২০১৩ সালের দিকে আমি, নিয়াজ ভাই আর লিপু ভাই সিলেট থেকে তামাবিল ক্রসকান্ট্রি করতে বের হয়েছিলাম। ঐটা লিপু ভাই আর নিয়াজ ভাই দুইজনেরই প্রথম ক্রসকান্ট্রি বলা যায়। আমরা রমজান মাসের শেষের দিকে বের হয়েছিলাম। ঈদের ছুটিকে টার্গেট করেই বলা যায়। প্রথম তিনদিন রোজা ছিল। লিপু ভাই প্রতিদিন রোজা রেখে আমাদের সাথে সাইকেল চালিয়েছিলেন। এই মানুষটা প্রচণ্ড খাটতে পারে, সুপার হিউম্যান টাইপের। আমরা তিনদিন পরে রাতে ঢাকায় এসেছিলাম। চতুর্থ দিন ঈদের দিন ঢাকা থেকে সকালে রওনা দেই।
সেখানে নাঈম ভাই বেশ উৎসুক ছিল, কিছু একটা তাঁরও করতে হবে। কিন্তু কি করবে সেটা বুঝতে পারছিলেন না। তখন উনার বয়স অল্প ছিল, মাত্র কলেজে পড়ে সম্ভবত। ঐ রকম সময়ে সবাই উত্তেজিত থাকে, কিছু না কিছু করতে চায়। একটা পাগলামীর ভাব থাকে। সেদিন তাঁর চোখেমুখে যে পাগলামী দেখেছিলাম, সেটার প্রকাশ হইতে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় নাই। আমরা পরের দিন মৌলভিবাজার ছিলাম। তার পরেরদিন যখন সিলেট ক্রস করছি তখন নাঈম ভাইয়ের ফোন। তিনি একটা ব্যাগ নিয়া বের হয়ে গেছেন। ভৈরব থেকে হেঁটে হেঁটে সিলেটে যাবেন ঠিক করেছেন। ফোনে বলতেছিলেন আমাদের দেখে তিনি আর স্থির থাকতে পারেন নাই।
এর পরে মাঝে মাঝেই আমার সাথে টুকটাক ফেসবুকে অথবা মোবাইলে অ্যাডভেঞ্চার বিষয়ে কথাবার্তা হইত। কখনো সাইক্লিং অথবা কখনো ম্যারাথন অথবা দৌড় নিয়া। খুব সম্ভবত বিগ-বাংলা ম্যারাথনেও অংশ নিয়েছিলেন। এক সময় নাঈম ভাই ঢাকায় চলে আসলেন পড়াশুনার জন্য। তখনও টুকটাক কথাবার্তা হইত, একদিন মন খারাপ করে বলতেছিলেন, ‘ভাই ঢাকায় আসলাম কিন্তু দেখা হইল না। দূরে থাকাই তো ভাল ছিল।’
আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল। তবে ফেসবুকের কারণে তাঁর কর্মকাণ্ড টুকটাক খবরাখবর আসতো সামনে। তিনি অ্যাডভেঞ্চারের ট্রেক চেঞ্জ করে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে গেলেন। হঠাৎ একদিন দেখতে পেলাম তিনি একটা স্বল দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও তৈরি করে ফেলেছেন। ভৈরব থেকে ঢাকায় এসে মাত্র ৪/৫ বছরের মধ্যে এরকম একটা কাজ করা সাধারণ বিষয় না।
অনেক স্ট্রাগল করেই সিনেমাটা তিনি তৈরি করেছেন বলা যায়। ফার্মগেট থেকে হেঁটে হেঁটে বনানীর ভার্সিটিতে গেছেন। টাকার অভাবে ঢাকা থেকে ভৈরব গেছেন বাসের ছাদে করে। অদ্ভুত একটা পাগলামী আর ভালবাসা না থাকলে এই কাজ কখনোই করা যায় না। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব আছে, অনেক বড় বড় ডিরেক্টরের সহযোগি হয়ে ৮ বছর ১০ বছর ধরে কাজ করতেছেন। তাঁদের হাতে ক্যামেরা আছে অ্যাডিটিং প্যানেল আছে কিন্তু ৫ মিনিটের কিছু একটা বানাতে পারেন নাই। এই জিনিশ বানাতে হলে যে ধরনের পাগলামী অথবা ঝুঁকি নিতে হয় সেই সাহসটা সবার হয় না, অথবা যে স্ট্রাগলটা করতে হবে সেটার ভয়েই হয়তো কিছু একটা বানাতে পারেন না।
নাঈম হকের সিনেমার নামটা প্রথমেই আমাকে আকৃষ্ট করেছে। সিনেমার নাম, ‘দ্য টাইপিস্ট’। নামটা আকৃষ্ট করার প্রধান কারণ, এটাই আমার পেশা। টাইপ মেশিনে না হলেও মানুষের হাতের লেখা অথবা অন্যান্য যেকোন মাধ্যমের লেখাই কম্পিউটারের কিবোর্ডে টাইপ করেই আমি ভাত খাই।
‘দ্য টাইপিস্ট’ দেশি বিদেশি প্রায় দশটির বেশি চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটি প্রদর্শিত হয়েছে। এর মধ্যে ভারতের কলকাতা, মুম্বাই তো আছেই। এ ছাড়াও ইতালি, কানাডায় গিয়েছে এই স্বল্প দৈর্ঘ্য সিনেমাটি। ভবিষ্যতে হয়তো সিনেমাটি দেখার সৌভাগ্যও হবে।
নাঈম ভাইয়ের প্রতি শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা। আপনে পূর্ণ দৈর্ঘ্য হোক স্বল্প দৈর্ঘ্য হোক, মানুষের জন্য আরো সিনেমা বানান। আপনার স্বপ্নগুলো পূরণ হোক।
২০ বৈশাখ ১৪২৭