আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি তখন অনেক সময়েই বাসায় থাকতাম। বাসা ছিল কলেঝগেটে তাই বাসে করে ইউনিভার্সিটি যেতে হত। একদিন বাসে যাচ্ছি তখন আজিমপুরের কাছে চারটা ছোট ছোট বাচ্চা বাসে উঠল, তাদের সবার লশ্বা কুর্তা এবং গোল টুপি, কাছাকাছি একটা এতিমখানার শিশু সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। এতিমখানার বাচ্চাদের কাছে বাস ভাড়া থাকবে না সন্দেহে কন্ডাক্টর তখন তখনই বাচ্চাগুলোর কাছে ভাড়া চাইল এবং বাচ্চাগুলো উদাস দৃষ্টিতে না শোনার ভান করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। আজকাল বাসের কন্ডাক্টরদের মেজাজ খানিকটা মধুর হয়েছে কি না জানি না কিন্তু সেই সময় তারা ছিল অত্যন্ত কাটখোট্টা মেজাজের। ভাড়া নেই টের পেয়ে মাথায় দুই চারটা চড়থাপ্পর দিয়ে কন্ডাক্টর তখন তখনই বাস থামিয়ে বাচ্চাগুলোকে নামিয়ে দেবার জন্য প্রস্তুত হল। বাসের ভাড়া খুব কম–চারটা বাচ্চার ভাড়া দিয়ে দেওয়া কোনো ব্যাপার নয় তাই আমি গলা নামিয়ে কন্ডাক্টরকে ডেকে ভাড়াটুকু দিয়ে দিলাম। বাচ্চাগুলো তখনো উদাস দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে!
তখন বাসের মাঝে একটা নিউক্লিয়ার চেইন রি-একশন শুরু হল। একজন যাত্রী গলা উঁচিয়ে অন্য বাসযাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, “আপনারা বিষয়টা দেখলেন?”
অন্যরা বলল, “দেখেছি।”
প্রথমজন বলল, “এই চার জন তালেবুল আলেমের কাছে ভাড়া নাই বলে এই কন্ডাক্টর কী রকম ব্যবহার করল দেখেছেন?”
অন্যেরা গর্জন করে বলল, “দেখেছি!”
‘কত বড় সাহস এ্ হারামজাদার।” আমাকে দেখিয়ে বলল, “এই কলেজের ছাত্রকে সেই ভাড়া দিতে হল। চারটা ছোট তালেবুল এলেম এতিম বাচ্চা কি বাসে ফ্রি যেতে পারে না।”
অন্যেরা বলল, “অবশ্যই পারে।”
একজন বলল, “শুয়োরের বাচ্চা কন্ডাক্টর।”
কয়েকজন প্রতিধ্বনি করল, “শুয়োরের বাচ্চা। ধর শালাকে–”
বাসের ভিতরে সবাই মিলে তখন কন্ডাক্টরকে ধোলাই দেওয়া শুরু করল। বাস কোনোমতে মেডিকেলে থেমেছে–আমি নেমে সোজা দৌড়! তখনই আবিষ্কার করেছি আমাদের বাঙালির মন বোঝা খুব মুশকিল–কখন যে সেটা তেতে উঠবে অনুমান করার কোনো উপায় নেই!
বাসে যাতায়াত করতে আমার ভালো লাগত না বলে সাইকেল রিকশার মেকানিকদের দোকান থেকে আমি একটা পুরোনো সাইকেল কিনেছিলাম। একেবারেই লক্করঝক্কর সাইকেল তবে খুব সস্তা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কোন কোম্পানির সাইকেল?”
সাইকেল বিক্রেতা মেকানিককে খুব বিভ্রান্ত দেখা গেল মাথা চুলকে বলল, “হ্যান্ডেলটা হাম্বারের।”
আমি বুঝতে পারলাম বিভিন্ন সাইকেলের ধ্বংসাবশেষ থেকে নানারকম টুকরো যোগাড় করে এই সাইকেল তৈরি হয়েছে! হ্যান্ডেলটা এসেছে হাম্বার সাইকেল থেকে। আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই, চললেই হল।
দেখা গেল সেটা খুব ভালো চলে না, সাইকেলে রওনা দিয়ে বেশিরভাগ সময় রাস্তার পাশে মেকানিকদের দিয়ে সাইকেল সারাতে হয়। শুধু তাই নয় প্যান্টের নিচের অংশ সাইকেলের ভেতর ঢুকে গিয়ে সেটা ছিবড়ের মতো করে ফেলে এবং আমি রাস্তার মাঝে ওলটপালট খেয়ে পড়ি! সাইকেলের যেখানেই হাত দেওয়া যায় সেখানেই যে চটচটে কালি থাকে আমি সেটাও তখন আবিষ্কার করলাম।
এরকম সময়ে রাশিয়া থেকে কিছু সাইকেলের চালান এল বাংলাদেশে। বাংলাদেশে তখন কিছুই পাওয়া যেত না। ঐ সাইকেলগুলোর চাহিদা মিগ ফাইটার প্লেনের কাছাকাছি–আমার পক্ষে সেটা কেনার কোনো উপায় নেই, আমার দুলাভাই কীভাবে কীভাবে জানি সেটা আমাকে যোগাড় করে দিলেন। জোড়াতালি দেওয়া সাইকেল ফেলে দিয়ে আমি যখন সেই ঝকঝকে নূতন সাইকেলে উঠলাম আমার মনে হল সমস্ত পৃথিবী আমার পায়ের তলায়!
বহুদিন আমি সেই সাইকেলে চড়েছি, পুরো ঢাকা আমি চষে বেড়াতাম। সেই সাইকেলে একদিন যাচ্ছি দেখি রিকশা করে আহমদ ছফা যাচ্ছেন, আমাকে হাত তুলে থামালেন! আমি তার রিকশায় পা রেখে দাঁড়ালাম, আহমদ ছফা তার পকেট থেকে একটা এক টাকার নোট বের করে আমাকে দিলেন। বললেন “নাও।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কেন ছফা ভাই?”
আহমদ ছফা মুখ সুচালো করে বললেন, “তোমার একটা লেখা পড়েছি, খুব ভালো লেগেছে তাই দিলাম!”
লেখালেখি করে সেটা ছিল আমার প্রথম উপার্জন!
সাইকেলে করে যেতে যেতে মাঝে মাঝে আরো মজার ব্যাপার হত, হয়তো বিশাল একটা বাস ওভারটেক করে ছুটে যাচ্ছি যখন বাসও ছুটে আমার পাশে এসে দাঁড়াতে, ড্রাইভার মাথা বের করে আমাকে ডাক, “এই যে স্যার!”
আমি আবিষ্কার করতাম আমার পরিচিত একজন বাস ড্রাইভার। ডিপার্টমেন্টের সবাইকে নিয়ে পিকনিকে গিয়েছিলাম। মিরপুরের কোনো এক অন্ধগলি থেকে খুঁজে সেই ড্রাইভারকে বের করতে হয়েছিল, সেই থেকে পরিচয়! রাস্তার মাঝে ছুটন্ত অবস্থায় আমাকে দেখলেই বাস থামিয়ে আমার সাথে খোশগল্প করত। এক বাস বোঝাই যাত্রী ধৈর্য ধরে বসে আছে, বাসের ড্রাইভার জানালা দিয়ে মুখ বের করে আমার সাথে খোশগল্প করছে, আমি সাইকেলে বসে বাসে হেলাম দিয়ে তার সাথে দেশ সমাজ আর রাজনীতি নিয়ে গল্প করছি দৃশ্যটা আমার কাছে কখনোই বিচিত্র মনে হত না!
সাইকেলটা হঠাৎ করে একদিন চুরি হয়ে গেল। উনিশ শ একাত্তর সালের পরে পার্থিব জিনিসের জন্য আমাদের কারো কোনো মায়া ছিল না, কিন্তু সাইকেলটা ছিল আমার একটা বন্ধুর মতো–তাই তার জন্য খুব কষ্ট হত। মনে হত যে চুরি করেছে সে আমার সাইকেলটাকে কষ্ট দিচ্ছে না তো? এখনো সেই সাইকেলের জন্য আমার কেমন জানি মন কেমন কেমন করে। আহা বেচারা, না জানি সে কেমন আছে!
সূত্র: মুহম্মদ জাফর ইকবাল, রঙিন চশমা (ঢাকা: প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ফেব্রুয়ারি ২০০৭)।