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যেতাম। কখনো একা একা কখনো রাজু নামে এক বন্ধুকে পিছনে নিয়ে ঘুরতাম। সেই সাইকেল নিয়ে একা একা অনেক জায়গায় গিয়েছি। তখন নাম জানতাম না তবে এখন বুঝতে পারি। সংসদ ভবন ছাড়িয়ে, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, ধানমন্ডি, এলিফ্যান্ট রোড, পান্থপথ, শাহবাগ, ফার্মগেট এসব জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম।
একবার একটা বড় প্ল্যান করে ফেললাম। এয়ারপোর্ট যাব। যদি বিমান দেখা যায়। কাছ থেকে বিমান দেখার প্রতি ছোট বেলায় মনের মধ্যে খুবই আকর্ষণ ছিল। এই বিষয়টা মনে হয় সবারই থাকে। প্ল্যান করার পরে উত্তেজনায় রাতে ঘুম হতো না। আবার সাহস করে বেরিয়ে যেতেও পারতাম না। তবে একদিন সত্যি সত্যি সাহস করে বেড়িয়ে পড়লাম। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পিছন দিয়ে বেড়িয়ে মহাখালী, বনানী হয়ে এক সময় এয়ারপোর্ট পৌঁছেছিলাম।
এখন জানি সেটা ছিল প্রায় ১৫ কিলোমিটারের মতো। এয়ারপোর্ট পৌঁছানোর পরে ক্লান্ত লাগছিল। এখনো মনে আছে দুই টাকা দিয়ে চারটা নোনতা বিস্কিট খেয়েছিলাম। তারপর ভালমতো পানি খেয়ে, আবার ফেরার রাস্তা ধরেছিলাম। বিমান দেখতে পারি নাই, তাই মন খারাপ ছিল। সেই মন খারাপের কারণে সম্ভবত ফেরার সময় আরো বেশি ক্লান্ত লাগছিল।
এক সময় মারুফের বাসায় জানাজানি হয়ে যায় যে মারুফ এত বড় একটা চুরির ঘটনা ঘটিয়েছে। তারপর অনুসন্ধান করে সেই টাকায় কি কি কেনা হয়েছে তাও বের করা হয়। আমার সঙ্গে মারুফের ঘুরাফেরা বন্ধ ঘোষনা করা হয়। আমার বাবা আর মারুফের বাবা দুইজনে বসেই এই সিদ্ধান্ত নেয়। তারপরে মারুফের যত জিনিশপত্র আমার বাসায় ছিল সবই ফিরিয়ে নেয়া হয়।
সেই সময়ই সাইকেলের কর্তৃত্বও আমার হাত ছাড়া হয়ে যায়। তবে সেই বিমান দেখার জন্য যে আসা-যাওয়া ৩০ কিলোমিটারের মতো সাইক্লিং সেটাই ছিল সম্ভব আমার প্রথম দিককার বড় কোন সাইকেল ভ্রমণ।
পরবর্তীতে এই সাইকেলের কল্যানেই এক সময় খুব কাছ থেকে বিমান দেখা হয়েছে, বিমানে চড়াও হয়েছে। বাংলাদেশ ভ্রমণ থেকে শুরু করে অনেক কিছুই এই সাইক্লিংয়ের কল্যানে হয়েছে। এই পর্যন্ত তিনটা দেশ ভ্রমণ করা হয়েছে। এবং প্রতিটা দেশের ভ্রমণেই সঙ্গী ছিল সাইকেল। এর চাইতে আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না। সম্ভবত আর কোন দেশ ভ্রমণ করার সুযোগ হলেও হয়তো সাইকেলই সঙ্গী হবে।
১২ ভাদ্র ১৪২৬
ছবি: মুনতাসীর মামুন ইমরান