ফ্যানিহিল

আমাকে সেক্সুয়াল বিষয়ে যে ভাইটা তালিম দিয়েছিলেন তাঁর নাম ছিল বাবু। বাবু ভাইয়ের সাথে আমার বয়সের পার্থক্য ছিল প্রায় ৫ বছর। আমি তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি আর বাবু ভাই অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। একদিন আমি স্কুলে যাব না ঠিক করেছি, বাবু ভাইও বললেন তিনি স্কুল পালাবেন। বাবু ভাইয়ের সঙ্গে পুরানা এয়ারপোর্ট গিয়েছিলাম। তখন পুরানা এয়ারপোর্টে ঢুকতে দিত, নাখালপাড়ার অনেকেই সেখানে হাঁটতে যেতেন। আর আমরা ক্রিকেট খেলতে যেতাম। যখন স্কুল খোলা থাকতো তখন স্কুল পালানোর জন্য ঐ জায়গাটা ছিল আদর্শ। একটা পেয়ারা গাছে বসে পেয়ারা খেতে খেতে নিষিদ্ধ বিষয় সম্বন্ধে জানতে পারছিলাম। তখন এইসব শুনে গা ঘিনঘিন করতেছিল। এর পরে এই বিষয়ে অনেকদিন কারো সাথেই কথাবার্তা বলি নাই। বাবু ভাইকে প্রচণ্ড বদ লোক মনে হইল। পারতপক্ষে উনার সাথে একদমই মিশতাম না। উনার ছোট ভাই ছিল রিপন ভাই। রিপন ভাইয়ের সাথে খেলাধুলা করতাম।

এরপরে দীর্ঘদিন এইসব বিষয় নিয়া কারো সাথে খুব একটা কথাবার্তা বলা হয় নাই। তবে বিভিন্ন বইয়ে বিশেষ করে উপন্যাসে টুকটাক ভাসা ভাসাভাবে কিছুটা পড়া হইছিল। একবার খুব আগ্রহ নিয়া আদর্শ লাইব্রেরি থেকে তিন গোয়েন্দা মাসুদ রানার বাইরে শুধু রোমান্টিক একটা বই নিয়ে আসছিলাম। সেখানে একটু খোলামেলা ভাবে কিছু পড়াশোনা হয়েছিল।

এর পরে রাজিবের সাথে খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আমাদের বছর খানেক অথবা দুই বছরের বড় সোহেল ভাই ছিলেন। আমরা জানতাম উনার কাছে চটি বই আছে। যেসব বইয়ে শুধু সেক্স আছে সেগুলাকে আমরা তখন চটি বই বলতাম। আমি আর রাজিব ঠিক করলাম সোহেল ভাইয়ের কাছে বই চাইব। কিন্তু দেখা গেল কেউই চাইতে পারছিলাম না। আমি রাজিবকে বলি রাজিব আমাকে বলে। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম আমরা একটা চিরকুট লিখবো। কথামতো চিরকুট লিখে সোহেল ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে আমরা হাওয়া হয়ে গেলাম। পরে কোন এক সময় সোহেল ভাইয়ের সাথে আবার দেখা হইল, উত্তরের জন্য আমরা অনেক উৎসুক ছিলাম। সোহলে ভাইয়ের উত্তর, ‘তথাস্তু’।

সোহেল ভাইয়ের কাছ থেকে আমরা বই নিয়েছিলাম কিনা মনে নাই। তবে তিনি আমাদের গল্পগুলা বলেছিলেন। এখন যেমন অডিও বুক পাওয়া যায় সে রকম। তিনি প্রধান চরিত্র আর মেয়েদের চরিত্রের কথা এখানে বলতেছি না, কারণ ১১ নাম্বার গলির অনেকেই বন্ধু তালিকায় আছে, সবাই সেই আপুদেরকে চিনতে পারবে।

এর পরে দীর্ঘদিন মনে হয় এইসব বিষয় নিয়া মাথা ঘামাই নাই। আমি মাসুদ রানা, ওয়েস্টার্ন, হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবাল, সমরেশ, সুনীলে ডুবে ছিলাম বলা যায়। আমরা নিয়মিত ক্রিকেট খেলতে যেতাম শাহীনবাগে। তখন আমি অলরেডি স্কুল ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু ক্রিকেট ছাড়ি নাই। আমি দুইটা গ্রুপের সাথে মেলামেশা করতাম। একটা নাখালপাড়ার সবচাইতে খারাপ গ্রুপ আলীর বাড়ির গ্রুপের সঙ্গে। আরেকটা গ্রুপ হইল নাখালপাড়া হোসেন আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ২০০২ এর ব্যাচের সবচাইতে ব্রাইট স্টুডেন্ট বা নাখালপাড়ার সবাইচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলার সাথে বলা যায়। এই গ্রুপের সাথে আমার শুধু খেলাধুলার সম্পর্কটাই ছিল। পড়ালেখার বিষয়ে কোনদিন এঁদের ধারে কাছেও যেতে পারি নাই। যদিও এই উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলা এখন আর দেশে নাই। সবাই না তবে অনেকেই দেশে নাই। কানাডা আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে।

সেই গ্রুপের একটা ছেলে ছিল খায়রুল। চতুর্থ শ্রেণিতে মনে আছে খায়রুলের রোল নাস্বার ছিল ১২। ছোটখাট খায়রুল স্কুলের খেলাধুলায় সারা জীবন প্রথম হয়ে আসছে। বিশেষ করে দৌঁড়ে খায়রুলকে সম্ভবত কেউ পিছনে ফেলতে পারে নাই। আমরা যখন একসাথে ক্রিকেট খেলতাম তখন এই উজ্জ্বল নক্ষত্ররা অষ্টম/নবম শ্রেণির ছাত্র। কিভাবে কিভাবে জানতে পারলাম খায়রুলের কাছে বিস্তর চটিবই আছে।

খায়রুলকে বলার পরে সঙ্গে সঙ্গে বললো, ‘আছে তো, তোর লাগবে নাকি?’ একটাই শর্ত দুইদিন পরে ফেরত দিতে হবে। কোন এক শুক্রবারে খায়রুল দুইতিনটা বই নিয়া আসলো। একটা নতুন তৈরি করা বিল্ডিংয়ের দোতলায় উঠে, খায়রুল প্যান্টের ভিতর থেকে বইগুলা বের করলো। খায়রুলের সঙ্গে আমি আর রাসেল। রাসেল একটু মোটাসোটা ছিল, তাই ওরে আমরা বটকা ডাকতাম। আমি আর রাসেল তখন দুইজনেই অনেক উত্তেজিত। রাসেল বই নিয়েছিল কিনা মনে নাই, তবে আমি দুইটা বই নিয়ে আসছিলাম।

পরবর্তীতে খায়রুলের সাথেই হলে গিয়ে প্রথম থ্রি এক্স সিনেমা দেখা হয়েছিল। সেটা ছিল ডিপজলের সিনেমা হল পর্বতে। হলটা ছিল গাবতলীতে।

ফার্মগেটের ফুটওভার ব্রিজের গোড়ায় পত্রিকার দোকানে বইপত্রগুলা কিনতে পাওয়া যেত। সেখান থেকে আমি কয়েকটা বই কিনেছিলাম কয়েকবার গিয়ে। সাদাকালো ছবির বইয়ের এক রকম দাম আবার রঙ্গিন ছবিসহ বইয়ের দাম ছিল বেশি। শুধু গল্পের বইয়ের দাম ছিল কম যতদূর মনে পড়ে ১০ টাকাতেই গল্পের বই পাওয়া যেত। সাদাকালো ছবিসহ বইয়ের দাম ছিল ১৫ টাকার মতো। রঙ্গিন বইয়ের দাম ২০/২৫ টাকা।

পরবর্তীতে যখন সিডি-ভিসিডির দোকানে কাজ করতাম তখন তো আরো অনেক কিছুই দেখেছি। আমার ‘কস্তুরি ভিডিও’ লেখায় বিস্তারিত উল্লেখ করেছি। তাই এখানে আর বিস্তারিত লিখলাম না।

তবে যত বই কিনেছি কোন বইয়ের নামই মনে নাই। কিন্তু প্রথম বইটার নাম এখনো মনে আছে, সেই বইটা কিনতে সময় লাগছিল প্রায় আধা ঘণ্টা। দোকানের সামনে গিয়ে বার বার ফিরে আসছিলাম। দোকানদার বুঝতে পেরেছিল, ‘বলছিল কি লাগবো নাকি?’ আমিও মাথা নেড়েছিলাম লজ্জা নিয়ে। বইটার নাম ছিল ‘ফ্যানিহিল’। আর যে কয়টা বই কিনেছি বেশির ভাগ বইয়েই দেখা গেছে লেখকের নাম ছিল, রসময় গুপ্ত। আর কোন লেখকের নাম মনে নাই। তবে এই নামটাও নিশ্চয়ই ছদ্মনাম ছিল।

এভাবেই আমাদের সামনে নর-নারীর সম্পর্কের একটা খোলামেলা নতুন দরজা খুলে গিয়েছিল সেই সময়।

১১ বৈশাখ ১৪২৭

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.